কিন্তু পারি না, শত কষ্টের মধ্যেও গবেষণায় এক ধরনের নেশা লাগতে শুরু করেছে। সপ্তাহে যে একদিন ছুটি পাই, সেদিন ল্যাবে না গেলেও মনের ভেতর কেমন জানি খুঁত খুঁত লাগতো। আর স্বভাবত এইভাবে ভিনদেশে কয়েক বছর পার করেছি।
মাঝে মধ্যে ল্যাবমেটরা বলতো, নাদিম তুমি জাপানে কোথায় কোথায় ঘুরছো? পরিচিত কিছু জায়গার নাম সাজেস্ট করো? তখন অভিজ্ঞতার ঝুঁড়িতে জমা হওয়া তিন-চারটি জায়গা ব্যতিত আর কিছু বলতে পারি না।
কারণ একটাই, এই যন্ত্র-জাতির কবলে পড়ে কখন যে নিজের ভেতর রোবট তৈরি করে ফেলছি, তা জানি না। মাঝে মধ্যে মনে হতো আমি আবেগ-অনুভূতিহীন জড়মানব। আবার পরক্ষণে মনে হতো, দেশে থাকতে আমি তো অনেক ঘুরতে পছন্দ করতাম। আড্ডাবাজি না হলে চলতোই না। কিন্তু জাপানে আসার পর কেন এই পরিবর্তন?
হয়তো পরিবর্তন হয়নি, কিন্তু পরিবেশের উষ্ণতায় আমাকে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছে। গবেষণায় যে ধকল সহ্য করতে হচ্ছে, তা মূলত কিছু হারানোর ফসল। আর এই হারানো মূল্যবান সম্পদটাই হলো- প্রিয়জন আর বন্ধুদের সঙ্গ ত্যাগ, দূরত্ব আর বাস্তবতার সূতোয় গাঁথা জীবনের ছন্দটাও তাই অদ্ভুত হয়ে উঠছে।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে কোথায় ঘুরতে বের হতে ইচ্ছে করে, কিন্তু নিসঙ্গতার অজুহাতে তাও হয় না। আমার একটা বদ অভ্যাস হলো, আমি কখনো একা একা ঘুরাঘুরি পছন্দ করি না। বন্ধুদের নিয়ে হৈ চৈ করে ঘুরে বেড়ানোর যে মজা, তা একার মধ্যে খুঁজে পাই না।
তাছাড়া এখানে যারা পড়তে এসেছে, তাদের প্রায় সবারই পরিবার রয়েছে। অনেক সময় তাদের সাথে ঘুরতে যাওয়াটাও ব্যক্তি স্বাধীনতার হরণ বলেই মনে হতো। তাই স্বাদ থাকলেও সাধ্যের কোঠায় আপাতত শূন্যের ঘরে গিয়ে ঠেকেছিল।
যাই হোক, অবশেষে আমার হতাশা আর দুর্দশার সুমতি হলো। গত এপ্রিলে বাংলাদেশ থেকে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বাঙালি, আর অক্টোবরে এসেছিল আরও একজন। আমাদের ব্যাচেলারদের পাল্লা একটু ভারি হয়ে গেল।
গত ৩ মে থেকে জাপানে ‘স্বর্ণ সপ্তাহ’ উপলক্ষে ছুটি শুরু হয়েছিল। তিন দিনের সরকারি ছুটিতে এই দেশে এখন পুরোই উৎসবমুখর। সরকারি হিসেব আর জাপানিদের ঐতিহ্য অনুযায়ী এপ্রিলের শেষ আর মে মাসের প্রথম সপ্তাহের কিছু অংশ নিয়ে ‘গোল্ডেন উইক’ বা স্বর্ণ সপ্তাহ।
তবে মজার বিষয় হলো, এই তিনদিন ছুটির মধ্যে প্রথম দিনটি অথাৎ ৩ মে ‘সংবিধান দিবস বা কেনপো কিনেবি’, দ্বিতীয় দিন সম্রাট সোয়ার জন্মদিন উপলক্ষে ‘চিরসবুজ দিবস’ বা ‘মিদরি নোহি’। আর তৃতীয় দিন অথাৎ ৫ মে কেবলই ছোটদের জন্য ‘শিশুদের দিন’ বা ‘কোদমোনোহি’ নামে বরাদ্দ হয়েছে।
তাই আমরাও এই ছুটিকে আর হাতছাড়া করতে চাইনি। সাত সদস্যের একটি ব্যাচেলার দল পেয়ে গেলাম এবার ঘোরাঘুরিতে। সবার সাথে পর্যালোচনা শেষে স্পট হিসেবে নির্বাচন করলাম, ওসাকা প্রদেশের নিকটবর্তী হিয়েগো প্রদেশের বন্দর নগরী কোবেতে।
আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র কুঁড়ি কিলোমিটারের পথ, এরপরও একসাথে ভ্রমণ করার মজাই আলাদা। এককালের রাজধানী কোবেতে মূলত তিনটি পর্যটনকেন্দ্র আমরা নির্বাচন করলাম। এক- কোবে অ্যাকুরিয়াম বা সুমা কিনেন কোয়েন পার্ক, দুই- নৌ বন্দর বা হার্বারল্যান্ড আর তিন- নোনোবিকি রোপওয়ে হার্ব গার্ডেন।
