জাপানে পড়াশোনা করতে গিয়ে

ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাপানের তৃতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে আসার পর ভর্তির সময়কার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি।

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Oct 2016, 09:46 AM
Updated : 22 Oct 2016, 11:51 AM

ভর্তি প্রক্রিয়া শুরুর সময় এক কর্মকর্তার প্রশ্নে ব্যাপক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল আমাকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে স্নাতক এক সনদপত্র ছিল এই দূর্ভোগের হোতা।

আমি যখন আমার ভর্তি প্রক্রিয়ার আবেদনপত্রে আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদগুলো জমা দেই, তখন সনদে থাকা পরীক্ষার ফল প্রকাশের তারিখ দেখে চমকে ওঠেন ওই কর্মকর্তা।

একাডেমিক তারিখ অনুযায়ী আমার স্নাতক শেষ হওয়ার কথা ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু সনদে পরীক্ষার ফলাফল লেখা ৩০ জানুয়ারি ২০১৪। আর তা দেখে বেচারি জাপানি কর্মকর্তা সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেন।

আমাকে বললেন, "এই তারিখ কি সঠিক? নাকি আপনার বিশ্ববিদ্যালয় ভুল করে সনদে তারিখ বসিয়েছে?"

উত্তরে আমি তাকে বললাম, "এই তারিখই সঠিক।"

তিনি কড়া কণ্ঠে বললেন, "তাহলে আপনার শিক্ষাবর্ষ অনুযায়ী তো আপনার সনদে ২০১২ লেখার কথা, কিন্তু এই তারিখ কেন? এই এক বছরের অধিক সময় আপনি কি করেছেন? কোথায় চাকুরি করেছেন?"

প্রশ্নবানে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। উত্তরে কি বলবো তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

তাকে বললাম, "এটাকে আমাদের দেশে ‘সেশনজট’ বলে। চার বছরের কোর্স পাঁচ বছর থেকে সাড়ে পাঁচ বছর সময় লাগে।"

এই কথা বলার পর তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “সেশনজট কি? এটা কেন হয়?”

নিত্যন্ত সুবোধ বালকের মতো ব্যাখা করলাম সেশনজটের আদ্যোপান্ত। বললাম, আমাদের গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রকে অন্তিমতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমাদের তরুণ সমাজ, মানে আমাদের ছাত্র সমাজ অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। তাই গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দিতে মাঝে মধ্যে ক্যাম্পাসে খুন-খারাবি হয়। আর রক্তাক্ত ক্যাম্পাসে ক্লাস করতে কে চায় বলুন? তাই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়।

খুনের কথা শুনে ভদ্রলোক তো ভয় পেয়ে গেলেন।

আমিও বোকার মতো মুখ ফসকে বলে ফেলায় আরো বেশি প্রশ্নের মুখোমুখি হলাম। 

তিনি বললেন, “তোমাদের শিক্ষকরা কি করেন? তারা কেনো ক্লাস নেন না? তাহলে তো তোমাদের অতিরিক্ত খরচ দিয়ে পড়াশোনা করতে হয়?”

আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতিসূচক আচরণ করলাম।

আমার সঙ্গে থাকা আমার ল্যাবের সেক্রেটারি বিষয়গুলো শুনে তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা ধারণা পেয়ে গেলেন। তাই তিনি কিছু বললেন না। 

এরপর ওই ভদ্রলোক সীতা-রামের মাসির মতো আচরণ করে আমাকে বললেন, "আপনার শিক্ষা বিরতির কাগজ লাগবে।"

এই কথা শুনে আমার শরীরে রাগের অনুভূতিটা আরো বেশি প্রবল হয়ে উঠলো।

এরপর সেক্রেটারি ওই কর্মকর্তার সাথে জাপানি ভাষায় কথোপকথন শেষে আমাকে বললেন, "উনি সেশনজট বুঝতে পারেননি। আমি তাকে বলে দিয়েছি কোনো সমস্যা হবে না।" 

ভর্তি প্রক্রিয়ার ওই যাত্রা থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম কিন্তু ওরিয়েন্টশনের দিন যা পেয়েছি তা মূলত লজ্জার একটি বহিঃপ্রকাশ। আমরা বিভিন্ন দেশের সহপাঠীরা একটি কক্ষে জড়ো হয়েছি আর একজন অধ্যাপক আমাদের সিলেবাস বুঝিয়ে দিচ্ছেন। আর তার আগে আমাদের প্রত্যেকের হাতে এসেছে কয়েকটি ডকুমেন্ট। 

অধ্যাপক তখন একটি ডকুমেন্ট বের করে বললো, "প্রত্যেকে এই কাগজটি বের করুন।"

আমি কাগজটি হাতে পেয়ে সত্যিই চমকে গিয়েছি। সিলেবাসের জায়গায় আগে দেয়া আছে কোর্স শুরু ও শেষের সময়সীমা। স্পষ্ট অক্ষরে বলা আছে কবে, কোথায়, কত তারিখে আমাদের পরীক্ষা হবে; কবে সমাবর্তন হবে তার বিস্তারিত সময়সূচি।

অধ্যাপক বলে দিলেন, "এই সময়সূচির বিন্দু পরিমাণ ব্যতিক্রম ঘটবে না।"

এই ধরনের সূচি পুরো একুশ বছরের শিক্ষা জীবনে কোথাও পাইনি আর তা দেখে চোখ তো কপালে উঠবারই কথা!

মজার মাত্রাটি আরো একধাপ বেড়ে গেল যখন ক্লাস শুরু হয়। প্রতিটি কোর্স কোন তারিখে, কত সময় নিয়ে ক্লাস হবে- তা নিদিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আর সেই অনুযায়ী ক্লাস হচ্ছে আমাদের।

জীবনে এই শিক্ষা ব্যবস্থাটুকু কখনো কল্পনা করিনি। কিন্তু ওসাকা তথা জাপানের এই ব্যবস্থা আমাকে নতুন করে ছাত্রত্ব দিয়েছে। মনে হচ্ছে সবে প্রথম শ্রেণিতে পড়া শুরু করছি আর বৃদ্ধ পর্যন্ত চালিয়ে যাবো।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কথাগুলো সত্যিই হাস্যকর শোনাবে। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে অন্তত এই যান্ত্রিক দেশের শিক্ষার্থীদের জীবনে মহাসত্য ঘটনা।

এক বছর আগে দেশে আমার সহপাঠীদের মাস্টার্স পরীক্ষা হয়ে গেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত থিসিস-প্রেজেন্টশন দিতে পারেনি তারা। তাই বন্ধুদের আক্ষেপের সুরটাও বড্ড করুণ হয়ে উঠেছে।

প্রত্যেকটি বিভাগে সেশনজটের মিছিল দীর্ঘায়নে কে বা কারা ভূমিকা পালন করছে তা প্রশ্নাতীত। কিন্তু এই প্রথা যে ধ্বংসত্ব বহন করছে তা শতভাগ সত্য হয়ে উঠছে।

আমি খুব অনুভব করি, আমার মতো বিদেশে পড়তে এসে কাউকে যেন চার বছরের কোর্স সাড়ে পাঁচ বছর দেখতে না হয়। কাউকে বিড়ম্বনায় পড়তে না হয়। আর এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমার মাতৃভূমিতে এমন স্বাপ্নিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। এমন বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে শিক্ষাবর্ষের শুরুতে দেয়া হবে পাঠ্যসূচির বিস্তারিত, থাকবে সমাবর্তনের তারিখ আর শিক্ষকদের ক্লাস নেয়ার তারিখ। এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে হলে কি খুব বেশি ক্ষতি হবে? কথিত ‘গণতন্ত্র’ রক্ষা করা ছাত্র সংগঠনগুলোর জন্য কি মহা অন্যায় কাজ হবে?

এই স্বপ্নগুলো মাঝে মাঝে মধ্যরাতে আমাকে জাগিয়ে দিচ্ছে। তবুও আশায় বুক বাঁধলাম, স্বপ্নের ফোঁড়ন আটলাম।

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক