ক্রিকেটে বাঙালিদের চিনছে জাপানিরা

জাপানিজ ভাষায় ক্রিকেটকে বলা হয় ‘ক্রিকেতোও’। আর এই ক্রিকেটের সুবাদেই ক্রমে বাংলাদেশিদের গভীরভাবে চিনছে জাপানিরা।

এস এম নাদিম মাহমুদ,জাপান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Nov 2016, 11:29 AM
Updated : 16 Nov 2016, 11:29 AM

প্রবাসী বাঙালিদের কাছে জনপ্রিয় হলেও জাপানিদের কাছে ক্রিকেট একটি অপরিচিত শব্দই বটে। আর তা জাপানিদের কাছে তুলে ধরতেই পরিচয় মেলে বাঙালিদের সাথে ক্রিকেটের আত্মিক সম্পর্কের।

প্রবাসে শত ব্যস্ততার মাঝেও ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসাটার টানে নিয়মিতই চলে অনুশীলন। ওসাকায় অবস্থিত বাংলাদেশিদের এই ক্রিকেটের গল্প শুরু হয় প্রায় বছর দেড়েক আগে থেকেই। সপ্তাহে একদিন ছুটি পেলেও তা যেন বাঙালিদের ক্রিকেট খেলার দিন। 

ছোটবেলায় পাড়ায় কিংবা স্কুলে ক্রিকেট খেলা হত অনেক। বেড়ে ওঠার সাথে সাথে ব্যস্ততার কারণে ক্রিকেটের সাথে বাড়ে দূরত্ব। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পার করে অনেকেই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা ডাক্তার। দীর্ঘদিনের বিরতিতে ক্রিকেটের সেই পুরাতন স্মৃতি যেন আবার সামনে এসেছে। এ যেন কৈশোরের সেই দুরন্তপনার গল্প।

ওসাকায় এই ক্রিকেটের শুরুটা হয়েছিল গত বছর বুয়েটের মেরিন বিভাগের শিক্ষক জুবায়ের ইবনে আওয়াল ও বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত ইয়াসিন আদনানের হাত ধরে।

এই দু’জন সম্প্রতি জাপান ছাড়লেও ওসাকার বাঙালিদের ক্রিকেটের প্রতি টান থেমে থাকেনি। জাপানে ক্রিকেটের কোন সরঞ্জামাদি না থাকলেও দেশ থেকে আনা ব্যাট, উইকেট আর গ্লোভসের কল্যাণে সুদূর প্রবাসেও ক্রিকেট খেলা হয় নিয়মিত।

আমরা শুধু অনুশীলনের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখিনি। আশেপাশের শহরগুলোর সাথেও চলে নিয়মিত প্রতিযোগিতা। 

এরই ধারাবাহিকতায় গত রোববার ওসাকা প্রদেশের সাথে গিফু প্রদেশের প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে হয়ে গেল এক ক্রিকেট প্রতিযোগিতা। ওসাকার ক্রিকেট টিমের নাম ‘ওসাকা ওয়ারিয়র’ আর স্বাগতিক গিফুদের দলের নাম ‘বেঙ্গলি ওয়ারিয়র’। ভেন্যু হিসেবে নির্ধারণ করা হয় ওসাকা থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে ‘নারা’ শহর। মন্দিরের শহর নামে পরিচিত শহরের ‘নারা ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা নাইস্ট’ মাঠে চলে দিনব্যাপী এই ক্রিকেট প্রতিযোগিতা।

ওসাকা দলে খেলেছিল- সৌরভ রায়, আরিফ নিক্সন, গুলজার হোসেন, সাইফুল ইসলাম, বিজন মোহন চাকী, আকাশ হোসেন,অসীম কুমার সাহা, আশরাফ আল মামুন, সুমন চন্দ্রনাথ, জাগতিশ, জ্যোতিশ, আলফাজ হোসেন, রানতিঙ্গ ও এস এম নাদিম মাহমুদ।

গিফু দলে ছিল-

ইকরাম, আরিফ, মামুন, রিগান, হাসান, মেহেদি, সাদেক, নাঈম, শুভ, সিয়াম, ফারহান, নিজাম, ওয়ালিউল্লাহ ও হিরু আলম।

পনের ওভারের এই খেলায় প্রথম ম্যাচে গিফু প্রদেশ ২৫ রানে জয়যুক্ত হয়। তারা ১১৫ রান তোলে। জবাবে ওসাকা ওয়ারিয়র ৯০ রান করে। এই ম্যাচে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ নির্বাচিত হন রিগান। আর তাকে পুরস্কৃত করে ওসাকায় অবস্থানরত ব্যবসায়ী নিজাম, রায়হান ও রফিক। 

মধ্যাহৃভোজের পর দ্বিতীয় ম্যাচের পুরোটাই দখলে ছিল ‘ওসাকা ওয়ারিয়রে’র। তারা পনের ওভারে ৯০ রান তুললেও গিফুর ব্যাটসম্যানরা ধরাশায়ী হয়। তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ ম্যাচগুলোর দর্শক হিসেবে ছিলেন বেশ কিছু জাপানি নাগরিক। 

তিন স্ট্যাম্প আর ব্যাট-বল দেখে অনেক জাপানিই ছুটে আসে আমাদের খেলা দেখতে। দেশটিতে বেইজ বল খেলা আর আমাদের ক্রিকেট খেলার যথেষ্ট মিল দেখে অনেকেই অবাক হয়ে যেত। তারা ভাবতো, আমরা বেইজবল খেলছি। কিন্তু কয়েক মিনিট খেলা দেখার পর অধিকাংশ জাপানিরা জিজ্ঞাসা করতো, আমরা কি খেলছি?
যথারীতি উত্তর পেয়ে জাপানিরা চোখ তুলতো কপালে। কারণ তারা ক্রিকেটের সাথে তেমন পরিচিত নয়। দেশটির পত্রিকাগুলোতে আমি এখন পর্যন্ত ক্রিকেট নিয়ে কোন প্রতিবেদন করতে দেখিনি। তাই এটাই স্বাভাবিক। আমরা যেমন বেইজবল-রাগবি চিনি না, ঠিক তারাও এখানে ক্রিকেটের সাথে অপরিচিত। তাই তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হত কীভাবে ক্রিকেট খেলা হয়।

এই তো রোববার এক ভদ্র মহিলা তার তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিলেন। মাঠে আমাদের খেলা দেখে তাদের কৌতুহলের পাল্লাটা আরো এক ধাপ বেড়ে গেল। শিশুদের আগ্রহের প্রশ্ন তিনি ছুড়লেন আমাদের দিকে। ‘ক্রিকেতো’ বলতেই বলে উঠে ‘সুগোয়নে’ মানে ‘সুন্দর’।

অনেক সময় বয়োবৃদ্ধদের দেখতে পাই তারা ক্রিকেট বলটাকে হাতে নিয়ে দেখতে। বেইজবলের সমতুল্য হওয়ায় অনেক সময় বলে উঠে ক্রিকেট তো বেইজবলের মতোই।

পরিবার ছেড়ে প্রবাসে এসে ক্রিকেটকে অনেক বাঙালি তাদের অবসর সময় কাটানোর অনুষঙ্গই মনে করে। ক্রিকেটের মাঝে যেন ফিরে পেতে চায় তাদের হারানো কৈশোর।

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক

ইমেইল: nadim.ru@gmail.com