মিশন কোবে অ্যাকুরিয়াম
যদিও সবাই বিভিন্ন জায়গায় থাকলেও কথা মতো সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে ট্রেন স্টেশনে পৌঁছলাম। ট্রেন ছাড়লো কোবের দিকে। আমার প্রথম গন্তব্যস্থল হলো- সুমা কিনেন কোয়েন বা কোবে অ্যাকুরিয়াম।
ট্রেনে এক ঘণ্টার কিছু সময় চলার পর বেলা সোয়া ১২টার দিকে আমরা অ্যাকুরিয়ামে পৌঁছলাম। টিকিট সংগ্রহের পর ভেতরে ঢুকেই দেখা মেলে নানা প্রজাতির তিমির বার বড় বড় মাছের। যদিও মাছগুলোর নাম আমাদের কাছে অজানা। তবে কাঁচের মধ্যে বড় চৌবাচ্চায় দূর থেকে দেখতে সমুদ্রের অতলে মৎসারোহী কিংবা ডুবুরি মনে হলো।
অদূরে সামুদ্রিক মাছের মিছিল। হরেক প্রজাতির মাছ, বড় বড় কাছের ঘরে দৌড়াদৌড়ি করছে। সামুদ্রিক উদ্ভিদের ভিতর সাঁতার কাটতে থাকা ঝাঁকে ঝাঁকে রঙ-বেরঙের ছোট ছোট মাছগুলো যেন নৃত্য করছে।
যাই হোক, সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রাণীর উপস্থিতিতে এক ঘণ্টা মনে হয় পানির নিচে নিজের উপস্থিতি টের পাওয়া গিয়েছিল। আলো-আঁধারের খেলায় এই পর্যটন কেন্দ্রের ভেতর সত্যিই অপূর্ব ছিল!
পেঙ্গুইনদের সাঁতার আর বুনো হাঁসের ডিগবাজি নজরকাড়া। সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল ডলফিনের নৃত্য। গানের তালে তালে ডলফিনের নাচানাচি শিশু-বৃদ্ধ কিংবা যুবাদের প্রিয়, তা সেখানকার মানুষদের উৎসাহ দেখলেই বোঝা যায়। ডলফিনের পিঠে চড়ে নির্দেশকের শূন্য পানিতে ভেসে ওঠা অবাক করার মতো বিষয় ছিল।
সমুদ্রের পাদদেশে এই অ্যাকুরিয়ামটি হওয়ায় দর্শনার্থীরা সেখানকার বীচে হাঁটাহাঁটি করতে পারে। কেউ কেউ গোসল করছে।
ঘড়ির কাঁটায় যখন দুপুর ২টা ২০ মিনিট, তখন আমরা লাঞ্চের জন্য প্রস্তুতি নেই। জাপানে যেহেতু রেস্তোরাঁগুলো আমাদের জন্য উপযুক্ত নয়, তাই আমরা আগেরদিনই কিছু খাবার ভাগাভাগি করে তৈরি করে ফেলি। কেউ খিঁচুড়ি, কেউ ডিম ভুনা, বেগুন ভাজি আর খাসির মাংস দিয়ে দুপুরে খাবার সেরে বের হলাম হার্বারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে।
বন্দরে গড়ে উঠা আধুনিক শপিং কেন্দ্র
হার্বারল্যান্ড মূলত জাপানের বন্দর নগরী কোবের প্রধান শপিং কেন্দ্রে। বিশ্বের নামিদামি সকল ব্র্যান্ডই এখানে পাওয়া যায়। কোবে স্টেশন থেকে নামার পরই এক মিনিট হাঁটলে পাওয়া যায় এটি। শুধু তাই নয়, মেয়েদের বিভিন্ন ধরনের ম্যাচিং জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে রাখার দৃশ্য কেবল কোবের এই হার্বারল্যান্ডে।
হার্বারল্যান্ডে মূলত গড়ে উঠেছে কোবের নৌ-বন্দরকে কেন্দ্র করে। জাহাজের জেটি কিছু দূরে থাকলেও পর্যটকদের জন্য এটি অনেকটাই অস্ট্রেলিয়ার সিডনির অপেরার মতোই। ঠিক এই অপেরার মতো করে গড়ে তোলা হয়েছে নৌ-মিউজিয়াম। একটি লম্বা টাওয়ারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু হোটেল-রেস্তোরাঁ আর শপিং কেন্দ্র।
‘হুহুল’ বা নাগরদোলায় চড়ে বাচ্চা কিংবা তরুণ-তরুণীরা হৈ-হুল্লোর করছে। আর বন্দরে ভেড়ানো বিভিন্ন ধরনের প্রমোদতরীতে দর্শনার্থীরা চড়ে ঘুরতে বের হচ্ছে সমুদ্র। যদিও এক কিংবা দেড় ঘণ্টার এই ঘুরাঘুরিতে সমুদ্রের গভীরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তবে ছোট ছোট নৌযানে ঘুরতে বেড়ানোর যে আনন্দ, তা বোঝানো কঠিন!
রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে সুনীলের দমকা বাতাস যেন চুলগুলো আউলা-ঝাউলা করে দিচ্ছে। নিমেষে সূর্যের আলো সমুদ্রের জলে যে তরঙ্গরেখা আঁকছে তা ক্যামেরাবন্দিতে ব্যস্ত জাপানি সহযাত্রীরা। আমরা তখন ব্যস্ত সেলফিবাজী কিংবা গ্রুপফি তুলতে।
বন্দরের কাছে গড়ে উঠেছে কোবে বিমান বন্দর। সমুদ্রের ঠিক কোল ঘেঁষে জাপানি এই বিমানবন্দরে অনায়াসে বিমানের ওঠানামার দৃশ্য ছিল নজরকাড়া। সব মিলিয়ে ক্ষণিকের সমুদ্র বিলাস হয়ে উঠেছিল মধুময়। আর তাছাড়া পাহাড়ের হাতছানি দিয়ে গড়ে ওঠা আধুনিক নগরীর সুউচ্চ অট্টালিকার প্রতিচ্ছ্ববি হার্বারল্যান্ডের বন্দরের জলে আছড়ে পড়ছিল।
রোপওয়েতে হার্ব-গার্ডেন
হার্বারল্যান্ডে দুরন্তপনা শেষে সন্ধ্যার কিছু আগে বের হলাম নানোবিকি হার্ব গার্ডেন দেখতে। হার্বালল্যান্ডে সাননোমিয়া স্টেশন থেকে বেশ কিছু স্টেশন পাড়ি দিয়ে শিন-কোবের লাইন ধরে যেতে হয় হার্ব গার্ডেনে। সুউচ্চ পর্বতে গড়ে তোলা রোপওয়েতে ঝুলে পড়া যন্ত্রে যেতে হয়। প্রায় বিশ মিনিট ইলেকট্রিক এই যন্ত্রে পাহাড়ের চূঁড়ায় ভেসে বেড়ানো সত্যি অনেক দারুণ ছিলো। দড়িতে ঝুলে নিচে তাকাতে মনে হচ্ছিলো, আমরা পাখির পাখায় ভেসে বেড়াচ্ছি।
সন্ধ্যার দিকে এখানে দর্শনার্থীরা ভিড় জমায় সবচেয়ে বেশি। কারণ এই পাহাড়ের চূঁড়া থেকে কোবে শহরের প্যানারোমিক দৃশ্য অন্যরকম অনুভূতি এনে দেয়। সমুদ্রের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা নগরীর বাতিগুলো মোমবাতিতে নিস্তব্ধ প্রতিবাদ কিংবা শোকের আলোর মিছিল বলেই মনে হচ্ছিল। ভবনগুলো ছিল আলোর ফোয়ারা।
সব কিছু মিলিয়ে, আমার কাছে এই জায়গাটি অন্যতম প্রিয় বলেই স্মৃতির পাতায় লেখা হয় গেছে। যদিও বাসায় ফিরতে একটুও ইচ্ছে করছিল না, তারপরও নিয়মের শেকলে পড়ে ফিরতে হলো বাড়িতে। আনন্দ পসরা সাজানো স্বর্ণ সপ্তাহের ঘোরাঘুরি এই যন্ত্রজাতির ব্যতি-ব্যস্ততার কিছুটা হলেও জ্বালানি হিসেবে কাজ বলেই মনে হচ্ছে।
এই রকম দল-বল নিয়ে বাঙালিদের আড্ডাবাজী খুব কম হয়। তারপরও ব্যাচেলারদের একত্রিত ঝটিকা ভ্রমণ প্রশান্তির বাতাস করেই ফুসফুসে ঢুকিয়েছি। আরও ঘুরতে চাই, আরও দেখতে চাই। প্রকৃতির রূপলীলা দেখে চোখ বন্ধ হোক, এমন প্রার্থনা সৃষ্টিকর্তার প্রতি রইলো।
লেখক: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জাপান প্রতিনিধি
ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক
ইমেইল: nadim.ru@gmail.com
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |