জাপানেও প্রিয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

এক দশকে পা দিলো বাংলাদেশের অনলাইন সাংবাদিকতার পথিকৃৎ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। শুভ জন্মদিন।

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Oct 2016, 09:45 AM
Updated : 23 Oct 2016, 10:51 AM

আমার বয়স এখন ২৬। আজ থেকে ঠিক সাড়ে এগার বছর আগে ২০০৫ সালের মে মাসে ২২ তারিখে লেখালেখি শুরু করেছিলাম যখন আমি সবে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছি। বগুড়া থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক আজ ও আগামীকাল’ নামের একটা সাদা-কালো পত্রিকায় শুরু করেছিলাম স্থানীয় সাংবাদিকতা।

আমার পড়াশুনার একমাত্র উৎসাহদাতাও ছিল সাংবাদিকতা। এসএসসি ও এইচএসসি ভালো ফলাফলের কারণে আমার সাংবাদিক হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে যারা মুখ বাঁকাতেন সেসব মুখ বন্ধ হয়েছিলো।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার আগেই শুরু করেছিলাম স্থানীয় পত্রিকায় সাংবাদিকতা। ভর্তির পর মাস ছয়েক লেখালেখি বন্ধ থাকলেও পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে ফিরলাম। শুরু হলো পুরোদস্তুর সাংবাদিকতা।

বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতায় যারা জড়িত ছিল তারা সবাই কলা অনুষদের ছাত্র। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমি যে সাংবাদিকতায় উপযুক্ত হতে পারবো না তা অন্তত কয়েক ডজন সাংবাদিক সর্তক করে দিয়েছিল। এরপরও সাংবাদিকতা থেমে যায়নি কিংবা যেতে দেইনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে পথচলা

যেকোন জায়গায় সাফল্য পেতে হলে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রবেশের আগে যে সাংবাদিকতা করেছি তা ছিল কেবল- গাইতে গাইতে গায়েন স্বভাবের। কিন্তু ২০১১ সালের নভেম্বরে এই প্রতিষ্ঠানটিতে যখন সাংবাদিকতা শুরু করি, তখন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পারি পেশাদারী সাংবাদিকতার পরিধি। 

প্রথম প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর তার অসঙ্গতিগুলো নিয়ে সহ-সম্পাদকের করা নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই বুঝলাম সাংবাদিকতা কাকে বলে!

শুরু হলো দেশের প্রথম অনলাইন ও আমার প্রিয় নিউজ পোর্টালে সংবাদ করা। শুরুতেই অফিসের কর্তাব্যক্তিদের কাছে অঙ্গিকার করেছিলাম- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া সব ধরণের ঘটনা আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে আসবে, এরপর অন্যান্য গণমাধ্যমে।

পেশাদারিত্বের জায়গায় আমি চেষ্টা করেছি অটুঁট থাকতে। নিজের সবকিছু উজাড় করে দিয়ে করেছি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতা।

কারণ, একটাই- ভাললাগা। এমনও দিন গেছে, সারাদিন সংবাদের ভেতরেই কাটিয়েছি। সংবাদের নেশায় ছুটতে ১৮ ঘণ্টা পর জুটেছে খাবার। ২০১৪ সালে ২৭ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতায় ইতি টানি।

প্রবাস সাংবাদিকতা

একই বছরের অক্টোবরে জাপান সরকারের বৃত্তি (মনোবসু) নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে আসি। নতুন জায়গায় নতুনভাবে নিজেকে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করি। বাংলাদেশ যখন ছেড়ে আসি, তখন ভেবেছিলাম আর কোনদিন সাংবাদিকতায় ফিরতে পারবো না। আর হয়তো প্রিয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে নিজের কোন লেখা দেখতে পারবো না।

লেখালেখি ছাড়া থাকতে চাওয়া যে কতটা কষ্টকর তা আমি এই মুলুকের দেশে এসে বুঝেছি। লেখালেখি বন্ধ হলেও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্রাউজ করার নেশা আরো বেশি তীব্রতর হয়।

এইভাবে কেটে যায় কয়েক মাস। মাঝে মধ্যে ঘুম থেকে উঠে কেঁদেছি। স্বপ্নেও করেছি সাংবাদিকতা। নেশার জ্বালা যে সমগ্র শরীরে বশ করেছে তা বুঝতে বাকি রইলো না। কিন্তু উপায় তো দেখি না।

মুখ বুঝে সইতে সইতে দেখলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ‘প্রবাস’ নামের নতুন একটি বিভাগ খোলা হয়েছে। অফিস থেকে বলা হলো, লেখালেখি শুরু করতে।

যেদিন এই কথা হলো, সেদিন যে কতটা খুশি হয়েছিলাম তা বর্ণনাতীত। শুরু হলো নতুন করে প্রবাস সাংবাদিকতা।

সারাদিন গবেষণাগারে পড়ে থাকলেও আইফোনের সাফারিতে দিনে অন্তত ২০/২৫ বার ভেসে উঠে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাতা। পড়াশুনার ফাঁকে চলছে প্রবাস সাংবাদিকতা।

প্রবাস সাংবাদিকতায় যে দিনে দিনে অভিজ্ঞতা হচ্ছে তা পাঠকদের জন্য শেয়ার করার তাগিদ মনে করছি। এই তো বছর খানেক আগে, আমার ল্যাবের ওয়েব সাইটে যখন, আমার তথ্য সংযুক্ত করা হচ্ছিল তখন সেখানে একটি অপশন ছিল- আমার শখ কি?

স্বভাবত আমি লিখলাম, লেখালেখি।

তখন দুইজন জাপানি সহপাঠী জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কি ধরনের লেখালেখি করো?

আমি বললাম, জার্নালিজম।

ওরা তখন বললো, ‘শিম্বুন’ (পত্রিকা)? সেটা কিভাবে শখ হলো তোমার?

আমি বললাম যে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম, তখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গণমাধ্যমের একটিতে সাংবাদিকতা করেছি। বলতো পারো পাটর্টাইম জবের মতো।

তখন ওরা বললো, আরে তুমি তো অনেক ভাল লেখালেখি করো নিশ্চয়ই?

ওদের খুব আগ্রহ আমার লেখা দেখবে। তাই সেদিন ‘বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এই প্রবাস পাতায় এক জাপানি অধ্যাপকে নিয়ে লেখার (http://bangla.bdnews24.com/probash/article1004842.bdnews)

জাপানি অনুবাদ গুগলে দেখালাম। তখন তো ওরা খুব খুশি! আমি সেই জাপানি অধ্যাপকের খোঁজ কীভাবে পেলাম তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও আবার শোনাতে হয়েছে।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমার গবেষণাগারের দশক পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠানে গল্প হচ্ছিল আমার অধ্যাপকের সঙ্গে। তার সঙ্গে আমার যে অদ্ভুত মিল রয়েছে তা আগে জানতাম না।

তিনি আমাকে বললেন, “নাদিম আমি স্নাতক থেকেই পত্রিকার হকার ছিলাম। জাপানের নামি-দামি পত্রিকা ভোরেই গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিতাম। আর গরম গরম পত্রিকা পড়ার যে কি আনন্দ তা বুঝাতে পারবো না!”

“পত্রিকার উপার্জিত অর্থে আমার পড়াশুনার খরচ চলতো। আর ইচ্ছে ছিল সাংবাদিকতা করার, কিন্তু পড়াশোনা আর গবেষণার লোভে তা করতে পারিনি।"

সেদিন মনে মনে ভেবেছিলাম, আমার অধ্যাপক পত্রিকা বিলি করেছে আর আমি করছি সাংবাদিকতা! বেশ একটা গর্ব অনুভব করেছিলাম। 

‘পজিটিভ’ সাংবাদিকতা কী তা অবশ্য জাপানে শিখেছি। তাই চেষ্টা করছি বাংলাদেশের কাছে জাপানকে এবং জাপানের কাছে বাংলাদেশকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে।

জাপানের চল্লিশ হাজারেরও বেশি প্রবাসী রয়েছেন যারা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সংবাদের সুবাদে তাৎক্ষণিকভাবে দেশের খবরের সাথে সাথে জাপানের খবরও জানতে পারছেন।

জাপানের যে নান্দনিক দিকগুলো আছে তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আর এজন্য প্রবাসী বাঙালির কাছ থেকে প্রশংসা কুড়াচ্ছি। তারা সবাই চান, প্রবাসীদের কণ্ঠ যেন বাংলাদেশে পৌঁছে যায়, তাদের ভাল ভাল অর্জনগুলো দেশবাসী যেন জানতে পারে- সেই লক্ষ্যে যেন প্রবাস সাংবাদিকতা আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে।

এই তো গত এপ্রিলে কুমামতোতে যখন ভয়াবহ ভূমিকম্প হলো, তখন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত তাৎক্ষণিক খবরে অনেকে প্রবাসে বসবাসরতদের খোঁজ খবর জানতে পেরেছেন।

বাংলাদেশ থেকে একজন ওই সংবাদের প্রেক্ষিতেই তার খোঁজ না পাওয়া এক নিকট আত্মীয়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়েছেন এবং ওই সংবাদের নিচে গিয়ে নিজের নির্ভারতার কথাও মন্তব্যে লিখেছেন।

বেশ কয়েকজন টেলিফোনে তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি অনেকে আমার সঙ্গে দেখা করেও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে। এটাই আমার সাংবাদিকতার বড় অর্জন।

দেশের গণমাধ্যমগুলোও এখন জাপানের খবরে নজর দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রতি আর নির্ভর না থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের খবরই প্রাধান্য পাচ্ছে।

লাল রং ব্যানার লোগোটি আমার খুব প্রিয়। প্রবাসে বসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের লোগোর প্রতি ভালবাসার তীব্রতা অনুভব করি। তাই অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে লেখার কোন উৎসাহ পাই না। 

আর এজন্য ইতোমধ্যে দেশের কয়েকটি টেলিভিশন ও শীর্ষ পত্রিকা জাপান প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার অনুরোধ জানিয়েছেন।

অনেকে অর্থের কথা বলেছে। কিন্তু আমি বিনীতভাবে প্রত্যাখান করে বলেছি, “আমি টাকার নেশার সাংবাদিকতা করি না। মনের ভাল লাগা আর আত্মিক সুখের তাড়নায় সাংবাদিকতা করি। আর সে কারণেই বলেছি যতদিন সাংবাদিকতা করবো, ততদিন কেবল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেই সাংবাদিকতা করতে চাই।”

দেশের অনলাইন সাংবাদিকতার আমূল পরিবর্তন হয়েছে তা কেবল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বর্ণিল সাংবাদিকতার কারণে।

লাখো পাঠকের আস্থার প্রতীক হয়ে সামনের দিনগুলো বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হোক এই প্রত্যাশা মনে ধারণ করি।

শুভ হোক দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক