জাপানের চিঠি: বিদেশিদের বাংলা শিখিয়ে একুশ পালন

জাপানে আসার পর গত দুই বছরই বাঙালি কমিউনিটিতে একুশ পালনের সুযোগ মিলেছে। তবে এইদিনগুলোতে ছুটি না থাকায়  কিছুটা ম্রিয়মান সময়ও কেটেছে।

এস এম নাদিম মাহমুদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Feb 2017, 03:34 PM
Updated : 22 Feb 2017, 09:33 AM

মঙ্গলবার নিয়মিতভাবেই সকাল আটটায় ঘুম ভাঙে। বিছানা ছেড়ে মোবাইলে ইউটিউব থেকে জাতীয় সংগীতের মধ্যে দিয়ে দিনটি শুরু করলাম। অন্যন্য দিনের চেয়ে কিছু ভিন্ন আঙ্গিকে শুরু হওয়া ২০১৭ সালের একুশ অন্যতম স্মৃতি হতে শুরু করেছে।

আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স অধ্যয়ন করছি সেই কোর্সের সবাই বিদেশি। তাই আমাদের পাঠ পদ্ধতিও ইংরেজিতে। অবশ্য সিলেবাসে জাপানিজ ভাষা কোর্স ঢুকিয়ে দিয়েছে। যদিও মূল কোর্সের সাথে সামঞ্জস্য নেই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ চুকিয়ে কোন বিদেশি ছাত্র যেন জাপানে চাকরি করার সুযোগ পায় সেজন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

ইংরেজি টিওইএফএল, আইএলটিএস অনুকরণে জাপানিজ লাইঙ্গুয়েজ প্রোফেয়েন্সি টেস্ট (জেএলপিটি৪), যা বছরেই দুইবার করে সমগ্র জাপান জুড়ে নেওয়া হয়।

আপাতত দৃষ্টিতে ভাল মনে হলেও পড়তে গিয়ে আমরা বুঝছি ভিনদেশি ভাষা কতোটা কঠিন আর দুর্বোধ্য। আমাদের মতই স্বরবর্ণগুলোকে এদের ভাষায় 'হিরাগানা' এবং ব্যঞ্জনবর্ণরুপি 'কাতাকানা' রয়েছে। যদিও 'কাতাকানা' ইংরেজি শব্দগুলোকে কিংবা বিদেশি ব্যক্তির নাম কিংবা প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম লিখতে ব্যবহৃত বেশি।

আর সেই সাথে এই দেশের ভাষাতে সেই শুরুতে প্রায় দুই হাজারের বেশি চাইনিজ যুক্তাক্ষর অনুকরণে 'কাঞ্জি' ঢুকে পড়েছে। মূলত এই 'কাঞ্জি' পড়তে গিয়ে যত ঝামেলাটা বাঁধে।

ল্যাবে যদিও সবাই ইংরেজিতে কথা বলে, সেমিনারেও তাই, তবু মাঝে মধ্যে জাপানিজ শব্দ পড়তে বা লিখতে গিয়ে মাতৃভাষার মহাত্ম্য বুঝি!

জাপানিজ পড়তে গিয়ে অনেক ভিনদেশি শিক্ষার্থীর মুখেই শুনেছি কষ্টের কথা। পড়তে না পারার ব্যাথা। আমি নিজেও সেই পথের যাত্রী।

যাহোক এবার জেলপিটিএন৪ পরীক্ষা দিয়ে ১৪ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমরা মাত্র তিনজন উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলাম। বাকিরা পাস না করলেও, ডিপার্টমেন্ট কড়া শাসনে শেষ পর্যন্ত পাশ করিয়ে ছাড়বে বলে কয়েকদিন আগে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।

আমি যখন জাপানিজ শিখি তখন মাঝে মধ্যে ল্যাবমেটরা আমাকে প্রশ্ন করে বসতো। একই জাপানি শব্দের বিভিন্ন ধরনের উচ্চারণ থাকায় মাঝে মধ্যে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে জটিলতায় ভুগতাম।

আর ওরা বলতো, জাপানি ভাষা সবচেয়ে সহজ। এই ভাষা যে কেউ শিখতে পারে। এই কথাগুলো শুনে মুখে বিড়বিড় করতাম- ব্যাটা মাতৃভাষা কোন দেশের নাগরিকের কাছে সহজ লাগে না, শুনি?

আর তখন মনে ইতো, ইস  অনুভব করতাম, যদি এদেরকে একটু বাংলা শিখিয়ে দিতে পারতাম তাহলে জীবনটা সার্থক হতো। তখন ব্যাটারা হাড়ে হাড়ে টের পেতো ভাষা শেখা কতটা কঠিন!

যাই হোক অবশেষে এবার একুশে ফেব্রুয়ারি আমার জীবনে সেই শুভ দিনটি এলো। অকস্মাৎ মাথায় আইডিয়া ঘুরপাক খেলো।  একুশ যখন ঠিকমতো পালন করতেই পারছি না, তখন ল্যাবে পালন করলে কেমন হয়?

সকালে ল্যাবে এসেই একটা সাদা কাগজে বাংলায় ল্যাবমেটদের নাম লিখলাম। সেই সাথে বাংলায় একুশের আঙ্গিকে অ, আ, ই, ঈ, ক, খ, গ। যাতে করে সহপাঠিরা নিজেদের নাম বাংলা উপহার হিসেবে পায়, সেই সাথে তাদের নামের নীচে কিছুটা ফাঁকা জায়গা রাখলাম।

ল্যাবমেটদের ১৯৫২ সালের এই ২১ ফেব্রুয়ারিতে কী ঘটনা ঘটেছিল তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বর্ণনা করলাম। সব শুনে ওরা তো অবাক হয়ে গেছে। ভাষার জন্য কেউ যে আন্দোলন করে তা তাদের অজানাই ছিল।

আমরা যে বাংলা ভাষায় কথা বলি, তার ইতিহাস যে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটি তারা বুঝতে পারলো। একই সাথে এই দিনে পুরো বাংলাদেশেই ‘শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক দিয়ে' শ্রদ্ধা জানানোর ব্যাপারটিও বর্ণনা করলাম।

সব শুনে ওরা বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানালো। এরপর আমি প্রথমেই এক ল্যাবমেটকে ওই সাদা কাগজেই বাংলা ঢেকে রেখে জাপানিজ ভাষায় লিখতে বললাম। কয়েক সেকেণ্ডেই সে নিজের নাম 'কাঞ্জি'তে লিখে ফেললো।

এরপর বললাম- বাংলায় লেখা বর্ণগুলো নিয়ে লিখতে। ইংরেজিতে অনেকটা 'সিলেবল' পড়ার মতো করে বিভক্ত করে লেখায় ওরা কিছুটা বুঝতে পারলো কোনটি বাংলায় কী বর্ণ!

যাই হোক হাতে কলমে নাম লেখানো শিখালাম। নিজেরা বাংলা নাম লিখতে পেরে চোখে-মুখে উচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে গেল। এবার ওই ল্যাবমেট বললো, "তোমার ভাষা এতো কঠিন কেন? এই ভাষা কীভাবে তোমরা কথা বলো আর লেখো? এতো দেখছি আমাদের কাঞ্জি থেকেও কঠিন।"

আমি তখন বললাম, "বাংলা হচ্ছে সবচেয়ে সহজ ও মধুর ভাষা। এই যে আমরা কত দ্রুত তোমাদের নাম লিখতে পারি!"

এরপরও একইভাবে আরও কয়েকজন জাপানিকে নিজেদের নাম বাংলায় লিখালাম।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, ওরা সবাই কেন যেন বলছে, আমাদের ভাষা নাকি খুব কঠিন। ওরা নাকি শিখতেই পারতো না।

আমার ল্যাবে ইন্দোনেশিয়ার ইয়েমিমা নামের এক মেয়ে এবং ভিয়েতনামের ট্রান কোয়াং নামের এক ছেলেও আছে। ছেলেটি আমার ডেক্সের পাশেই বসে। তাদেরকেও বাংলায় নিজেদের নাম লেখানো থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলনের ইতিবৃত্ত শুনিয়ে দিতে হলো।

পরে আমার সামনেই ভিয়েতনামের সহপাঠি গুগলে ভিয়েতনামিজে বাংলা ভাষার ইতিহাস উইকিতে পেলো। ১৯৫২-তে  পুলিশ যে গুলি চালিয়ে রফিক, সালাম, বরকতদের হত্যা করেছিল তাদেরও নাম পেলো।

ও তো একবারে চিৎকার দিয়ে বলেই ফেললো, "নাদিম তোমাদের  ভাষা তো দেখছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কো স্বীকৃতিও দিয়েছে। এতো বড় ধরনের ইতিহাসই দেখছি। স্যালুট তোমাদের বাংলা ভাষাকে। এই ভাষার জন্য যারা নিহত হয়েছে তাদেরকে তোমরা যে যুগ যুগ ধরে স্মরণ করছো তা পৃথিবীর কয়টা দেশই বা পারে?"

ইন্দোনেশিয়ান সহপাঠীও বাংলা ভাষার প্রেমে পড়ে গেল। সে জাপানি ভাষা শিখছে। তবে একবাক্যে বলেই ফেললো, বাংলা ভাষা জাপানিজ ভাষা থেকে কঠিন। সেই সাথে মধুরও বটে। এর বর্ণগুলো অদ্ভুত সুন্দর। বিভিন্ন রং চকোলেট দিয়ে ২১ তৈরি করে আমরা একুশ উদযাপন করলাম।

বিদেশিদের নিজের মাতৃভাষার ইতিহাস ও বর্ণ শেখাতে পেরে নিজের ভিতর কেমন জানি গর্বিত গর্বিত ভাব এসে গেল।

আমাদের এতো মধুময় ভাষা অন্যদের চোখে কঠিন হয়ে গেলেও তার সুবাতাস যে উচ্চারণে নিহিত তা আজ এদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছে, ইস আমরা কেন ইংরেজদের বাংলা শিখিয়ে দিতে পারিনি, তাহলে ব্যাটারা বুঝতে অন্যেদের উপর ইংরেজি চালিয়ে দিয়ে যে কষ্টটা দিচ্ছে তার পরিসীমা।

এক সময় আমরা জাপান ছেড়ে দেশে ফিরবো তখন এই স্মৃতি অম্লান হয়ে থাকবে। বাংলা আমার মা আমার আত্মার ভাষা। গর্বিত মা তোমাকে বুকে ধারণ করে ফুসফুসে বাতাস নিতে পারছি।

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash.bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!