জাপানের চিঠি: বাঙালি খাবারে রক্তাভ জাপানিরা

মার্চ মাসে জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ডিগ্রি গ্রহণের উৎসব চলে। এই মাসে সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই স্নাতক, স্নাতকোত্তর আর ডক্টরেট ডিগ্রির কোর্স সম্পন্ন করেন শিক্ষার্থীরা।

এস এম নাদিম মাহমুদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2017, 12:35 PM
Updated : 17 March 2017, 12:26 PM

জাপানের পাঠ্য নিয়মানুযায়ী বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের অনার্স তৃতীয় বর্ষ শেষ হওয়ার পর চতুর্থ বর্ষ থেকেই গবেষণাগারে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। এখান থেকেই স্নাতক, স্নাতকোত্তর করে ফেলে। বলতে গেলে জাপানি শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় বাড়ি হলো তাদের গবেষণাগার।

এবার আমার ল্যাবরেটরি থেকে তিন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীসহ এক ডক্টরেট শিক্ষার্থী গবেষণাগারের পাট চুকিয়ে বিদায় নিচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে যোগ দিবেন। দীর্ঘ ৩ থেকে ৫ বছর টানা ল্যাবে থাকার পর বিদায় নেয়ার মুহূর্তগুলো কেমন বিষণ্ণতায় ভরে উঠে।   

তাই গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে হঠাৎ করে আমার এক ইন্দোনেশিয়ার সহপাঠী প্রস্তাব দিলো যে, এবার আমরা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা জাপানি শিক্ষার্থীদের জন্য ফেয়ারওয়েল বা বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।

সেখানে স্বীয় দেশের খাবার পরিবেশন করা হবে। তার আইডিয়াটা মন্দ হয় না। দীর্ঘদিন সহপাঠী থাকার সময় অনেকেই তো আমাকে বাঙালি খাবারের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছে।

বাংলাদেশি খাবার দেখতে কেমন হয়? স্বাদ কেমন? স্পাইসি খাবার তোমরা কেমন করে খাও? ভারত আর বাংলাদেশের খাওয়ার মধ্যে পার্থক্য কেমন?- ইত্যাদি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে।

কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর কেবল আমার মৌখিক বর্ণনার মধ্যেই থেকে গেছে। বর্ণনা শোনায় সময় লক্ষ্য করতাম জাপানিদের চোখেমুখে বাঙালি খাবার যে খুব তৃপ্তির হবে- এরকম একটা ভাব ফুটে উঠতো। তাই এ সুযোগটি কাজে লাগাতে চাইলাম।

গেল শুক্রবার সন্ধ্যায় আয়োজন ছিল এই বিদায় অনুষ্ঠানের। আমি এবার সিদ্ধান্ত নিলাম, জাপানিদের বাঙালিদের চিরচেনা খাবারগুলো পরিবেশন করতে।

যে খাবারগুলো কৃষক, তাঁতী থেকে শুরু করে উপরতলার মানুষগুলোও খান সেগুলোই নির্বাচন করলাম। অনুষ্ঠানের আগের দিন বৃহস্পতিবার ল্যাব থেকে ফিরলাম সন্ধ্যায় এরপর সুপারশপে বাজার সেরে রান্না করতে শুরু করলাম।

খাবারের মেন্যুতে রাখলাম- আলুভর্তা, ডাল, বেগুন ভাজি আর ডিম ভুনা। আর সেই সাথে বানালাম রসগোল্লা।

দেশে থাকতে কোনো খাবার রান্না করার অভিজ্ঞতা ছিল না। এমনকি রসগোল্লা তৈরি করার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। যাহোক মধ্য রাত অবধি পর্যন্ত চললো রান্না করার পালা।

পরেরদিন অনুষ্ঠান শুরুর আগে ল্যাবে গিয়ে বাসমতি চালের ভাত রান্না করলাম। হয়ে গেলে বাঙালিদের চিরচেনা খাবার।

সন্ধ্যা ৭টায় সেমিনার কক্ষে শুরু হলো অনুষ্ঠান। জাপানি সহপাঠীদের নিয়ে এর আগে অনেক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি কিন্তু এ অনুষ্ঠানটি যেমন অন্যরকম অনুভুতি দিয়েছিল যা অন্য কোনও অনুষ্ঠানে পাইনি।

খাবার শুরুর আগে থেকে জাপানিরা খাবার দেখে একের পর এক প্রশ্ন শুরু করেছিল। আমি কীভাবে কোন কোন উপাদান দিয়ে রান্না করেছি তার বিস্তারিত বর্ণনা করতে হয়েছে।

জাপানিদের যেহেতু মরিচের প্রতি ভয়ানক এলার্জি রয়েছে তাই আমার খাবারগুলোতে মরিচ দেইনি। শুধু ডিম ভুনায় এক চিমটি পিপার ছিটিয়ে দিয়েছিলাম।

যাই হোক এক জাপানি সহপাঠি জিজ্ঞাসা করলো, আচ্ছা নাদিম তোমার দেশে তোমরা কি হাসি (চপস্টিক) কিংবা স্পুন (চামচ) ব্যবহার করো?

