কোরআন শিখতে চেয়েছেন জাপানি অধ্যাপক

গুলশানে জঙ্গি হামলার পরের ঘটনা। একদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে গিয়েছি। সেমিনার শুরু হবার পর পরিচিত এক অধ্যাপক বক্তৃতা দেবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “নাদিম-সান (সান জাপানের ভদ্রতার অংশ), তুমি কি আমাকে কোরআন শিখিয়ে দেবে? আমি বেঁচে থাকতে চাই।”

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Oct 2016, 10:14 AM
Updated : 14 Oct 2016, 10:14 AM

অধ্যাপকের এই প্রশ্নে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, “হঠাৎ কোরআন শিখবেন কেন স্যার? আর আমি নিজেও তো পুরোপুরি কোরআন জানি না।”

তিনি একটু বিচলিত কণ্ঠে বললেন, “তোমাদের বাংলাদেশে নাকি আমাদের জাপানিদের ধরে ধরে কোরআন পারে কি না জিজ্ঞাসা করেছিল, আর না পারায় সাত জাপানিকে হত্যা করেছে। তাই একটু কোরআন শিখতে চাই।”

বাংলাদেশে গত ১ জুলাই গুলশানে জঙ্গিরা সাত জাপানিকে জবাই করে মেরে ফেলছিল। তার জন্য আমাদের লজ্জার শেষ নেই। তবে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তা ভাবিনি।

যে খবরটি আমাদের দেশের প্রথম সারির পত্রিকাগুলোতে আসেনি, সেই খবরটি  (কোরআন পড়তে পারলে মুক্তি) জাপানি গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। আর তাই ওই অধ্যাপকের মতো জাপানের মানুষজন বেশ আতঙ্কিত।

মনে পড়ে গেল কয়েক মাস আগে ‘নিউইর্ক টাইমসে’ প্রকাশিত একটা খবর। হলিউড অভিনেত্রী আঞ্জেলিনা জোলি তার অভিজ্ঞতা বলছিলেন।

মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের কাছে ধরা পরার পর এক দম্পত্তিকে আইএস সৈন্যরা কোরআন তেলাওয়াত করতে বলে। না পারলে তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হবে না বলে জানায় তারা। পরবর্তীতে ওই দম্পতি ‘বাইবেলের’ একটি অংশ বলেছিল। ওটাকেই আইএস কোরআনের আয়াত মনে করে তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছিল। আমি সেই গল্পটাই সেদিন সেমিনারে সবাইকে শুনিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলাম।

গুলশান হামলার পর জাপানিরা চেহারা দেখেই মনে করে আমরা ইন্ডিয়ান অথবা বাংলাদেশি। আর বাংলাদেশি জানার পর অন্য রকমের একটা পরিবেশ তৈরি হয়। অনেকে যেন আমাদেরকে দেখে একটু ভয় পাচ্ছে।

শুধু তাই নয় এই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ই-মেইল ইস্যু করা হয়েছিল যেন বাংলাদেশি ছাত্ররা এই মুহূর্তে দেশে ফিরে না যায়। জাপানে বসবাসরত বাঙালিদের অনেককেই কর্মক্ষেত্রে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখামুখি হতে হয়েছে এ নিয়ে।

গত বছর ৩ অক্টোবর রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে হত্যা করা হয়েছিল। তখন জাপানিরা কষ্ট পেয়েছে, কিন্তু গুলশান হামলায় সাতজন জাপানিকে হত্যার ঘটনায় জাপানিরা তো বটেই, প্রবাসি বাংলাদেশিরাও প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে।

ওই হত্যাকাণ্ডের দেড় মাস পর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মনবসু স্কলারশিপের জন্য আমার চারজন বন্ধু আবেদন করেছিল। কিন্তু তাদের কাউকে নেওয়া হয়নি। কারণ জাপান সরকার অভ্যন্তরীণ এক বার্তায় প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের বিষয়ে সর্তক করে দিয়েছে।

প্রতি বছর দুইশ’র বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী জাপানে পড়াশুনার জন্য ‘স্কলারশিপ’ নিয়ে যায়। গুলশান হামলার প্রভাব পড়ছে উচ্চশিক্ষা নিতে আসা এসব বাঙালি শিক্ষার্থীদের ওপর।

জাপানিরা খুব আন্তরিক। কিন্তু বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে যখন কথা ওঠে তখন বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে জাপানে বসবাসরত দশ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশির।

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক