স্মরণকালের ভয়াবহ এই বন্যার খবর রাখতে প্রবাসে বসেও যেন কিছুতেই মন স্থির করতে পারছিলাম না। কয়েক মিনিট পরপরই বিডিনিউজে চোখ রাখছিলাম। আর মাঝে মধ্যে বাসায় ফোন দিয়ে এলাকার খবর জানছিলাম।
আমার শৈশব যে এলাকায় কেটেছে, সেই নওগাঁর বদলগাছীতে বন্যা বলতে গেলে প্রতি বছরই হতো। ২০০৫ সালে সম্ভবত এই এলাকায় বন্যা হওয়ার পর এবার যে বন্যা হয়েছে তার ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরেছি মায়ের কথায়।
আমি যখন জন্মেছিলাম, সেই আটাশির বন্যার চেয়ে ভয়াবহ বন্যা এবার উত্তরাঞ্চলে আঘাত হেনেছে বলে জেনেছি। এতো বড় বন্যায় যখন আমরা হাবুডুবু খাচ্ছি, তখন প্রবাসে বসে সংবাদপত্রের খবরে চোখের জল সিঞ্চন ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না।
আমাদের ছোটবেলায় যে বন্যা পেয়েছে, সেখানে দেখেছি- কীভাবে গ্রামের উঁচু বাড়িগুলোতে কিংবা ঘরের মধ্যে হাটু পানিতে পোকা-মাকড়, গরু-ছাগল, সাপ, মানুষ এক সাথে বসবাস করছে। খাদ্য সঙ্কটের দরুণ কীভাবে বাচ্চারা, বৃদ্ধরা কান্নাকাটি করে।
গবাদি পশুদের করুণ অবস্থা দেখে টের পেতাম প্রকৃতির নির্মমতা। মানবিক সংকটে ত্রাণ নিতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্যার পানির দিকে চেয়ে থাকা- কখন ত্রাণের নৌকা ভিড়বে!
কিন্তু আমরা যাদেরকে ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করেছি, যাদের উপর সমাজসেবার মতো ‘গুরু দায়িত্ব’ দিয়ে রেখেছি, তাদেরকে সময়মতো পাওয়া যেন অমাবস্যার চাঁদ হয়ে যায়। তাদেরকে নাগালে পাওয়া চরম ভাগ্যের ব্যাপার-স্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কথাগুলো অনেকটা ক্ষোভ আর হতাশার ছাপ থাকলেও, এটা নির্মম সত্য। বাংলাদেশে গত কয়েকদিন ধরে দেশের উত্তরাঞ্চল বন্যায় বসতবাড়ি আর ফসলি জমি যখন ভেসে যাচ্ছে, তখন আমরা আমাদের গণমাধ্যমে যে শিরোনাম পেয়েছি, সেখানে আমাদের দেশের সরকারি ও বিরোধীদলগুলো আদালতের কার্নিশে লুকোচুরি খেলছে। ক্ষুধায় আক্রান্ত কুড়িগ্রামের পরেশ চন্দ্র আর হাজিরনদেরকে বলতে হচ্ছে, ‘সকাল থাকি না খায়া আছং বাহে, মোর এ্যাহনা ইলিপের বেবস্তা করি দ্যান না ক্যাঁ?’
রাজনীতিবিদরা পিছিয়ে পড়লেও প্রধানমন্ত্রী পিছিয়ে নেই। তিনি দেশের প্রধান হিসেবেই কুড়িগ্রামে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব কি কেবল সরকারের? নাকি মহান সমাজসেবকদের?
আপনি-আমি কি বন্যার্তদের কষ্ট লাঘবের দায় এড়াতে পারি? দেশের এতো বড় বড় শিল্পপতি আছেন, বহুজাতিক কোম্পানি আছে, ব্যবসায়ী আছেন- তাদের কি বন্যার কষ্টের জল ছুঁতে পারে না? কিছু কথা বলার আগে আমি কয়েকটি বাক্য আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই।
গত বছর এপ্রিলে জাপানের কুমামতো প্রদেশে কয়েক দফা ভূমিকম্পে প্রায় অর্ধশত মানুষ মারা গিয়েছিল। একই সাথে কয়েক মাস উদ্বাস্তু ছিলো কয়েক হাজার মানুষ। এই ভূমিকম্পের সময় লক্ষ করেছি, এই অঞ্চলের মানুষদের ব্যবহৃত মুঠোফোনের কলচার্জ প্রায় মওকুফ করে দেওয়া হয়েছিল। ভাইবার ও ইন্টারনেট ছাড়া যেকোনো দেশে ফোন কল করার অনুমতি দিয়েছিল।
সবচেয়ে মজার বিষয় ছিলো, জাপানের মতো একটি উন্নত দেশ যার কিনা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি, যারা বিশ্বের যেকোনো মানবিক সহায়তায় সবার আগে এগিয়ে আসে, সেই দেশে ভূমিকম্পে আক্রান্তদের সাহায্য করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চাঁদা তোলা শুরু করেছিল। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, যেখানে অনেক বিদেশেও রয়েছে, তারাও স্বেচ্ছায় অর্থ তুলে কুমামতো ও কিয়ূশু এলাকার ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা দিয়ে আসছিল।
কয়েকদিন আগে খবরে এসেছে, দেশে সাত কোটি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। সেই হিসেব করেলে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। আমাদের দেশে মোবাইল ফোনগুলো যে পরিমাণ অর্থ আয় করে, তা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সামষ্টিক ব্যবহারের চেয়ে অনেক বেশি।
এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষজনকে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করতে হয়। আমাদের এই বহুজাতিক কোম্পানি যদি সত্যিই বাংলাদেশের জন্য কিছু কল্যাণকর কিছু করতে চায়, তাহলে তারা বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষদের জন্য কলচার্জ ফ্রি করে দিতে পারে। একই সাথে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে পারে।
দেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তারা যে ভোগ্যপণ্য কিংবা ব্যবহার্য পণ্য বিপণন করছে, এই বন্যায় আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব তাদেরও।
আমি ছোটকাল থেকে দেখে আসছি, আমাদের দেশে যেসব ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারা সব সময় দেশের সংকটময় পরিস্থিতিগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এমনকি এটাও দেখেছি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও তারা কিস্তির টাকা সংগ্রহ থেকে পিছপা হয় না।
দেশের সুনাম অর্জনকারী সেই নোবেল বিজয়ী ব্যাংকটিও ক্ষুধার্ত মানুষদের পাশে কালেভদ্র ভেড়ে। অথচ এরাই গরিব-দুঃখিদের অর্থ ফুলে-ফেঁপে ওঠে। নোবেল জয় করে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় লেকচার দিয়ে বেড়ালেও তার নিজের দেশে মানুষ যে খেতে-পরতে পারে না, তার হিসেব রাখে কে?
দেশের ২৭ জেলার ১৩৩টা উপজেলা ও ৪৩টি পৌরসভা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ১১ লাখ ৪১ হাজার পরিবারের ৫০ লাখ ১৮ হাজার ৭০৬ জন বানভাসি মানুষ আজ উদ্বাস্তু। ক্ষুধায় কাতর বানভাসি জনপদ। আমরা কেবল সরকারেরও উপর দায় দিয়ে নিজেদের দায় এড়াতে পারি না।
রাজনীতিবিদরা কেবল টেলিভিশনের বুমে প্রতিপক্ষদের আক্রমণ করতে জানে, কিন্তু তারা সাঁতার কেটে বানভাসি মানুষদের পাশে দাঁড়াতে বড়ই ভয় পান। জনপ্রতিনিধিরা ঢাকায় বসে টেলিফোনে হয়তো হুকুম দিয়ে খালাস পেতে চায়, তবে এই সময়টা বড়ই ভয়ানক। আপনি নিজেকে সমাজসেবী ভাবুন, মানবপ্রেমী ভাবুন আর দেশপ্রেমের কথায় ভুরিভোজ করেন, তাতে কিছু যায় আসে না। এই মোক্ষম সময়ে আপনি কতোটা উদার, তা বুঝতে বন্যার্তদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান।
ইতোমধ্যে অক্সফার্ম নামের সহায়তা সংগঠন তহবিল সংগ্রহ করা শুরু করেছে বলে তাদের ওয়েব সাইটে দেখতে পাচ্ছি। যেখানকার সংগৃহীত অর্থ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল আর শ্রীলংকায় দেওয়া হবে বলে তারা বলছে।
এই ক্ষেত্রে আমরা প্রবাসীরা তো পিছিয়ে পড়তে পারি না। আপনি ইচ্ছে করলেই দশটি মানুষের মুখে অনায়াসে খাবার তুলে দিতে পারেন। আপনার এলাকা হয়তো বন্যায় আক্রান্ত হয়নি, কিন্তু আপনার নিশ্চয় এই ২৭ জেলার মধ্যে কোনো না কোনো বন্ধু আছে। দয়া করে সেই বন্ধুর মাধ্যমে কিছু অর্থ সহায়তা দিন।
আমাদের হৃদয়ে গহীনে যে বাংলাদেশ আছে, সেই বাংলাদেশ আজ খাদ্যের জন্য হাহাকার করছে। নিজে খাবার গ্রহণের সময় একবার ওই বন্যা দুর্গত এলাকার শিশুদের মুখের দিকে চোখ বন্ধ করে দেখার চেষ্টা করুন। দেখবেন ,আপনি আর মুখে ভাত তুলতে পারছেন না। যারা কয়েকদিন ধরে বানের জলে ভাসছে, সেই সময় মানুষদের জন্য চোখের কোণে চিকচিকে জলই যে আমাদের দেশমাতৃকার প্রেমের আলিঙ্গন।
বিডিনিউজের ‘সিটিজেন জার্নালিজম’ বা ব্লগে লেখালেখি করেন, এমন কিছু স্বেচ্ছাসেবী বন্ধু আছেন। এই বন্ধুরা আমাদের হাজারও প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেওয়া সহায়তা তুলে বানভাসি মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারেন। সেইক্ষেত্রে সহায়তা সংগ্রহের দায়িত্বটা বিডিনিউজ কর্তৃপক্ষ নিতে পারে।
লেখক:
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জাপান প্রতিনিধি
ইমেইল: nadim.ru@gmail.com
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |