বাহারি খাবার দেখলে যে কারও মন খেতে চাইবে। আর চাইবে না কেন, এরা তো বাসায় রান্না করে না। সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে রাতের খাবার পর্যন্ত এরা বারো মাসই কিনে খায়। এরা ভাবে যতক্ষণ রান্না করতে সময় ব্যয় করবো ততক্ষণে এর পাঁচগুন খাওয়ার অর্থ উপার্জন করবো। আর এই জন্য আমি এদেরকে নাম দিয়েছি ‘যন্ত্রজাতি’। যন্ত্রজাতির নাগরিকরা খায় কম কিন্তু কাজের তীক্ষ্ণতা এদের বেশি।
বাহারি খাবারে মন খোঁচা দিলেও আমি এই ক্ষেত্রে পুরো ফ্লপ। এখন পর্যন্ত তাদের মেন্যুর কোন খাবার খেতে পারিনি। না পারা যে কতটা ব্যর্থতা তা ল্যাবের পার্টিগুলোতে অনেক অনুভব করি।
আমার ল্যাবে প্রতি মাসে দুই থেকে তিনটি করে পার্টি থাকে। বাচ্চা হওয়া থেকে শুরু করে পরীক্ষার ভাল প্রেজেন্টেশন দেয়া সব কিছুই যেন পার্টি নির্ভর। পার্টিতে যোগ দিলে গুনতে হয় টাকা। তাদের পার্টি কখনও ফ্রি ফ্রি হয় না। কারও জন্মদিন কিংবা বিবাহবাষির্কী দাওয়াত পেলে খাওয়ার পর মাথাপিছু গুনতে হয় অর্থ। এটা এখানকার ঐতিহ্য।
সুসি আর কিছু সব্জির খাবার (জাপানিরা বলে ন্যাবে) ছাড়া অন্য কোন খাবার না খেলেও ল্যাবমেটদের কাছ থেকে চিনে নেয়া খাদ্য তালিকাও দীর্ঘ হয়েছে। তাই এই খাবারের কিছু বর্ণনা দেয়া প্রয়োজন বটে। জাপানের খাবারের তালিকা কত তা তারা নিজেরাও জানে না। তবে ভোজন রসিক জাপানিরা খাবারের তালিকায় যা যা রেখেছে-
তেমপুরা: জাপানে অতিপরিচিত এই খাবার তৈরি করা হয় সামুদ্রিক মাছ, অক্টোপাস, চিংড়ি, মাছের ডিম, মাশরুম সাথে বাটারের মিশ্রনে। তেলে ভাজা এই খাবার দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। জিভে জল আসা খাবারটির প্রকারভেদও দীর্ঘ।
ওকোনেমিয়াকি: বাঁধাকপির ওপর ময়দা আর বাটারের পলেপের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয় অর্ধসেদ্ধ মাংশ টুকরা। এরপর আগুনে সেকে পেয়াজের সস দিয়ে পরিবেশন করা হয়। জাপানের সর্বত্র জনপ্রিয় এই খাবার।
তকোয়াকি: অক্টোপাসের গ্রিলের মধ্যে থাকে আদা, পেয়াজের টুকরা, ময়দা আর ডিমের মিশ্রণ। মায়ানোনোইচজ নামক একধরণের সস দিয়ে করা হয়ে আকর্ষণীয় তাকোয়াকি।
কুশিকাসু: মাংশের টুকরায় বাটার মিশিয়ে পছন্দের সব্জি টুকরা দিয়ে গ্রিল করা হয়। পরিবেশনের সময় থাকে স্টবেরি। জাপানি রেস্টুরেন্টে বিশেষ করে ওসাকা শহরের রেস্টুরেন্টগুলো দখলে রেখেছে এই খাবারটি।
তেপ্পানাকি: এটি সাধারণ সামুদ্রিক কিংবা মাংশের পরিবেশনায় রাতের খাবার হিসেবে পরিচিত। একটি ধাতব থালায় সামুদ্রিক চিংড়ি কিংবা মাংশের টুকরা রেখে পাত্রসহ গরম করা হয়।
এছাড়া ডিমের বিকল্প হিসেবে তফু, রামেন, ছোবা, সাসমি, ওডেন, ইকিতরি, মনজাকি, সুকুডানি, টোকিও মিস্টি, চানকোনাবে, তেবাসি, হিতসুবাসি, মিশুকাসি, কিসিমেন, ওকিনেয়া ছোবা, চাম্পুরা, মিমাকি, ওকাবিনি, রাফুতেসহ অন্তত দুই শতাধিক খাবার।
গ্রীষ্মের শুরুতে তো রয়েছে বাঁশ খাওয়ার দিন। সাধারণত এপ্রিলের শেষ দিকে জাপানে বাঁশ খাওয়ার উৎসব হয়ে যায়। প্রথমবার নিজেও বাঁশ বাগান থেকে কচি বাঁশ সংগ্রহ করেছিলাম ল্যাবমেটদের সাথে। এই কচি বাঁশ বিশেষ প্রক্রিয়ায় কয়েকদিন রেখে দেয়ার পর টুকরো টুকরো করে কাটা হয়। মাংশ রান্না করার মতো করে পরিবেশন করা হয় বাম্বু স্যুপ। এছাড়া আঁঠালো ভাতের সাথে বাঁশের মিশ্রণ করে গোল করা হয়। এটি খেতেও সুস্বাদু। প্রথমবার খেতে অনেক কষ্ট হয়েছে। তারপরও বাঁশ খেয়েছি।
দেশে থাকতে এক আলুসেদ্ধ ভাত ছাড়া কিছু রান্না করতে পারতাম না। কিন্তু জাপানি খাবার না খেতে পারায় শীতের এই দেশে এসে ধীরে ধীরে বার্বুচির খেতাব পাওয়া শুরু করেছি। সব কিছু ছাপিয়ে বাঙালি খাবারের যে কতটা কদর টের পেয়েছি। বছরের শুরুতে আন্তর্জাতিক খাদ্য উৎসবে নিজের রান্না করা বাঙালি খাবার সবাইকে মুগ্ধ করেছে। শুধু জাপানিরা নয় বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো বাঙালি খাবারের কদর বুঝেছে।
ওসাকার ইবারাকি মসজিদে প্রতি শনিবার রাতের খাবারের আয়োজন থাকে। মাসে একবার বাঙালিদের খাবার পরিবেশন করতে হয়। ওই দিন ইয়েমন, মিশর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মুসলিমরা যে পরিমাণ ভিড় জমায় তা অন্য দিনগুলোকে হার মানায়। তারা প্রকাশ্যে বলে ওঠে, ও আজ বাঙালি খাবার? মিস যেন না হয়!
লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক
ইমেইল: nadim.ru@gmail.com