জাপানের চিঠি: উপকার করা যে জাতির ধর্ম

দেশে থাকতে আমি যখন জাপানে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন নানা উৎকণ্ঠায় দিন কাটছিল। নতুন দেশে নতুন পরিবেশ আর সেই সাথে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার উত্তেজনাটা বাড়ছিল।

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Feb 2017, 09:35 AM
Updated : 6 Feb 2017, 10:33 AM

এইসবের মধ্যে আমি একদিন আমার ল্যাবের সেক্রেটারিকে মেইল করি। আমি বিনয়ের সাথে জানতে চাইলাম, বিমানবন্দরে আমাকে কেউ রিসিভ করতে আসবেন কিনা?

প্রত্যুত্তরে যা পেলাম, তা অনাকাঙ্খিত ছিল। ল্যাব থেকে মেইলে বলা হলো, আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে তোমাকে কেউ রিসিভ করতে যেতে পারবে না। সবাই ওইদিন ব্যস্ত থাকায় তোমার জন্য আমরা কাউকে দিতে পারছি না। তবে বিমানবন্দর থেকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা খুবই সোজা। তোমাকে আমরা এই অ্যাটাচমেন্টে কিছু ম্যাপ দিয়েছি, আশা করি তুমি আসতে পারবে। আর তা যদি না পারো, তাহলে যে কোন জাপানিকে বললে তোমাকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পথ দেখিয়ে দিবে।

কথাগুলো শোনার পর আমার মনের ভিতর কেমন জানি খোঁচা দিতো লাগলো। ঢাকায় যেখানে একজন অপরিচিত মানুষ প্রথম এসে কোন জায়গার কথা জিজ্ঞাসা করলে সঠিক উত্তর পাওয়া ভার আর সেখানে বিদেশে কাকে কী বলবো?

যাই হোক, মনের ভিতর সাহস সঞ্চয় করে বের হলাম শাহাজালাল বিমানবন্দর থেকে। এখানে বলে রাখা ভাল, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের এক শিক্ষকও আমার সঙ্গে ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসছিলেন। তাই বিমান ভ্রমণে দুইজনের মধ্যে বোঝাপড়াটা আরও পোক্ত হয়েছিল।

প্রায় এগার ঘণ্টার জার্নি শেষে পরের দিন সকালে কানসাই এয়ারপোর্ট নামলাম। বোর্ডিং শেষে আমি আর ওই ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষক লাউঞ্জে অপেক্ষা করছিলাম। কারণ উনাকে রিসিভ করতে উনার ল্যাবের এক শিক্ষক আসবেন। যেহেতু আমরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছি, তাই মনে মনে ভাবলাম উনার সেই শিক্ষককে অনুরোধ করবো যেন আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যান।

ছবি: রয়টার্স

অবশেষে ওই শিক্ষক যখন রিসিভ করতে আসলেন তখন আমি পাশে দাঁড়িয়ে। জাপানি ভদ্রলোকের নাম ওহাতা। এরপর উনার সঙ্গে পরিচয় পর্ব শেষ হলো। যখন জানতে পারলেন আমিও ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো এবং আমাকে কেউ রিসিভ করতে আসেননি তখন উনি নিজেই বলে উঠলেন, ‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড উইল গো উইথ আস?’

এই কথা শোনার পর তো আমি চমকে গেলাম। যেটা আমি বলবো সেটা উনি আগে বলে দিলেন। এই যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টির উপক্রম। আমাকে উনার গাড়িতে করে ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসলেন। এরপর আমার ইনস্টিটিউটে আমি যেতে পারবো কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। আমি আমতা আমতা করতেই উনি আবার বলে বসলেন, ‘লেটস গো টু ইউর ল্যাব।’

আমার কাছ থেকে প্রিন্ট দেওয়া ল্যাবের ম্যাপটি নিয়ে দুই জনে বের হলাম। উনাদের ল্যাব থেকে প্রায় দশ মিনিট হেঁটে হেঁটে মস্ত বড় ল্যাগেজটা নিয়ে ল্যাবের সামনে পৌঁছলাম। এরপর উনি ল্যাবের সেক্রেটারিকে আমার সঙ্গে পরিচয় করে দিলেন। মনে হলো, উনি আমার কত জনমের পরিচিত কেউ!

ওই ভদ্রলোক আমাকে ল্যাবে পৌঁছে দেওয়ার পর আমার ল্যাবমেটরা কেউ বিস্মিত হননি। ওদের সেইদিন দেখে মনে হলো এইটা ওহাতার দায়িত্ব ছিল।  বিদেশি হোক বা স্বদেশি হোক অন্যকে সাহায্য করতে পারা যেন জাপানিদের মজ্জাগত ধর্ম। প্রথম দিনই যে উপকার আমি জাপানির কাছ থেকে পেয়েছি তার অন্ত নেই। রাস্তায় বের হওয়া মানে জাপানিদের সাহায্য নেওয়া। এই জাতিকে দেখলে মনে হবে অন্যকে উপকার করাই এদের ইবাদত। এখানে আসার পর প্রতিদিনই তাদের সাহায্যের উপর নির্ভর করি।

একদিনের মজার ঘটনা বলি। এখানে আসার মাত্র এক সপ্তাহ পর সিটি কর্পোরেশনে ‘পরিচয়পত্র’ নবায়নের জন্য যেতে হবে। ল্যাবে আসার পর এই নোটিশ পাওয়ার পরই বের হলাম। নতুন জায়গা কিছুই চিনি না। ল্যাব থেকে কাউকে সঙ্গেও দেয়নি। অবশেষে একাই বের হলাম।

জাপানের সব রাস্তা একই ধরনের। একই ধরনের বাড়িঘরও। তাই রাস্তা চেনা বড় কষ্টকর। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিটি কর্পোরেশনের দূরত্ব আগেই ল্যাবের কম্পিউটারে দেখে নিলাম। রাস্তার ম্যাপে দেখলাম যে সিটি কর্পোরেশনটি আমার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাছে।  বাইসাইকেলে যেতে পাক্কা বত্রিশ মিনিট লাগবে বলে গুগল ম্যাপ বলে দিলো। তাই মনে মনে সাহস পেলাম, যেহেতু সিটি কর্পোরেশন আমার ছাত্রাবাসের কাছেই তাই যেখানে যেতে পারবো।

বের হলাম বাইসাইকেল নিয়ে।  জাপানের প্রতিটি রাস্তার পাশে বাইসাইকেল লেন রয়েছে। তাই সাইকেল নিয়ে যাচ্ছি আর ভাবছি যেতে পারবো তো?

ডরমিটরিতে যেতে যে রাস্তা ব্যবহার করতে হয় সেটাতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটি বাঁকে গিয়ে একই ধরনের রাস্তার ধরন দেখে কনফিউশন কাজ করলো। আমি মনের অজান্তে ভুল রাস্তায় পা বাড়ালাম।  রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি আর যাচ্ছি, কিন্তু সিটি কর্পোরেশন খুঁজে পাই না। প্রায় এক ঘণ্টা বাইসাইকেল চালানোর পর আমার হুশ হলো। এখনও পৌঁছলাম না কেন?

আমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম স্কুল ড্রেস পড়ে পনের-ষোল বছরের একটা ছেলে যাচ্ছে। ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ও কিছুটা লজ্জা পেল। জাপানিরা দ্রুত গতিতে ইংরেজি কথা বুঝতে পারেন না। আর আমার কথা বলার গতি বাংলা ও ইংরেজিতে সমান তালে চলে। তাই আমি ধীরে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সিটি কর্পোরেশন কোন দিকে?

ছেলেটি আমতা আমতা করতে লাগলো। আবার ঘড়ির দিকেও তাকালো। আমার কথায় কিছুটা ইতস্তত হয়ে আমার কাছ থেকে ম্যাপটি নিলো। এরপর প্যান্টের পকেট থেকে স্মার্টফোনটি বের করে জাপানিতে গুগল ম্যাপে টাইপ করলো।

ম্যাপ দেখিয়ে আমাকে আধা জাপানি আধা ইংরেজিতে বুঝানোর চেষ্টা করলো- এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পর বামে একটা রাস্তা, এরপর ডানদিকে মোড় নিয়ে রাস্তার ওপর সুপারশপ আর সিটি কর্পোরেশন। হেঁটে গেলে লাগবে চল্লিশ মিনিট।

ছবি: রয়টার্স

আমি তো অবাক হলাম। এমনিতে আমার কাছে সব রাস্তা একই মনে হয়, সেখানে এতো বাঁক নিয়ে যাওয়া আমার কাছে অসম্ভবই বটে।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায়ত্বের ছাপ বুঝতে পেরে ছেলেটি স্কুলে যাওয়ার রাস্তা ঘুরে আমাকে নিয়ে বের হলো সিটি কর্পোরেশনের উদ্দেশ্যে। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আর মনে মনে ভাবছি, ইস এই বেচারা না থাকলে কী হতো আমার?

এরপর আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো। সেই বললো, জুনিয়র হাই স্কুলে। বিশ মিনিট হাঁটার পর ফের তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে পৌঁছে দিয়ে সে ক্লাস করতে পারবে কি না?

ছেলেটি একটু মিনমিনয়ে বললো, সাড়ে দশটায় তার একটা পরীক্ষা আছে। আমি ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলাম দশটা পনের মিনিট। ইয়া মসিবত। ও এখন যদি স্কুলে যাওয়ার জন্য ফিরে যায় তবুও তো পরীক্ষা ধরতে পারবে না।

নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হলো। আমি সরি সরি বলছি আর ওই ছেলেতো লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। ও বললো, আপনি আমাদের অতিথি আর আপনাদের সাহায্য করতে না পারলে আমার দেশের দুর্নাম হয়ে যাবে।

আপনি চলুন, আপনাকে সিটি কর্পোরেশেনে পৌঁছে দিয়ে আসি। আমি তাকে থামানোর চেষ্টা করলাম। বললাম, আমি অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করে সিটি কর্পোরেশনে পৌঁছে যাব। কিন্তু না, ছেলেটি শুনলো না। আমাকে বললো, আপনি তো রাস্তা চিনেন না। আপনি যেতে পারবেন না। আমি স্কুলে পরে যাব।

আমরা যখন সিটি কর্পোরেশনে পৌঁছি তখন ঘড়ির কাঁটায় দশটা বেজে চল্লিশ মিনিট। আমাকে সিটি কর্পোরেশনে নিয়ে গিয়ে কর্মকর্তাদের সাথে জাপানি ভাষায় কথাবার্তা সারলো। আমি অবাক হয়ে তার কার্যকলাপ দেখছি।

আমার কাছ থেকে ডকুমেন্টগুলো নিয়ে সে কাজ কমপ্লিট করে দিলো। এরপর বললো, আপনি যে পথে এসেছিলেন সেই পথে যেতে পারবেন তো?

আমি কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেলাম। আমি সহসা বলে দিলাম, হুম পারবো। এরপর বললো, আপনি তাহলে যান। আমি যাওয়ার আগে তার নামটি জিজ্ঞাসা করলাম। ছেলেটির নাম ছিল ‘হিরোশি ওকায়দা’। জাপানি ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে আমাকে ‘আরিগাতো গুজাইমাস’ (ধন্যবাদ) জানালো। আমিও ধন্যবাদ দিলাম।

সাইকেল নিয়ে যাওয়ার সময় পিছনে তাকিয়ে দেখি ছেলেটি একটা টাক্সিকে দাঁড় করিয়েছে। ও টাক্সি করে চলে গেল স্কুলে।

দুই বছরের বেশি সময় এই দেশে থাকার সময় প্রতিদিন কিছু না কিছু সাহায্য জাপানিদের কাছ থেকে নিতে হয়। আপনি যখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক খুঁজবেন তখন জাপানিরা নিজে এসে বলবে আপনি কী খুঁজছেন? কিংবা বলবে, মে আই হেল্প ইউ? সিংহভাগ জাপানিদের রক্তে মিশে গেছে অন্যের উপকার করা।

এই জাতি যেন অপরকে সাহায্য করে সুখ অনুভব করে। জাপানে আছেন অথচ জাপানিদের সাহায্য নেন না এমন প্রবাসী খুব কমই আছে। অফিস থেকে রাস্তাঘাট সর্বত্র জাপানিরা আপনাকে পথঘাট কিংবা নিজে নিয়ে গিয়ে সেই স্থানগুলোতে পৌঁছে দেবে।

যারা ইংরেজি বলতে পারেন না, তারাও আপনার সঙ্গে কথা না বলেই আপনার কাঙ্খিত স্থানে পৌঁছে দিতে একবিন্দু কুণ্ঠাবোধ করবে না। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে স্টেশনে গিয়ে কোন কারণে টাকা ফুরিয়ে গেলে কিংবা ম্যানিব্যাগ বাসায় রেখে গেলে জাপানিরা নিজে টিকেট কেটে দিয়েছে।

জাপানের শুরুতে একটা স্কুল পড়ুয়া শিশুর কাছ থেকে এইভাবে সাহায্য পাবো তা কল্পনা করিনি। আমার জন্য সে পরীক্ষা দিলো না। মনের ভিতর এক ধরনের কষ্টের দাগ অনুভব করলাম। একটা শিশু যদি এইভাবে একটি দেশের সম্মানের জন্য নিজের সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে পারে তাহলে আমি বা আমরা কী করি?

জাপানিদের রন্ধে রন্ধ্রে জীবনের শিক্ষা লুকিয়ে আছে। আমি প্রতিনিয়ত সেই শিক্ষা নেই। মনে মনে ভাবি বাঙালি জাতি যেন জাপানিদের কাছ থেকে অপরকে সাহায্য করার এই শিক্ষাটা শিখে। যে শিক্ষা মানুষকে মানবিক করে গড়ে তোলে এমন শিক্ষা গ্রহণ করতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে?

ঠেকছি, শিখছি। জাপানিদের স্ট্রিট হেলপিং করার যোগ্যতা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে আছে বলে মনে হয় না। তাই যতই দিন যাচ্ছে, এই দেশর কৃষ্টি-কালচার আর নৈতিকতার সাগরে ডুবে আছি। এমন পরপোকারি জাতি যদি ‍পৃথিবীর সব দেশেই থাকতো, তাহলে সহনশীলতা নিয়ে মানবজাতি হয়ে উঠতো পৃথিবীর সব প্রাণীর জন্য উদার আশ্রয়স্থল।

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক

ই-মেইল: nadim.ru@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!