সত্যিই আমি একটা ভাস্কর্য স্থাপনের অনুরোধ জানাচ্ছি বাংলাদেশ সরকারের কাছে। এমন ভাস্কর্য ছিচল্লিশ বছর আগেই হওয়ার কথা, আমার মস্তিষ্কে এই ধারণা গত কয়েকদিন ধরে লাফালাফি করছে।
তবে কেন এই দাবি করছি, তা বলার আগে পাঠক চলুন একটু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ঘুরে আসি। এরপর না হয় বলা যাবে আসলে আমাদের ভাস্কর্য স্থাপন করার প্রয়োজন কিনা!
গত শুক্রবার সকালে হঠাৎ করেই একটি সংবাদ জাপানসহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রধান খবরগুলোর মধ্যে স্থান করে নেয়। জাপানের রাষ্ট্রদূত দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া সংক্রান্ত ওই সংবাদটি দেখে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
প্রতিবেশি দেশ হিসেবে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক এখন ভালোই বলা চলে। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে এ কারণে কখনোই কূটনীতিক সম্পর্ক নষ্ট হয়নি জাপানের।
তবে সংবাদটি বিস্তারিত পড়তেই জানতে পারলাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বির্তকিত ভূমিকার জন্য জাপানের প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া ও বড় অংকের অর্থ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা আসার পরও মূলত 'যৌনদাসী' নামের সিরিজ ভাস্কর্যের কারণে সিউল-টোকিও সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।
তথ্য ঘেঁটে পেলাম, ১৯৩০ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে দক্ষিণ কোরিয়ার পেননুলিসিয়া অঞ্চলে পূর্ব এশিয়ার ফিলিপাইন, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে যুবতীদের ধরে নিয়ে জাপান সম্রাটের সৈন্যরা দাস বানিয়ে রেখেছিল। ইতিহাসবিদের হিসাব মতে প্রায় ২ লাখ নারীকে জাপানি সৈন্যরা দীর্ঘদিন যৌনকর্ম ও ঘরের কাজে লাগিয়েছিল।
এদের মধ্যে প্রায় ৪৬জন দক্ষিণ কোরিয়ার নারী বেঁচে আছেন যাদের অধিকাংশের বয়স নব্বইয়ের বেশি। ১৯৯২ সাল থেকে প্রতি বছরই সেসব যৌনদাসীদের সঙ্গে কোরিয়ার সাধারণ মানুষ জাপান দূতাবাসে স্থাপিত ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ করেন। পুরো দক্ষিণ কোরিয়াজুড়ে এমন প্রায় ৩১টি ভাস্কর্য রয়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমগুলোর খবরে জানা যায়।
'যৌনদাসী' ভাস্কর্যকে ঘিরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে টোকিওর বিতর্কিত ভূমিকার কথা সব সময় অপমানের চোখে দেখা হয়।
এদের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে জাপান দূতাবাসের সামনে ‘যৌনদাসী’র প্রতিরুপি একটি ভাস্কর্য তৈরি করা হয়।
এর মধ্যে গত বছর ২৮ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে জাপান কনসুলার ভবনে আরেকটি স্বর্ণনির্মিত ‘যৌনদাসী’ ভাস্কর্য স্থাপন করার মধ্য দিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়।
এর আগে ১৯৯৩ সালে তৎকালীন মন্ত্রী পরিষদের মুখ্য কর্মকর্তা ইয়োই কোনে একটি বিবৃতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সৈন্যদের দ্বারা যেসব নারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের অর্থ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেন।
এর জন্য জাপান সরকার গোপনে নাম সংগ্রহ করছেন বলে তিনি জানান। বিবৃতিতে জাপানি সৈন্যদের ব্যক্তিগত দোষের খেসারত দক্ষিণ কোরিয় নারীদের দিতে হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। জাপানের পক্ষ থেকে একটি ক্ষমা প্রার্থনার চিঠি দেওয়ার কথাও বলা হয়।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই ঘোষণায় দক্ষিণ কোরিয়া সায় দেয়নি। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ও কোরিয় প্রেসিডেন্ট পার্ক গাইন দুই দফা এই বিষয়ে আলোচনা করেও সফল হতে পারেননি। ২০১৩ সালে পুনরায় 'যৌনদাসী'দের বিষয়ে আলোচনা হয়। ওই সময় জাপানের পক্ষ থেকে সিউলের দূতাবাসের সামনে স্থাপিত ওই ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা ভেস্তে যায়।
তবে ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর শিনজো আবে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে আলোচনায় আসে ‘যৌনদাসী’ বা ‘কমফোর্ট উইমেন’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি ভুলে থাকার জন্য এমন বড় অর্থ সহায়তা যুদ্ধাপরবর্তী সময়ে বিশ্বে খুব কম দেশই করেছে।
কিন্তু না, দক্ষিণ কোরিয়াবাসী তা ভুলতে চায় না। তারা অর্থের কাছে ইতিহাসকে দমিয়ে রাখার বিপক্ষে। বরং বুসানে জাপান কনসুলার ভবনে সোনার যৌনদাসীর মূর্তি বানিয়ে নতুন করে বির্তক তৈরি করে। দেশপ্রেমের কাছে কোন কিছু মাথা নত করতে পারে না, দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ মনে হয় বুঝিয়ে দিচ্ছে জাপানকে।
দক্ষিণ কোরিয়া চায়, এই ধরনের মূর্তি দেখে যেন জাপানিরা তিলে তিলে কষ্ট পাক। নিজেদের পৈশাচিক আচরণের কালো অধ্যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বহন করে নিয়ে যাক। আর সেই জন্য সম্প্রতি দেশটির প্রেসিডেন্ট পার্ক গেইনকে অপসারণের আন্দোলনে অনেকের মুখে এমন স্লোগান ছিল। ইতিহাস কখনো গলাটিপে হত্যা করা যায় না, তার প্রমাণ দিতে দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ‘যৌনদাসী’ স্বীকৃতি অক্ষুণ্ণ রাখতে রাস্তায় নামতেও ভুল করেনি।
দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমি অনুভব করছি, আমরাও পাকিস্তানকে শিক্ষা দিতে এই ধরনের ভাস্কর্য ঢাকায় পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে তৈরি করতে পারি।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে দুই লাখ নারী বিবস্ত্র ও সম্ভ্রমহানি হারানো আমাদের ‘বীরঙ্গনাদের’ স্মৃতি অম্লান করতে তাদের আদলে পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে ভাস্কর্য স্থাপন করা হোক।
এই ভাস্কর্য দেখে জাপানের মতো পাকিস্তানিরা যেন তিলে তিলে কষ্ট পায়।না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নারীদের যৌনদাসীতে বাধ্য করার অপরাধবোধে জাপান প্রকাশ্য ক্ষমা চেয়েও মাপ পাচ্ছে না। অথচ ১৯৭১ সালে ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা ও দুই লাখ কিংবা চার লাখ নারীকে ধর্ষণ করার পর আমরা কেন পাকিস্তানকে ছাড় দিবো? পাকিস্তান কী ক্ষমা চেয়েছে?
জেনেভা কনভেনশন চুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু আমরা আজও পাকিস্তানিদের বীরদর্পে চলা রুখতে পারিনি। বরং তারা এখন পর্যন্ত মানতে রাজি হয় না যে, তাদের সৈন্যরা আমাদের মা-বোনকে ধর্ষণ করেছে, পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে উল্লাস করছে। বরং ওই গোষ্ঠী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে বির্তকিত বার্তা দিয়ে বাংলাদেশকে হুমকি দিয়েছে।
বাংলাদেশে পাকিস্থান দূতাবাসের সামনে ‘বীরঙ্গনা ৭১’ নামের এমন ভাস্কর্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম দেশপ্রেমের অম্লান স্মৃতি হিসেবে বাঙালিদের ইতিহাস বহন করবে।
তেমনি পাকিস্তানি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিদিন একটু একটু করে লজ্জার তীব্রতা অনুভব করবে। যতদিন পাকিস্তান প্রকাশ্য ক্ষমা চাইবে না ততোদিন এমন ভাস্কর্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিনিধিত্ব ধরে রেখে পাকিস্তানিদের নির্যাতন ও নৃশংসতা তাদের নিঃশ্বাসের বাতাসকে ভারি করে তুলবে।
তাই আমি বাংলাদেশ সরকারসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে অনুরোধ করবো,এমন একটি ভাস্কর্য পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে করা যায় কি না একটু ভাবুন।
লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক
ইমেইল: nadim.ru@gmail.com
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |