বেশ উদ্বিগ্ন মনে হলো তাকে। পড়াশোনা রেখে গেলাম তার ডেক্সে। হাতে ছোট কী জানি নিয়ে বেশ ভাল করে পর্যবেক্ষণ করছে। আমি কাছে গিয়ে কিছু বলার আগে তিনি বলে উঠছেন, “নাদিম-সান তোমার কাছে ড্রপার আছে।” আমি তো হতবাক! ড্রপার কেন চায়?
এইবার তার হাতের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখি, একটা চড়ুই পাখির বাচ্চা। বেশ যত্ন করে ধরে রেখেছেন। ছোট্ট চড়ুই, কী অপূর্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। জাপানি ভাষায় ‘কাওয়াই’ (অপূর্ব সুন্দর) বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি এই পাখির ছানা কই পেলেন?”
তিনি বললেন, “আমি গাড়ি চালিয়ে ল্যাবে আসছিলাম। আমাদের ভবনের ঠিক নিচতলায় গাড়ি পার্কিং-এর কাছেই গাড়ি থেকে দেখলাম, ছোট কিছু রাস্তায় পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমি গাড়ি থেকে নেমেই দেখি এই পাখির বাচ্চা। সম্ভবত কোন গাছ থেকে এই ছানা পড়ে গিয়েছে।”
এরই মধ্যে পাখির বাচ্চাকে একটি তোয়ালের ওপর রেখে দেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ পর ওয়াস্ট পেপারের চিরকুট বিছিয়ে দেওয়া হলো। গ্লাসে পানি আনা হলো। আমার এক ল্যাবমেট বেশ যত্ন করে ড্রপার দিয়ে পানি খাওয়ালো। আর পানি খাওয়ানোর পরেই কিছুটা নড়চড়ে বসলো পাখিটা। তাতেই সবার চোখে আনন্দের ঝিলিক! মনে হয়, নতুন কিছু জন্মগ্রহণ করেছে!
উপর থেকে পড়ে যাওয়ায় পাখির একটি পা ভেঙ্গে গেছে। দাঁড়াতে পারছে না। তবে নড়াচড়াতে যে খুশির ভাব জাপানিদের মধ্যে দেখলাম, তাতে খুশি। এভাবে চললো ঘণ্টাখানেক। আমি ভেবেছিলাম, পাখিটিকে হয়তো তিনি এরপর জঙ্গলে রেখে আসবেন। কিন্তু না, তিনি তা করেননি।
দুপুরে খাবার শেষে ল্যাবে ফিরে দেখি, পাখিটিকে তিনি তার কোলের মধ্যে রেখে কম্পিউটারে কাজ করছেন। মনে হচ্ছে, কোন সদ্যজাত বাচ্চা কোলে নিয়ে তিনি কাজ করছেন। পরে শুনলাম, উনি পাখির জন্য খাবারও কিনে এনেছেন। যত্ন করে খাবার মুখে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। আহা, শান্তি! এ যেন মাতৃপ্রেম উছলিয়ে পড়ছে!
আমার কথা শুনে সে হেসে দিলো। এরপর বললো, “ধর তুমি ক্যাম্পাসে আসতে গিয়ে রাস্তায় দুর্ঘটনায় পড়লে। আমরা কী তোমাকে হাসপাতালে চিকিৎসা না দিয়ে ঘরে বসিয়ে রাখতাম, নাকি তোমাকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতাল ছেড়ে আসতাম?”
তিনি বললেন, “প্রাণ তো প্রাণই। তোমার যেমন অক্সিজেন নিতে হয়, তেমনি পাখিটিরও নিতে হয়। তোমার শরীরে যেমন বিপাকীয় ক্রিয়া হয়, তেমনি প্রতিটি জীবের মধ্যেই হয়। তাহলে কেন তুমি এই পাখিটিকে অবহেলা করবা? সে তো অসুস্থ। এই অবস্থায় তাকে ছেড়ে দেওয়া মানে মৃত্যুকূপে কাউকে ঠেলা মারা।”
আমি তার কথা শুনে লজ্জা পেয়ে গেলাম। আমি কী বলবো, তার ভাষা আমার জানা নেই। মাথা নীচু করে তার কথাগুলো মনযোগ সহকারে শুনলাম।
জাপানে মানুষের হাসপাতালের চেয়ে সামন্য কিছু সংখ্যায় কম হতে পারে পশু হাসপাতাল। এই দেশের প্রতিটি ছোট ছোট শহরের অন্তত ৪-৫টি করে পশু চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। এমন জাতির সন্তানরা মানুষের বাচ্চা হবে না তো কি আমাদের মতো চিকিৎসা না পেয়ে মরে যাওয়াদের না দেখার ভান করবে?
এই যে ধরুন না, কয়েকদিন আগে বৌদ্ধ পূর্ণিমার কথা। জাপানের ৯০ ভাগের বেশি মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়ার পরও এই দেশে বৌদ্ধ পূর্ণিমা উদযাপন করতে দেখিনি। ওইদিন সবাই নিজ নিজ কাজ-কর্ম নিয়ে ব্যস্ত ছিল। এই কয়েক বছরে এদের কোন ধর্মীয় ছুটি চোখে পড়েনি। অথচ এদের মন্দিরের সংখ্যা কম নয়। এরা মন্দিরে যায়, উপাসনাও করে। তবে মানব উপাসনাকে বেশি প্রাধান্য দেয়। মানুষের সেবার মধ্যে কিংবা কাজের মধ্যে ধর্মের শান্তি খুঁজে পায়। আর আমরা কী হই?
জীবপ্রেম যে সবচেয়ে বড় ধর্ম তা এই জাতি ভাল করে জানে। আপনি এই দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান, দেখবেন আপনি কয়েকদিনেই সুস্থ হয়ে উঠছেন। হাসপাতালের সেবিকারা কাউকে সুস্থ করে দিতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করে। এমনকি সেটাকে ধর্মের মধ্যে দেখে।
হ্যাঁ, এরা মানবপ্রেমে বুদ হয়ে আছে। পরকালের আশা এদের না থাকলেও ইহকালের নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে বিন্দুমাত্র লজ্জা করে না। মানবিকতার সাগরে ডুবন্ত এই নগরীতে তাই প্রশান্তির জয়গান।
লেখক: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জাপান প্রতিনিধি
ইমেইল: nadim.ru@gmail.com
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |