জাপানের চিঠি: ফাঁসের রাজ্যে শিক্ষা গদ্যময়!

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে সেদিন প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার ‘বাংলাদেশ ও গ্লোবাল স্টাডিজ’ প্রশ্ন দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Nov 2017, 07:30 AM
Updated : 23 Nov 2017, 11:57 AM

এতোদিন আমরা শুধু মনে করতাম, আমাদের দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুধু ওপেন সিক্রেট ‘প্রশ্নপত্র’ ফাঁস করে দায় সারছে। কিন্তু গতকাল ওই প্রশ্নপত্র দেখার পর মনে হয়েছে, তারা ‘রথ দেখার সাথে সাথে কলা বেচার’ কৌশলও বেশ রপ্ত করে বসে আছে।

ইংরেজি মাধ্যমের এই প্রশ্নপত্র দেখে যা মনে হলো (ছবি-১) তা, সত্যি অবাক করার বিষয়। আপনি যদি প্রশ্নপত্রটির প্রথম প্রশ্নটি দেখেন ‘What would happen if no the government of Mujibnagar was formed? ‘বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘যদি মুজিবনগর সরকার না গঠিত হতো, তাহলে কি ঘটতো? সেটা সরাসরি গুগল ট্রান্সলেটর দিচ্ছে (প্রথম ছবি-১) What would happen if the government of Mujibnagar was formed?

প্রশ্নকর্তা বাংলা থেকে ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করতে গিয়ে গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিয়েছেন। যদিও গুগল ট্রান্সলেটর no শব্দটি দেয়নি, আর সেটা প্রশ্নকর্তা ম্যানুয়ালি যোগ করেছেন। ইংরেজি গ্রামারের শাসন না মেনে তারা গুগলজ্ঞান ব্যবহার করে সত্যিই প্রযুক্তির সেবক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।

আর একটি প্রশ্নটি ছিল ‘সিলেটে প্রচুর চা উৎপন্ন হয়, কারণ ভূমি...’ সেটাও গুগল সরাসরি ট্রান্সলেট করেছে (ছবি-৩) Tea grows plenty in Sylhet because land is..

এতো গেল প্রশ্ন করার নমুনা। কিন্তু এর উত্তরগুলো আরও মজার। বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্নের জন্য এই শিশুরা কতোটা মানসিকভাবে প্রস্তুত, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের দুই সহকর্মী সাজিয়া ও নাফিয়া যে সচিত্র প্রতিবেদনগুলো করেছেন, তা দেখে সত্যিই অবাক হয়ে গেছি। একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁসের উৎসব চলছে, এরপরও আমাদের মহান দায়িত্বপ্রাপ্তরা অপ্রাপ্তই রয়ে গেছেন। তাদের মুখে রা-ও নেই। কারণ, তারা জানে, কীভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়। কীভাবে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

সর্বশেষ দেখলাম, যেসব ছেলেরা প্রশ্নপত্র পাচ্ছে, তারা টাকার বিনিময়েও নয়, অনেকটা ফ্রি বিলি করে আত্মার শান্তি আনছে। কি শান্তি রে বাবা! 

আগে আমরা পড়াশোনার জন্য পরীক্ষার সময় রাত জাগতাম, এখন প্রশ্নপত্র পাওয়ার নেশায় আমাদের নতুন প্রজন্মরা রাত জাগছে। আমাদের সম্মানিত অভিভাবকরাও সন্তানদের ওই ফাঁসকৃত প্রশ্ন পাইয়ে দেওয়ার মিছিলে যোগ দিয়েছেন বেশ শক্ত করেই। কারণ তারা তো চান তাদের সন্তান জিপিএ-৫ ধরিয়ে দিক। তারা গল্প করতে চান পাশের ফ্লাটের প্রতিবেশীর সাথে যে তাদের সন্তান কতো ভাল ফলাফল করেছে।

এমন একটি রাজ্যে আমাদের বসবাস যেখানে ‘নৈতিকতার স্থলন’ জেঁকে বসেছে। প্রতিযোগিতা চলছে অনৈতিক স্বপ্নের। জ্বলছে আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন। 

দেশে তো কথায় কথায় অনেক দেশপ্রেমিক হাজির হয়। রাস্তা দখল করা হয়। মিটি- স্লোগানে নেমে পড়েন। বাম-ডানের হিসেব কষে রাস্তাগুলো এক সময় সরব ছিল। কিন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁসের অজুহাতে রাস্তায় স্লোগান নূয়ে পড়ার মতোই। কেউ আর কথা বলতে চায় না। অনেকে ধরে নিয়েছেন, এটা তো হবেই। কি আর করার আছে। হচ্ছে হতে দিন।

প্রশ্নফাঁসের ইতিহাস গত ছয়-সাত বছর ধরে নিয়মতান্ত্রিক হয়ে পড়লেও আমাদের শাসনকর্তারা বেশ আরাম-আয়েশেই দিন পার করছে। আর করবেই না কেন? আপনি কি জোর গলায় বলতে পারবেন, আমাদের দেশের আমলা, মন্ত্রী, সাংসদ এমনকি জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সন্তানরা কোথায় পড়াশোনা করে? কেন করে?

তাদের সন্তানরা তো আর অস্বাস্থ্যকর প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিচ্ছে না। এইসব অখাদ্য-কুখাদ্য প্রশ্নপত্রে আমাদের মতো চাষি-তাঁতী, নিম্ন-মধ্যবিত্তদের সন্তানরা পরীক্ষা দেয়। তাদের জন্য দরদ কোথায় জনপ্রতিনিধিদের?

দেখুন না ওমুক মন্ত্রীর তমুক সন্তান আমেরিকা, ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। সেখানে পড়া শেষ করে এই আপনাদের প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রজন্মের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে ফের জনপ্রতিনিধি হবে। দেশ চালাবে। 

এই তো ওমুক আমলার ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করছে, তাদেরও তো পরীক্ষা হচ্ছে। এক যোগে সারা বিশ্বে হচ্ছে সেইসব পরীক্ষা। কই, তাদের তো কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে না। তাদের তো আর পরীক্ষার আগের রাতে ইন্টারনেটে ঘুর ঘুর করতে হয় না। কারণ, তারা জানে, এই জাতির গোঁড়ায় গলদ।

আজ আপনারা যারা সন্তাদের প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে কথা বলছেন না, আপনারা যারা সরকারকে বাধ্য করছেন না এটা রোধ করতে, মনে রাখবেন, এইসব সন্তানই আপনাদের জন্য বোঝার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এদের না থাকবে মস্তিষ্ক, না থাকবে বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা। তখন আপনাদের ওই দুই-তিনটি জিপিএ-৫ সনদ বাদাম বেচার ঠোঙ্গা হয়ে যাবে। এতোকিছু হওয়ার পরও যখন আমাদের শিক্ষামন্ত্রী বহাল তবিয়তে তাবেদারি করছেন, তখন মনে রাখাই শ্রেয়- এই জাতি রক্ষা পাওয়ার নয়। টেলিভিশন ফুটেজে প্রশ্নপত্র ফাঁসের হরিখেলা চললেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী ‘চুপচাপ’ থাকছেন। এটা সত্যিই লজ্জার! যে বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখতেন, তার হাল ধরে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন আপনি। অথচ এই শিক্ষার সর্বনাশ আপনার সকল অর্জনকে যে ম্লান করার উপক্রম করছে, তা কী আপনি দেখছেন না?

অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী আর প্রধানমন্ত্রীর দোষ দিয়ে লাভ কী, যে দেশে দুর্নীতির বাজার রমরমা, সেই দেশ দরিদ্রতার শিকার হবে- এটাই স্বাভাবিক। যে শিক্ষকরা ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছেন, বা পাবেন, তাদের নৈতিকতার দণ্ড কতোটা মজবুত, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। এটা আজকের নয়। ২০০০ সালের পর থেকে স্কুলগুলোতে যেসব শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন, তার সিংহভাগই উৎকোচ দিয়ে। যারা শিক্ষা গ্রহণে নৈতিকতার আশ্রয় চেয়েছিলো, তারা তার শিকার। স্কুল, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব জায়গার চিত্র একই। 

যে জাতি শিক্ষার আলোয় উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে পারে না, তাদের কপালে যে ক্ষুধা-দারিদ্রতা লেগে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।

আমি ভেবে পাই না, কেন আমরা প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করতে পারি না? প্রযুক্তির গলা কাটলেও আমাদেরও প্রযুক্তিকে রোধ করার সাহস থাকা জরুরি। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করতে হলে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করা যেতে পারে। ধরুন, যেসব প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, তার সিংহভাগই অবজেকটিভ প্রশ্ন। পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগেও যদি প্রশ্ন বের হয়, তাহলেও সেটা ঠেকানো কঠিন। কারণ, এ ধরনের প্রশ্নে সহজে কম সময়ে উত্তর করা সম্ভব। তাই পাবলিক পরীক্ষাগুলো থেকে আপাতত এ ধরনের প্রশ্ন তুলে দেওয়ার চিন্তা করা যেতে পারে।

মাইক্রোসফট ওয়ার্ড সফটওয়ারে আগে থেকেই একটি সিস্টেম চালু আছে, তা হলো ফাইল এনক্রেপ্ট সিস্টেম। আপনি যখন প্রশ্নপত্র ছাপাবেন, তখন সেটা পাসওয়ার্ড দিতে পারেন। তা নির্দিষ্ট ব্যক্তি মাত্রই ওপেন করতে পারবেন। এই ক্ষেত্রে বাইনারি পাসওয়ার্ড চালু করা যেতে পারে। যা দিয়ে আপনি স্থানীয় পর্যায়ে প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারবেন। এমনকি পরীক্ষার হলেও করতে পারবেন।

সবচেয়ে বড় কথা, এতো পাবলিক পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা কী? চারটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে যেসব স্কুলগুলোতে যে হল করা হয়, সেখানে ক্লাসে বিঘ্ন ঘটিয়ে শিক্ষার কী উন্নয়ন হচ্ছে?

সারা বিশ্বে স্বীকৃত পরীক্ষা হিসেবে জুনিয়র (এসএসসি) ও সিনিয়র (এইচএসসি) সার্টিফিকেট পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেখানে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার সুযোগ থাকে। কিন্ত আমাদের দেশে কোমলমতিদের জেএসসি, পিএসসিতে বসিয়ে শিক্ষায় কতটা লাভ হচ্ছে, বলবেন কি?

যাদের হৃদয় নরম, যাদের চারিত্রিক বিষয় গঠন করার সময়, সেখানে আমরা যে নোংরামি ঢুকিয়ে দিচ্ছি, তা তাদের ভবিষৎ জীবনে প্রভাবিত করবে। এমন অনৈতিক পরিবেশ সন্তানদের বেড়ে তুলে অভিভাবকরা কতটা নিরাপদ শুনি? যারা অফিসে ঘুষের স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলে নিজেদের অনৈতিক করেছেন, তারাই আবার সন্তাদের প্রশ্নপত্র ফাঁসে উৎসাহী করে তুলছেন।

থামুন। প্লিজ থামুন। আর সহ্য করতে পারছি না। চোখের সামনে মেধাবীদের আত্মহত্যা আর জাতির স্বপ্নকে ভূলুণ্ঠিত করার কোনও অধিকার আপনার নেই। আপনি ক্ষমতায় আছেন আজ, কাল থাকবেন না। কিন্ত এই ছেলেমেয়েরা এক সময় ক্ষমতায় আসবে, তখন আপনারই নাতি-পুতিরা ভুগবে।

আপনারা আজ ক্ষমতার বলয়ে সবকিছু ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু আমরা পারি না। আমরা এই দেশটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি। আমরা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে বাংলাদেশ হিসেবে পরিচয় করার লড়াইয়ে সদা প্রস্তত থাকি। আপনাদের মাতলামির খেসারত দিতে আমরা রাজি নই।

আপনারা যা ক্ষতি করেছেন, তা পুষিয়ে আনতে আমাদের যুগের পর যুগ অপেক্ষা করতে হবে। হয়তো প্রজন্মের পর প্রজন্ম। তাই শিক্ষাটাকে বাঁচান। ফাঁসের রাজ্যে শিক্ষাকে গদ্যময় করে তুলবেন না প্লিজ।

লেখক:

 এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান প্রতিনিধি

ইমেইল: nadim.ru@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!