জাপানে বসবাসরত এই লেখক প্রায় তিন দশকের বেশি সময়জুড়ে জাপানে বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে নীরবে প্রচার করে যাচ্ছেন। ১৯৫৯ সালে সিলেটের সুনামগঞ্জ জন্ম নেওয়া এই লেখক জাপানি নাগরিক নোরিকো মিয়াজাওয়াকে বিয়ে করে সেখানেই থেকে যান।
তার প্রকাশিত বইগুলো হল- ‘সেই ঘরে সুন্দর’ (কবিতা), ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ (রাজনৈতিক ছড়া), ‘অবাক কাণ্ড’ (কিশোরমনস্ক ছড়া), ‘তালা’, ‘রাহুল’ (উপন্যাস), 'জানা অজানা জাপান’ (প্রবন্ধ,৩ খণ্ড), জানা আনজানা জাপান (হিন্দি),জাপানের নদী নারী ফুল (প্রবন্ধ), ‘জাপানে গণিকা সংস্কৃতি’ (প্রবন্ধ), ‘রবীন্দ্রনাথ এবং জাপান: শতবর্ষের সম্পর্ক’ (প্রবন্ধ) ও 'জাপানে রবীন্দ্রনাথ’ (প্রবন্ধ)।
জাপানে বাঙালিদের কাছে পরিচিত প্রবীর বিকাশ জাপানে রবীন্দ্রস্মৃতি, জাপানি সাহিত্য সংস্কৃতি ও জাপানে প্রবাস জীবন বিষয়ে সম্প্রতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জাপান প্রতিনিধি এস এম নাদিম মাহমুদ এর মুখোমুখি হয়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনার লেখার বড় অংশজুড়েই জাপানের ইতিহাস ও সংস্কৃতি। জাপানকেই কেন বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে তুলে ধরার তাগিদ মনে করেছেন?
প্রবীর বিকাশ সরকার: এই দেশটি সম্পর্কে সারা পৃথিবীর আগ্রহ বেশি। শান্তির দেশ শুধু নয়,স্বতন্ত্র সংস্কৃতির জন্যও জাপান বিখ্যাত। আধুনিক শিক্ষার কথা বললে জাপানই সেরা দেশ, অন্ততপক্ষে এশিয়া মহাদেশে। অনেক কিছু শেখার আছে। সুতরাং বাংলাদেশের আদর্শ হতে পারে জাপান- এই কথাটি চিন্তা করে জাপানকে জানা শুরু করলাম। যতখানি জেনেছি, বুঝেছি, দেখেছি- তা লেখার চেষ্টা করেছি ‘জানা অজানা জাপান’ তিন খণ্ডে। ৪র্থ খণ্ডও আশা করছি শিগগির প্রকাশিত হবে। আমি শখের গবেষক, একাডেমিক নই। যা ভালো লেগেছে তাই লিখেছি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: জাপানে আপনার গবেষণার বড় একটা অংশজুড়ে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তো এতো কিছু থাকতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনুসন্ধানে কেন নেমেছিলেন?
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বাংলা সাহিত্যের সাথে জাপানি সাহিত্যের যোগাযোগটা শুরু হয়েছিল কীভাবে?
প্রবীর বিকাশ সরকার: রবীন্দ্রনাথ তাঁর জাপানি বন্ধু পণ্ডিত, মনীষী ওকাকুরা তেনশিনের (১৮৬৩-১৯১৩) মাধ্যমে জাপানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পরিচিতি শুরু করেন। ১৯০২ সালে ওকাকুরা ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিত হন স্বামী বিবেকানন্দের মাধ্যমে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বার্তা নিয়ে স্বদেশে ফেরেন ওকাকুরা। নিজের আগ্রহ আর রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে তাঁর শিষ্য চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকান ও হিশিদা শুনসোওকে কলকাতায় পাঠান ১৯০৩ সালে। এরপর ওকাকুরার শিষ্য সানো জিননোসুকে ও চিত্রশিল্পী কাৎসুতা শৌকিন শান্তিনিকেতনে যান।
বাংলাদেশের চট্টগ্রামে যান বৌদ্ধপণ্ডিত কিমুরা রিউকান বা কিমুরা নিক্কি। এরপর আরও একাধিক জন। এক জাপানি তরুণী শিজুয়ে ইরিয়ে সঙ্গীত শিখতে গেলেন শান্তিনিকেতনে, ফিরে এসে বইও লিখেছেন। মাসু গেনজিরোও শান্তিনিকেতনে বেহালা বাজিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। তাঁরা সবাই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের অধ্যাপক হয়েছিলেন কিমুরা নিক্কি, একই সঙ্গে অসামান্য দখল ছিল তাঁর বাংলা ভাষায়। সানো বাংলা শিখেছিলেন,রবীন্দ্রসাহিত্য পড়েছিলেন। ‘গোরা’ দীর্ঘ উপন্যাসটি বাংলা থেকে জাপানিতে অনুবাদ করেছেন। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম সফরে জাপানে এলেন। সেই বছরই রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে চিত্রশিল্পী আরাই কাম্পো কলকাতায় গেলেন,বিচিত্রা ভবনে দুই বছর শিক্ষকতা করেছেন। আরও কত ঘটনা, কত ইতিহাস!
রবীন্দ্রনাথ পাঁচ বার জাপানে এলেন,ওকাকুরা গেলেন দুবার। জাপান-বাংলা শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ভাববিনিময়ের কত যে ঘটনা সেসব ইতিহাস লেখা হয়নি,পড়ানোও হয় না কোথাও। অযত্নে,অবহেলায় কতকিছু হারিয়েও গেছে। আমোদের ভুলে গেলে চলবে না যে, রবীন্দ্র-ওকাকুরার বন্ধুত্বের সুদূরপ্রসারী প্রভাবই ভারতের স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্তরালে কাজ করেছে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাকুয়েই তানাকা রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা সভায় রবীন্দ্র-ওকাকুরার সম্পর্ক থেকেই তাঁর বক্তৃতা শুরু করেছিলেন। বর্তমানে জাপানি তরুণদের মধ্যে বাংলা ভাষা জানার আগ্রহ বাড়ছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন জিনিসগুলো তৎকালীন জাপানি সাহিত্যিকদের মনে দাগ কেটেছিল বলে আপনি মনে করেন?
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এখনো কি জাপানে আলোচনা কিংবা লেখালেখি হচ্ছে?
প্রবীর বিকাশ সরকার: অবশ্যই হচ্ছে। জাপানি রবীন্দ্রভক্তরা এক বছরব্যাপী তাঁর সার্ধশত জন্মবর্ষ উদযাপন করেছেন। নিহোন জোশি দাইগাকু বা জাপান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় একাধিক অনুষ্ঠান করেছে, সেমিনার করেছে। প্রতি বছর রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী উদযাপন করতেন ‘ভারত-জাপান টেগোর সমিতি'র প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক কাজুও আজুমা। ২০১১ সালে তিনি প্রয়াত হওয়ায় এখন সেটা বন্ধ। কিন্তু জাপানি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কাম্বে তোমোকো আয়োজন করেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠান, গুরুদেবকে স্মরণ করে। ২০১১ সালে টোকিওতে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত ‘ইন্ডিয়া-জাপান গ্লোবাল পার্টনারশিপ সামিট’-এ কর্তৃপক্ষের অনুরোধে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল জাপানে রবীন্দ্রনাথের দুর্লভ ৩৪টি আলোকচিত্র প্রদর্শনী আয়োজনের। প্রচুর জাপানি সেসব ছবি দেখে আপ্লুত হয়েছেন, তাদের মধ্যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীদ্বয় মোরি য়োশিরোও এবং হাতোয়ামা ইউকিওসহ প্রভাবশালী রাজনীতিবিদও ছিলেন। ইন্টারনেটের বদৌলতে বর্তমানে বহু জাপানির রবীন্দ্রপ্রীতির প্রচুর লেখা ও মতামত জানা যায়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা সাহিত্যকে জাপানিরা কীভাবে দেখেন?
প্রবীর বিকাশ সরকার: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিদেশিদের জানতে বা শিখতে হলে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। অর্থাৎ বাংলা ভাষা শেখার পর জাপানিরা প্রথম রবীন্দ্রসাহিত্যের দুয়ার দিয়ে বাংলা সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করতেই বেশি আগ্রহী হন। কারণ নোবেল বিজয়ের প্রভাব। বাংলা ভাষা শেখা রবীন্দ্রনাথকে জানার কৌতূহলেরই আরেক নাম। বাংলা সাহিত্য পড়া বা জানার পর বিদেশিরা টের পান এর সমৃদ্ধি কতখানি! জাপানিরাও এর ব্যতিক্রম নন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: জাপানে প্রবাসী বাঙালিদের সাহিত্যচর্চার দৃশ্যপট যদি আপনাকে আঁকতে বলি তাহলে আপনি কীভাবে আঁকবেন ?
