কে কীভাবে ভালবাসা প্রকাশ করে এটা নির্ভর করে সম্পর্কগুলোর সুড়কির উপর। যে সুড়কি দিয়ে ভালবাসার গাঁথুনি উঠে তা সাজানোর উপর নির্ভর করে ব্যক্তি, সমাজ ও দেশ বিশেষে ভালবাসা প্রকাশ পায়।
গত পনের বছরে বাংলাদেশে পশ্চিমা প্রভাবিত যে দিনটিকে সবচেয়ে জনপ্রিয় হতে দেখেছি, সেটি সম্ভবত ভ্যালেন্টাই'স ডে।
অবশ্য প্রবাসে গত আড়াই বছরে জাপানে দিবসটি উদযাপন তেমন চোখে পড়েনি। এদের ভালবাসার অভিব্যক্তি বা প্রকাশভঙ্গি কেমন সেটা জানাতে এই লেখার অবতারণা।
আমার এক জাপানি বন্ধু আছে, তার নাম কিসুকে মাসুরি। সে বিবাহিত এবং তাদের ঘরে ২ বছরের একটি ছেলেও আছে। ছেলেটি বেশ ভদ্র, নম্র এবং বন্ধুভাবাপূর্ণ।
কয়েকদিন আগে ওর সাথে দেখা হলো। ক্যাফেটেরিয়ায় কফি খাওয়ার তালে তালে আমি টুকটাক জাপানি সংস্কৃতি শেখার চেষ্টা করি।
যাই হোক ওকে একটি বিষয় জিজ্ঞাসা করবো তা কয়েকমাস ধরেই ঘুরছিল। দেশে থাকতে ব্লগে জাপানের ওই বিষয় সম্পর্কে পড়েছিলাম। তাই ওদিন সুযোগ পেয়ে প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসলাম।
কিসুকে আমার প্রশ্ন শুনে তো লজ্জায় লাল হয়ে গেল। এরপর বললো, সুরেকমি (জাপানিজ ভাষায় যাকে বলে প্রমোদ হোটেল) বিষয়ে তুমি কেন জানতে চাও? তোমার তো সেখানে যাওয়ার সময় হয়নি। তাহলে তুমি 'লাভ হোটেল' সম্পর্কে জেনে কি করবে?
আমিও কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। একটু গলা খাঁকিয়ে বললাম, আসলে সারা বিশ্বেই জাপানের 'লাভ হোটেল' বিষয়ে জানতে আগ্রহী। আমার এক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বন্ধুও কয়েকদিন আগে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল কিন্তু আমি তো তেমন কিছু জানি না। গুগল জ্ঞানেও লাভ হোটেল সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা মস্তিষ্কে ঢোকেনি তাই তোমার কাছে জানতে চাইলাম।
এইবার ও আমার আগ্রহের বিষয়টি টের পেলো। তাই কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলতে শুরু করলো।
"আসলে নাদিম, ভালবাসার হোটেল বা প্রমোদ হোটেল হলো জাপানির ‘বৈধ সেক্স বা রোমান্স’ করার জায়গা। সমগ্র জাপান জুড়েই এই হোটেলগুলো গড়ে উঠেছে। বড় বড় শহরগুলোতে তো অনেক বেশি। সব মিলিয়ে ধরো জাপানে এই ধরনের হোটেলের সংখ্যা ৩৮ থেকে ৪০ হাজারের মতো।"
কিসুকে বললো, আসলে জাপানের অধিকাংশ পরিবারই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি বা একান্নবর্তী। আমাদের বাসায় সাধারণত ২/৩ টি কক্ষ থাকে এর ভেতরই সন্তানের ঘরও, শোবার ঘর, রান্না ঘরের কাজও থাকে। তুমি তো জানো, জাপানিরা কতটা পরিশ্রম করে। সারাদিন পরিশ্রমের পর রাতে যখন বাসায় পুরুষ কিংবা নারী সঙ্গী ফিরে তখন অবসাদ কাজ করে। অধিকাংশ বিবাহিত পুরুষ বা নারী যৌনকাজে ইচ্ছা থাকে না। আবার একই ঘরে এক অনেকদিন থাকার পর কিছুটা একঘেঁয়েমিও কাজ করে। আর তা থেকে রিফ্রেসনেস পেতে ‘লাভ হোটেল’ সম্পর্ক তড়িৎ গতিতে এগিয়ে গিয়েছে।
সাধারণত তুমি ৪/৫ হাজার জাপানি মুদ্রায় একটি হোটেলে ২/৩ ঘণ্টা থাকতে পারবে। আর রাতে থাকতে চাইলে রেন্টটা তিনগুণ পড়ে যায়।
কিসুকের কথায় আমি যতটুকু বুঝলাম, তাতে মনে হলো দম্পতি জীবনে একঘেঁয়েমি আর নিরানন্দ কাটাতে কিছুটা রোমান্টিক মূহুর্ত উপভোগের আশ্রয়স্থল হলো লাভ হোটেল।
কিসুকে বললো, আমি ও আমার স্ত্রী বলতে গেলে মাসে একবার লাভ হোটেল ঘুরে আসি। যখন কাজের চাপে জীবন ওষ্ঠাগত তখনই এই হোটেলে স্ত্রীর সাথে আবেগঘন মুহুর্ত কাটানোর যে তৃপ্তি তা পরবর্তী সময়গুলোতে রিফ্রেস করে দেয়।
আমি তার কথা মনোযোগ সহকারে শুনছি। কিসুকে এবার বললো, আসলে জাপানে সবকিছু দুমূর্ল্য। এই ঘরগুলোতে যেভাবে সাজানো জিনিসপত্র পাবে তা আমাদের ক্রয় করতে অনেক খরচ হয়ে যাবে। যা কখনো সম্ভব নয়। লাভ হোটেলগুলোতে তুমি ড্রেস পাবে। মডেলদের গায়ে যেসব সুন্দর সুন্দর দামি কাপড় থাকে সেখানেও ক্যাটালগে তুমি কাপড়গুলো দেখতে পাবে। সেই অনুযায়ী ডায়ারগুলোর বোতামে চাপলে চলে আসবে। বলতে গেলে, স্বল্প সময়ে রোমান্টিক অনুষঙ্গ দিয়ে পরিপূর্ণ।
ধরো, তোমার শাওয়ার নেয়া লাগবে। বাথটাব এমনভাবে করা যে তোমার দেখলেই মনে এক ধরনের অনূভূতি তৈরি করে দেবে। এই কক্ষগুলো এতোটাই জাঁক-জমকপূর্ণ যে সঙ্গী বা প্রেমিকার ভালবাসা কিংবা আবেগের টইটম্বুর হতে সময় লাগবে না।
কিসুকু মাসুরির কথা শুনে কল্পলোকে ভেসে যাচ্ছি। এমন রোমাণ্টিক জায়গাটিকে'লাভ হোটেল' বলবে না তো কী বলবে? ওর নিখুঁত বর্ণনায় প্রমোদ হোটেলের বিস্তর চিত্র ফুঠে উঠলেও এইবার ও জানালো একটু ভিন্ন তথ্য।
লাভ হোটেল কোন স্বামী-স্ত্রী ভেদে নয়, যে কেউ গিয়ে উঠতে পারে। বলতে গেলে জাপানে প্রেমিক-প্রেমিকাদের একান্ত সময় কাটানোর জন্য উন্মুক্ত বৈধ আশ্রয়স্থল হলো লাভ হোটেল।
কিসুকে বললো, আসলে এই লাভ হোটেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই চালু হয়েছে। তুমি তো ওসাকা ক্যাসেল দেখেছো তাই না?
আমি বললাম, হ্যাঁ দেখেছি। এই ক্যাসেলের আশে-পাশেই পঞ্চাশের দশকে সুরেকমি বা প্রমোদ হোটেল গড়ে উঠে। প্রথমে সমাজের উচুস্তরের মানুষ গেলেও পরবর্তীতে সময়গুলোতে তা সবার জন্য উন্মুক্ত হয়।
'ভ্যালেন্টাইনস ডে'-তে লাভ হোটেলগুলোতে বিশেষ বিশেষ সুবিধা দেয়। তুমি ইচ্ছে করলেও মনের মতো করে খাবারও সেখানে পেত পারো।
এই দিনে শুধু বিবাহিতরাই নয়, প্রেমিক-প্রেমিকাদের ভিড় থাকে।
সে বলে, আমাদের প্রেমের সম্পর্কগুলো অনেক দীর্ঘ হয়। কাউকে কেউ কথা দিলে তা রক্ষা করে চলে অন্যজন। তাই বলতে গেলে বিয়ে না করেও 'গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড' সম্পর্ক অনেকটাই বৈধ সম্পর্ক হয়ে গেছে।
আর এই জন্য টেলিভিশন, ম্যাগাজিন কিংবা পত্রিকায় বড় করে বিজ্ঞাপন প্রচার করতেই বাঁধা নেই। আমাদের স্বাধীনতা হলো আত্মিক ও দৈহিক। অন্যের অশান্তি হয় এমন কাজ সাধারনত করা হয় না।
মাসুরির সাথে কথা বলতে বলতে কয়েক যেন দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেছে তা টেরই পায়নি। আমার আগ্রহ দেখে মাসুরি আমাকে নিরাশ করেনি।
আপাতত ও এটুকু বললো, এখন লাভ হোটেলে যাওয়ার দরকার নাই। আর নাদিম তুমি তো বিয়েসাদি করোনি। বিয়ে করলে তোমাকে এই হোটেলের জন্য যাবতীয় খরচ আমি দেব।
যদিও আমার ডরমিটরি থেকে কিলো তিনেক পর 'লাভ হোটেল দেখা যায়।এই হোটেলগুলোতে সাধারনত কোন জানালা থাকে না। রাতের বেলায় হোটেলগুলোতে লাল বাতি জ্বলে আর সেটাতে গ্রাহকরা বুঝতে পারে।
আমাদের প্রেমের স্থল পার্ক কিংবা নদীর বাঁধ কিংবা রিকশায় ঘুরে বেড়ানো আর তোমাদের রোমান্টিকতা লাভ হোটেলের কোণায় কোণায়।
আমাদের দেশের ভালবাসা মানে হলো, কিছু সময় একান্তে কথা বলা। বাঙালির প্রেমই হলো পৃথিবীর সবচেয়ে আবেগঘন ও হৃদয়সৃত প্রেম। যা কিনা পারে আত্মহত্যা করাতে আবার প্রেমিক বা প্রেমিকাদের বাড়িতে অনশন করাতে। সব ছাপিয়ে এই ভালবাসার 'বাজারে' আত্মিক প্রেমের জয় হোক।
লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক
ছবি কৃতজ্ঞতা: কিসুতে মাসুতি এবং এস এম নাদিম মাহমুদ
ই-মেইল: nadim.ru@gmail.com
এই লেখকের আরও পড়ুন