তখন আমি বললাম, না আমরা এইসব কিছুই করি না। ডানহাত দিয়ে সব খেয়ে ফেলি। আর হাত দিয়ে খাবার মাঝে এক ধরনের তৃপ্তিবোধও কাজ করে। আমার কথা শুনে সে তো অবাক হয়ে গেছে।

আমি বললাম, আজ যে রান্না হয়েছে তা জন্য হাত ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু তোমরা খেতে পারবা না বলে সন্দেহ হচ্ছে। তাই তোমরা চপস্টিক ব্যবহার করতে পারো।

জাপানিদের পার্টিতে খাওয়ার ধর্ম হচ্ছে এরা আস্তে আস্তে খায়। খাওয়ার সাথে গল্প করে। আর গল্প করতে করতে খাবার শেষ করে। এদের বড় ধর্ম হলো এরা খাবার কখনো নষ্ট করে না। যতক্ষণ খাবার আছে ততক্ষণ পার্টিও সমান্তারাল গতিতে চলে। এর ব্যতিক্রম হয়নি সেদিনও।

আলুর্ভতা জাপানিরা খুব পছন্দ করলো। সেই সাথে ডিম ভুনা আর বেগুনভাজিও। আধাঘণ্টা খাওয়ার পর আমি এদের চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। চেহারা এতোটাই লাল হয়ে গেছে, যা বর্ণনা করা মুশকিল। আলুভর্তায় সরিষা তেল দিয়েছিলাম। ঝাঁঝের কারণে সহপাঠীরা ওটাকেই 'স্পাইসি' বলে নাম দিলো। কিন্তু খাওয়া চললো।

ডিম ভুনা খেয়ে বললো, আমরা তো ডিম খেয়েছি, কিন্তু ‍এটার স্বাদ যেন অন্য রকম ছিল। 'হট' 'হট' 'হট'- বলে চিৎকার শুরু করলো। বাসমতি চালের সুগন্ধে পুরো ঘর ভরেছিলো।

জাপানিরা সাধারণত 'স্টিকি' চালের ভাত খায়, যা একটু আঠালো ধরনের। আর বাসমতি চালের ঝরঝরে ভাতে ওদের কৌতুহলটা অন্যরকম ছিল। এই চাল কীভাবে তৈরি হয় তার আদ্যোপান্ত তুলে ধরতে হলো।

আমার অধ্যাপক খাওয়ার পর বলেই বসলেন, "ইউ উইল বি এ গুড হ্যাসব্যান্ড। তোমাদের খাবারের স্বাদটা অন্যরকম, যা আর কোথাও নেই।"

খাওয়ার মাঝেই শুরু হলো মিমিক বা মুখ ভেঙচানো প্রতিযোগিতা। ল্যাবের অধ্যাপক থেকে শুরু করে সেক্রেটারি পর্যন্ত সবার আচার-আচরণ নিয়ে মুকাভিনয় যেন অনুষ্ঠানে ভিন্নমাত্রা আনলো। এতো অনুষ্ঠানে করেছি কিন্তু সেদিনের মজাটা অন্যরকম ছিল।

যাদের গত দুই বছর শান্ত বালক-বালিকা হিসেবে জেনেছি সেদিন তাদের কৌতুক ও মশকরা দেখে সেদিন অবাকই হয়েছি।

অধ্যাপকের গুরুচণ্ডালি দোষগুলো তুলে ধরে হাস্যরসে পুরো ঘরটা গম গম করছিলো, মনে হচ্ছিলো কোন অডিটোরিয়ামে রয়েছি। যদিও আমার একটি মুদ্রাদোষও তারা ধরেছে সেদিন।

আর তা হলো- ল্যাবের সেমিনারগুলোতে কথায় কথায় 'আই হ্যাভ এ কোয়েশ্চিন' বলার ব্যাপারটি!

সর্বশেষ ছিল বিংগো খেলা। কল নম্বর অনুযায়ী সংগৃহীত কাগজে নম্বর কাটার খেলার নামই- বিংগো। ছিল পুরস্কার।

যারা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হয়েছিল তারা পুরস্কার রাখা টেবিল থেকে ইচ্ছেমত পুরস্কার পছন্দ করতে পারতো। মজার এই খেলা বিদায় অনুষ্ঠানকে আরো মধুর করে তুলেছিল। রাত সাড়ে ১০টার দিকে অনুষ্ঠান সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

যাদের সাথে দীর্ঘদিন ছিলাম তাদের সাথে এমন আনন্দের দিন আর ফিরে আসবে কী! - ভেবে কষ্ট লাগছে। তাদের হাসিমাখা মুখগুলোও আর নিয়মিত দেখতে পাবো না।

নিয়মের স্রোতে তারা হয়তো হারিয়ে যাবে, নতুনরা আবার ল্যাবে আসবে কিন্তু ওই বাঙালি খাবার পরিবেশনে যে তৃপ্তি পেয়েছি তা সত্যিই স্মৃতির পাতায় অম্লান হয়ে থাকবে। আর জাপানি বন্ধুদের লাল মুখচ্ছবিগুলো হয়তো জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ফাঁকে ফাঁকে মনে পড়বে আর মুচকি হাসবো।

লেখক: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জাপান প্রতিনিধি

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক

ইমেইল: nadim.ru@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash.bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!