প্রবীর বিকাশ সরকার: জাপানে সেভাবে বাংলা সাহিত্যচর্চার বিস্তৃতি ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। তার প্রধান কারণ- লেখক স্বল্পতা তো আছেই, যে ক’জন আছেন তাদের সময় স্বল্পতাও দায়ি। এখানে জীবনজীবিকা ধারণ করা খুব কঠিন, ফলে সময় বের করে সাহিত্যচর্চা বা সংস্কৃতিচর্চা কষ্টসাধ্য। তবু যারা পারছেন চেষ্টা করছেন কিছু না কিছু লেখালেখি করার। তবে খুব কম। সব দেশেই এক অবস্থা। তবে চেষ্টাটা বড়কথা। পারস্পরিক দলাদলি,হিংসা-বিদ্বেষ দূর হলে সাংগঠনিকভাবে সাহিত্যচর্চাকে প্রবাসেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: ‘জাপানে গণিকা সংস্কৃতি’ আপনার একটি বই। এতো প্রাচীন তথ্য ও বর্ণনার দিকটা যদি একটু বলেন?
এইদেশে সব বদল করা যায়, সংস্কৃতি বদল করা যায় না। ‘জাপানে গণিকা সংস্কৃতি’ লেখার শুরুটা ‘গেইশা’র ইতিহাস পড়তে গিয়ে। ‘গেইশা’ আর ‘অইরান’ এক বিষয় নয়, এটা বুঝতে পারি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: বাংলা সাহিত্যের সাথে জাপানি সাহিত্যের মিল-অমিল কতটুকু বলে আপনি মরে করেন?
প্রবীর বিকাশ সরকার: জাপানি সাহিত্য এত বিপুল যে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়! যৎসামান্য পড়ার চেষ্টা করেছি তাতে করে মিল-অমিল নিয়ে কথা বলা বিপজ্জনক। তবে বাংলা সাহিত্যের মতোই খুব শক্তিশালী,সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় বলতে হবে। সামুরাই যুগ নিয়ে প্রচুর উপন্যাস লেখা হচ্ছে শত বছর ধরেই। রুশ-জাপান মহাযুদ্ধ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ নিয়ে বহু উপন্যাস, গল্প,কবিতা লেখা হয়েছে,এখনো হচ্ছে। আর হাইকু তো বিশ্বখ্যাত। তাছাড়া ওয়াকা,তানকা নামক কবিতাও প্রচুর লেখা হচ্ছে, যেগুলোর প্রধান বিষয় প্রকৃতি এবং মানবপ্রেম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: প্রবাসে বাঙালিদের ঐহিত্য ধরে রাখার প্রবৃত্তি কতটুকু?
প্রবীর বিকাশ সরকার: প্রবৃত্তির ঘাটতি নেই, কিন্তু আর্থিক সক্ষমতা আর সময়ের অভাব প্রধান প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: প্রবাসী বাঙালিরা জাপানিদের কাছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে কতটুকু তুলে ধরতে পারছেন বলে আপনি মনে করেন?
প্রবীর বিকাশ সরকার: সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে সীমিত পরিসরে তুলে ধরার চেষ্টা বিদ্যমান। তবে বাংলাদেশ দূতাবাসের কোনো উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নেই। এটা হতাশার এবং দুঃখজনক।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: জাপানে আপনি 'মানচিত্র' নামের যে মাসিক পত্রিকা বের করেছিলেন তার শুরুর দিকটা যদি বলেন? কারা কারা পত্রিকাটিতে লিখতেন?
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: জাপানে আপনার তিন দশক তো পার হলো। এক কথায় যদি জিজ্ঞাসা করি,জাপানিদের চোখে বাঙালিরা কেমন?
প্রবীর বিকাশ সরকার: বাঙালিরা বুদ্ধিমান, রাজনীতিসচেতন এবং অকুতোভয়, কিন্তু দেশপ্রেমিক নয়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনি বলেছিলেন, জাপানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্গবন্ধুর কোন ভাস্কর্য নেই। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে ধরে রাখতে বাংলাদেশ সরকারকে কী কী করা উচিত বলে মনে করেন?
প্রবীর বিকাশ সরকার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মারক ভাস্কর্য স্থাপনের কথা বলবো। টোকিওর আসুকায়ামা,ওওজি স্টেশন, উয়েনো উদ্যান বা মেজিরো শহরে জাপান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কেইও বিশ্ববিদ্যালয়,ওয়াসেদা এবং টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেও হতে পারে। অবশ্য ২০১১ সালে রবিঠাকুরের সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণে সোওকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে বড় একটি স্মারক ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর একটি স্মারক ভাস্কর্য বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রাঙ্গণে স্থাপন করা যেতে পারে। তাঁর সম্বন্ধে যাতে জাপানিরা গবেষণা করতে পারেন তার জন্য বৃত্তি দেওয়া যেতে পারে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: তাপমাত্রা কমছে,শীতের প্রকোপও বাড়ছে। এই শীতের মধ্যে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে কিছু সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রবীর বিকাশ সরকার: আপনাকেও ধন্যবাদ। একই সাথে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতি রইলো শুভ কামনা।
ছবি কৃতজ্ঞতা: প্রবীর বিকাশ সরকার
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |