তালগাছের গুরুত্বকে চাবিকাঠি করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বজ্রপাত নিরোধে শতকোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। দুই বছর যেতে না যেতেই মুখ থুবড়ে পড়ে প্রকল্পটি। অযত্ন-অবহেলায় ৪০ লাখ তালগাছের চারা লাগানোর প্রকল্পটি মাঠে মরে যায়।
Published : 14 May 2024, 04:22 PM
বেশিদিন আগের কথা নয়। তালগাছের চারা ও তালের আঁটি লাগানোর সেই ঢাক পিটানো প্রচারণা। মানে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু, গবাদিপশু রক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি কমানোর লক্ষ্যে প্রচার-প্রচারণা। ওইসময় এক পায়ে দাঁড়ানো ইয়া লম্বা তালগাছের মর্যাদা ও গুরুত্ব বেশ বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঢাক পিটানো এক সময় ঢাক ঢাক গুড় গুড়ে চুপসে গেল।
অথচ বজ্রপাতে বছর বছর মানুষের মৃত্যু বাড়ছে। দীর্ঘমেয়াদী তাপপ্রবাহের কারণে চলতি বছরের ওই আশঙ্কা আর বেশি। আবহাওয়াবিদরাই এসব আশঙ্কার বলছেন।
প্রাকৃতিক কারণে একসময় মানুষের অকাল মৃত্যু খুব স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। সেই স্বাভাবিকতা এখন কমে এসেছে। যেমন সাপের কামড়ে মৃত্যুর হার কমে এসেছে। আর শ্বাপদ জঙ্গলও নেই যে বন্য প্রাণীর আক্রমণে মানুষ হতাহত হবে। তারপরও গুটিকয় হাতি নির্বংশ হওয়ার আগে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তাই হাতির আক্রমণেও মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এছাড়া নিয়মিতই খবরের শিরোনাম হয পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা। এ ধরনের কিছু কিছু মৃত্যুর ঘটনায় অসতর্কতাই দায়ী। কিন্তু সতর্ক থাকার পরও সড়ক দুর্ঘটনার মতো আধুনিক যন্ত্রদানবের হাতে মানুষের প্রাণহানি বাড়ছে। এই নৃশংস মৃত্যু কোনো সচেতনতা, সতর্কতা ও মানবিক সমবেদনাও তৈরি করে না যেন। এমন অবস্থায় বজ্রপাতে মৃত্যু নিয়ে বলাবলি করাটা কতটা আবেদন সৃষ্টি করবে? আবেদন সৃষ্টি না করলেও আয়োজনের কমতি থাকে না। আয়োজন হলেই লাভে লাভ। তা-ই যদি না হতো, মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা কমানোও অসম্ভব ছিল না।
কারও মৃত্যুর ব্যাপারে নির্দয় আচরণের কথা বাদ দিলেও মানুষকে অস্বাভাবিক মৃত্যুর হাতে ছেড়ে দেওয়া রাষ্ট্রের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞানের দৈন্যও প্রকাশ করে। যাতে করে উঁচু চেয়ারে বসে উচ্চতর জ্ঞানের বড়াই করাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় দিনশেষে। তাই নিজেদের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি প্রমাণের দায় রয়েছে। বিশ্বের বহু দেশই বজ্রপাত বা অন্যান্য কারণে মানুষের মৃত্যু প্রতিরোধে অনেক সাফল্য অর্জন করছে। অথচ ওইসব দেশেও বজ্রপাত হয়। কৃষকেরা মাঠে যায়, ফসল ফলায়। কিন্তু চিন্তা ও প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে বজ্রপাতে আমাদের কৃষক-জেলের মৃত্যু কমছে এমন কোনো তথ্য নেই।
বর্ষা মৌসুম এলেই সংবাদ মাধ্যমে যে খবরটা এখন প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে তা হলো বজ্রপাতে হতাহতের। বর্ষা মৌসুম তো বটেই, এর আগে-পরের কয়েক মাসে এই খবর প্রায় নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়। মূলত এপ্রিল থেকে জুনে ৭০ শতাংশ বজ্রপাত হয়। এরপর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে মৌসুমী বায়ু ফেরত যাওয়ার সময়। এই দুই মৌসুমই কৃষকের ফসল ঘরে তোলার সময়। এ বছর বর্ষা শুরু হতে না হতেই কালবৈশাখী বজ্রপাতে মারা গেছে ৫০ জনের বেশি মানুষ। গত ৫ মে খাগড়াছড়ির তিন উপজেলায় মা ও ছেলেসহ ৫ জন মারা গেছে। আহত হয়েছে আরও ২ জন।
গত ২ মে বজ্রপাতে কুমিল্লাসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে বজ্রপাতে মারা গেছে ১০ জন। এছাড়াও পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, নেত্রকোণা, যশোর, পিরোজপুর, ভোলা, রাঙামাটি, খুলনা ও বাগেরহাটে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৬ সালের ১২ মে একদিনে বজ্রপাতে ৩৫ জনও নিহত হয়েছিলেন। সন্ধ্যায় মসজিদে নামাজের সময় বজ্রপাতে একসঙ্গে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল ২০১১ সালে। দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুবরণকারীদের ৭০ শতাংশই কৃষক। যারা কর্মঠ পুরুষ। এছাড়া মাছ শিকার বা পানিতে ১৩ শতাংশ ও পথেঘাটে থাকা ১৪ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু ২০২২ সালে ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াতে গিয়ে ৫১ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল বলে খবর প্রকাশ হয়েছিল। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য জানাচ্ছে ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে ২,১৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বছর বছর এই দুর্যোগে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাটা বাড়ছে। এটা বেড়ে চলার মধ্যে পর্যবেক্ষণকারীরা যেমন জলবায়ু ও আবহাওয়ার আচরণ পরিবর্তনের কথা বলেছেন, তেমনি হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে বড় ও লম্বা গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার কথা, যেগুলো বজ্রপাত প্রতিরোধে বেশি উপযোগী। এরকম লম্বা গাছের মধ্যে সবচেয়ে উপযোগী ছিল তালগাছ।
পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে অন্যান্য বড় গাছের পাশাপাশি তালগাছও কাটা পড়েছে এবং পড়ছে। তালগাছের গুরুত্বকে চাবিকাঠি করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বজ্রপাত নিরোধে শতকোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। দুই বছর যেতে না যেতেই মুখ থুবড়ে পড়ে প্রকল্পটি। অযত্ন-অবহেলায় ৪০ লাখ তালগাছের চারা লাগানোর প্রকল্পটি মাঠে মরে যায়।
অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে কোনো সমীক্ষা ছাড়া এসব প্রকল্প নেয়া হয়েছিল বলে পত্রপত্রিকায় খবর এসেছে। একটা বড় সময় চলে যাওয়ার পরে তালগাছ লাগানোর প্রকল্প সঠিক ছিল না বলে দাবি করেন কর্তাব্যক্তিরা। এটাকে অবৈজ্ঞানিক পন্থাও বলতে থাকেন কেউ কেউ। প্রকল্প গ্রহণের আগে এটাকে স্থানীয় প্রযুক্তি বলে জানানো হয়েছিল। এজন্য থাইল্যান্ডের গল্পও শোনানো হয়েছিল। এভাবে নয়-ছয় আর অজ্ঞতা, জোচ্চুরির গল্পের শেষ নেই। এসব গল্প শুরু হয় ২০১৬ সাল থেকে। যখন বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়G
২০১৬ সাল থেকেই শত শত কোটি টাকা অপচয় প্রকল্পের কলেবর এখন বাড়ছেই বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে ২০১৮ সালে আবহাওয়া অধিদপ্তর ৬২ কোটি টাকার বজ্রপাত সঙ্কেত যন্ত্র 'লাইটনিং ডিটেকশন সেন্সর' প্রকল্প নেয়। যাতে সংশ্লিষ্ট বজ্রপাত এলাকায় ১৫ মিনিট আগে বজ্রপাতের সঙ্কেত পাওয়ার কথা ছিল। প্রকল্প শেষ হলে দেখা গেল সেন্সর সঙ্কেত দেয় না। তাতে সেন্সর রক্ষণাবেক্ষণ, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট সংযোগের সমস্যাসহ নানা সঙ্কটে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।
মানুষ ও প্রাণী রক্ষায় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পও নেওয়া হয়। এজন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের (টিআর) আওতায় ১৫টি জেলায় লাইটনিং অ্যারেস্টার বসানোর জন্য ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দও দেয় মন্ত্রণালয়। এরপর ১৩৫টি উপজেলায় ওই যন্ত্র স্থাপনের কথা বলা হলেও বাস্তবে কোনো যন্ত্র বসেনি বলে একটি সংবাদমাধ্যম জানায়।
এ বছর এলজিইডি হাতে নিয়েছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। ১৪ জেলায় ১ হাজার ৪০০টি বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন প্রকল্প। এভাবে আছে হাওর অঞ্চলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প। ২৩১ কোটি টাকার। তা-ও বজ্র নিরোধক দণ্ড বসানো। এর আওতায় আছে হাওরের সাত জেলা। যেখানে ১৬টি আর্লি স্টিমার ইমিটার (ইএসই) যন্ত্র বসবে।
বজ্রপাতের আগাম তথ্য পেতে নাসার সঙ্গে ‘হাই ইমপ্যাক্ট ওয়েদার অ্যাসেসমেন্ট’ প্রযুক্তি চালু করার কথাও জানা যাচ্ছে। এ পর্যন্ত আবহাওয়া অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি বজ্রপাত ঠেকাতে উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ও। সবগুলোই তালগাছ প্রকল্পের মতো।
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই প্রকল্প হাতে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। পাশাপাশি এসব প্রকল্প চালুর আগে ভুক্তভোগী বা যাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে তাদের সঙ্গেও কখনো বসা হয় না। তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানা হয় না। যে কারণে সব প্রকল্পের বাস্তবতা ওই তালগাছ প্রকল্পের মতোই হতে পারে বলে আশঙ্কা হচ্ছে।
বজ্রপাত পর্যবেক্ষণকারী বিশেজ্ঞদের মতামতেও কোনো সমন্বয় নেই। বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে কখনো উত্তরাঞ্চল চিহ্নিত হয়েছে, কখনো উত্তর পূর্বাঞ্চল চিহ্নিত হয়েছে। আবার কখনো মধ্যাঞ্চল। তবে নাসা ও যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যে উঠে এসেছে মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা সুনামগঞ্জ।
যেখানেই বজ্রপাতের প্রভাব থাকুক আমরা জানি একসময় প্রত্যেক কৃষকের জমির পাশে খামার নামে একটি বিশ্রামস্থল ছিল। বাড়ি থেকে অনেক দূরে চাষাবাদের জমি হলে তাদের প্রত্যেকের খামার ছিল। ঝড়-বৃষ্টি-রোদে খামারে গিয়ে অপেক্ষা করত কৃষকেরা। সেখানে ফসল তুলে রাখা হতো। দুপুরের খাওয়া এমনকি খানিকটা ঘুমিয়ে নিতো তারা। বেশি কাজ থাকলে অনেকে রাতেও খামারে থেকে যেত। সেই কৃষকদেরও গ্রীষ্ম-বর্ষা ছিল। তখনও বজ্রপাত হতো। বজ্রপাতে এই খামারবাড়িগুলোই কৃষকদের নিরাপদ রাখত। নিরাপত্তা না থাকলে শত শত বছর ধরে খামারের ধারণা টিকে থাকত না। এখন হয়ত আমাদের কাছে খামারের অর্থ বদলে গেছে। এখানেই সেই একই কথা, বেড়া দেয়া খড়-ছনের ছাউনির ওই খামার নিরাপদ থাকত চারপাশে থাকা দেশি অসংখ্য গাছপালার কারণে।
বজ্রপাত থেকে কৃষক-জেলেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য লাইটনিং অ্যারেস্টার স্থাপন আর জেলে-কৃষকদের সতর্ক করাসহ নানা পরামর্শ-প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে। এজন্য চাষের জমির কাছে ছোট ছোট টাওয়ার নির্মাণটা পুরনো খামার গড়ার মতো যৌক্তিক বলেই মনে হতে পারে। আর বজ্রপাতের মতো বিষয়টিকে মোটেও অবহেলা করা যাবে না— কৃষক-জেলেদের বোঝানো, সতর্ক করা। এজন্য ইউনিয়ন পরিষদ কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করতে পারে। কৃষকদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে উপজেলা ও ইউনিয়ন কৃষি অফিসারদের। তারাও সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করতে পারে।
মানুষের প্রাণরক্ষা মহৎ ধর্ম। যদিও ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী’। বজ্রপাত নিরোধে ব্রিটিশদের বসানো কপারদণ্ড মাটি থেকে তুলে চুরিও করেছি আমরা। নানা চুরি-চামারি, অভাবনীয় দুর্নীতি আর প্রকল্পের ধান্ধার মধ্যে আমাদের জাত চেনা যায়। এই চুরির ঠেলায় স্থানীয় তালগাছ প্রযুক্তি যেমন সফল হয়নি তেমনি নাসা থেকে শুরু করে নানা জ্ঞানীগুণীর পরামর্শও সফলতা বয়ে আনবে বলে আশা সঞ্চার করে। সবার আগে নিয়ত ঠিক করতে হবে আমাদের।