জাপানের চিঠি: মিথ্যার পেটে সত্যের ঈদ

‘মিথ্যা’ শব্দ সব সময় পাপার্জিত শব্দ হিসেবে মানব সমাজে উঠে এসেছে। হোক সেটা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কিংবা সমাজ গঠনের উপাদান, মিথ্যা সব সময় বর্জিত।

এস এম নাদিম মাহমুদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 June 2017, 03:45 AM
Updated : 26 June 2017, 03:45 AM

এইসব স্তরের উর্ধ্বে মাঝে মধ্যে মিথ্যা হয়ে ওঠে সত্য প্রকাশের নিরন্তর সঙ্গী। হ্যাঁ, আপাতত এই ঈদের দিনে অন্তত প্রবাসী বাঙালিদের মিথ্যা হয়ে উঠে আনন্দ প্রকাশের বাহক। হাজারও প্রবাসী মিথ্যার আড়ালে খোঁজে ঈদ আনন্দ।

রোববার মধ্যপাচ্যের সাথে তাল মিলিয়ে এশিয়ার বেশ কিছু দেশ ঈদের নামাজ আদায় করেছে। আর সেই হিসেবে সূর্যোদয়ের দেশ জাপানই বিশ্বে প্রথম ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয় বলে মনে করি। প্রবাসে বসে আমাদের ঈদের ফিরিস্তি লিখতে কিবোর্ডের কিছুটা শব্দ ক্ষয় করছি। যদিও আজকে আনন্দের দিন, এরপরও আনন্দের আড়ালে ভেসে থাকা মিথ্যার নিখুঁত গল্পগুলো তুলে ধরছি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ২০১৪ সালে অক্টোবরে জাপানে আসার পর থেকে আমি অন্তত  ছয়টি ঈদ পার করলাম। দিন, মাস, বছর পরিবর্তন হলেও প্রবাসে ঈদের রঙ যে অপরিবর্তনীয়, তা এখানে না আসলে বোঝা যেত না। ঈদ শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘খুশি’ আর এই শব্দটি ছোটকাল থেকে জেনে আসলে তার বাস্তবমুখী প্রয়োগ জন্মের আড়াই দশক ভোগ করে এসেছি।

শাহজালালে ঢোকার পর অনেকের সাথে মুসলমানদের ঈদ নামক ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি প্রবাসীদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়।  ধীরে ধীরে নিজ ও পরিবার আর্থিক দিক দিয়ে মোটাতাজা হলেও মনের ভেতরে শূন্যতা গুমরে মরে। যে শূন্যতার আড়ালে বড় হতে থাকে মিথ্যার আনন্দঘন মূহুর্তগুলো।

সারা বছর হৈ চৈ করে কেটে গেলেও মুসলমানদের পবিত্র এই উৎসবের আমাদের কষ্টের নীল রঙ আরও বেশি গাঢ়ত্ব ধারণ করে। প্রিয়জনদের ছেড়ে হাজার মাইল দূরে এইসব ঈদ হয়ে উঠে ‘মিথ্যা লেপনে মৃত আনন্দনগর’। অধিকাংশ বাঙালি ঈদের দিনগুলোতে খুশি খুঁজতে গিয়ে শিকার হোন হয়রানীর। কেউ মুখে বলতে না পারলেও মনের ভেতরে জমে থাকা এই আনন্দনগর হয়ে উঠে বিষাদের বিষে সিক্ত কোন মুহূর্ত।

আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে নওগাঁ জেলার প্রত্যন্ত উপজেলা বদলগাছীর ছোট একটি গ্রাম। মূলত হিন্দু, মুসলিম আর আদবাসীর বসবাস এ গ্রামে। আমার বাবার বাড়িটিও হিন্দু পাড়ায়। তাই বলা চলে সকল ধর্মীয় আনন্দগুলো ভাগাভাগি হয়। ঈদে আমার হিন্দু বন্ধুদের আর পূজায় আমাদের দাওয়াত যেন নিত্য সঙ্গী হয়েছিল। আর সেইভাবে ছোটকাল থেকে বাবা-মা, ভাই-বোনদের সাথে ঈদ করে এসেছি।

বাবা আর ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে ঈদে নামাজ পড়তে যাওয়া, বিকেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর সন্ধ্যায় বন্ধুদের বাড়িতে বাড়িতে দল বেঁধে গিয়ে খাওয়ার রেওয়াজ আমাদের বরাবরই ছিল। আর বাড়ি ফিরে হিন্দু বন্ধুদের আপ্যায়ন ঈদের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিতো। ঠিক এইভাবে কেটে যাচ্ছিল আমার দিনগুলো।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় এসেও কমেনি সেই আবেগ-অনুভূতির ঢেউ। কিন্তু যখন থেকে প্রবাসের খাতায় নাম লিখে ফেলছি, ঠিক তখন থেকে মনের অজান্তে এক ধরনের ফাঁপা আবেগ ডুব দেয়। যে আবেগটি নিমিষে হয়ে উঠছে স্বপ্নে আঁকা কোন এক তৈলচিত্র।

বন্ধুদের সাথে ঈদের দিনে আড্ডাবাজী যেন এখন মরুচীকার গোলকধ্বনি। এদের ছেড়ে কখনো দূরে গিয়ে ঈদ করেছি, এমন নজির নেই। কিন্তু জীবনের চরম ব্যতিব্যস্ততার মগডালে বসে ঈদের এই দিনগুলো কেন জানি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সূযালোক ছাড়া যেমন সালোকসংশ্লেষণ বিঘ্নিত হয়, ঠিক তেমনি প্রিয়জন ছাড়া ঈদের আনন্দ তপ্ত বালিতে পড়া এক বিন্দু জলকণা হয়ে যায়।

দেশে থাকা অবস্থায় যখন প্রবাসীদের ঈদের আনন্দের কথা ফেইসবুকে পড়তাম, তখন মনে হতো ‘ইস, তারা কত না মজায় আছে!’ কতটা উৎসবমুখর প্রবাসের ঈদ, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

গত এক বছর ধরে ছয়টি ঈদ পরিবার ছাড়া দেশের বাইরে করেছি। সারাটি বছর ভালোভাবে কেটে গেলেও এই ঈদের দিনগুলো যেন কাটতে চায় না। আমি মিথ্যা বলা কিংবা যে মিথ্যা বলে তাকে মনের অন্তরালে ঘৃণার পাহাড় তুলে দিই। কিন্তু ঈদ আসলে নিজেই যেন এই মিথ্যার সাগরে হাবুডুবু খাই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এ দিন মিথ্যার ফুলঝুড়ি নিয়ে বসতে হয়।

ঈদের কয়েকদিন আগে মা যখন কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফোন দিয়ে বলে, “বাবা, তুই ঈদে কিছু কেনাকাটা করিস।” বাবা যখন ভারী গলায় বলে, “ঘুম থেকে সকালে উঠে ঈদের জামায়াতের প্রস্তুতি নিয়ে ঈদে সালাত আদায় করিও।” ভাই-বোন যখন বলে, “তুমি ঈদ থেকে এসে কী রান্না করবা?”

তখন অবলীলায় মনের গাহনে এক ধরনের ঝড় বয়ে যায়। দুই নয়নে এক ধরনের সিক্ততা অনুভব করা যায়। তাদেরকে ‘হ্যাঁ-সূচক’ শব্দটি করলেও বাস্তবে হয়ে ওঠে উল্টো কাজ। ঈদের দিনগুলোতে ‘মা’ আমায় সুরমা লাগিয়ে দেয়। অনেক সময় মাথাটাও ঠিক করে দেয়।

ছোট-বোনকে সালামি দিয়ে বাবা আর ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ঈদগাঁও যাওয়ার যে লোভ, তা কীভাবে সামাল দিতে পারি? কিভাবে মা’কে বলি, মা তোমার হাতের মাংসের ভূনা আর রুটি যে আমার খুব খেতে ইচ্ছে করে? ভাই আর বোনকে কীভাবে বলি যে তোদের সাথে একটু দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করছে?

গত ঈদুল ফিতরে মা যখন কান্নাকাটি করছিল, তখন তাকে কিছুতেই সামলাতে পারছিলাম না। নিজের চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুকে লুকিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে, আমি ভাল আছি। অনেক আনন্দে আছি। অনেকে খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে।

আমি মনে প্রাণে মিথ্যা বলাকে ঘৃণা করি। আর তা কখনো পারিও না। তাই বরাবরই এই ঈদের দিনে অনাকাংক্ষিত প্রশ্নে মিথ্যা বলাতে ধরা খেয়েছি বারবার। এই তো সেই ঈদে, ছোট বোন যখন বলেছিলো, “তুই কী কী রান্না করেছিলি?” আমি তখন বেশ কিছু মিথ্যা গল্প শুনিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু না, সেটাও ধরা পড়েছি।

আমার এই দুরবস্থা থেকে আমাকে অনেকেই উপদেশ দিয়েছিল যে, এইসব বার্ষিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে কোনক্রমে পরিবারের সদস্যের কাছে দুর্বলতা দেখাতে নেই। যা করোনি, কিন্তু সেটা তোমার করা উচিত ছিল, তাও পরিবারকে বলবা- হ্যাঁ করেছি। যা খাওনি, কিন্তু ঈদের দিন তোমাকে জিজ্ঞাসা করা হলে ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে। তার কথার সারমর্ম হলো, তুমি ভাল নেই কথাটি যদি পরিবার বুঝতে পারে, তাহলে তোমার সাথে সাথে পুরো পরিবারের সদস্যদের খারাপ লাগা শুরু হবে। তোমার এই ক্ষণিকের মিথ্যা বলাই পারে তাদের ‘আনন্দ’ দিতে।

এটাকে পাপ বলা যাবে কিনা জানি না, তবে এই বিশেষ দিনে যে প্রবাসীদের মিথ্যা না বললে মিথ্যা বলা হবে, এটা সত্য।

এরপর তার কথার সাথে তাল মিলিয়ে মনের ভেতর লুকিয়ে রেখেই মিথ্যার আশ্রয় নেই। তাদেরকে বলে দেই, ‘হ্যাঁ, আমি সবকিছু কিনেছি। ঈদের দিন পোলাও আর মাংস রান্না করেছি। ঘুরতে বের হয়েছি। ওমুক-তমুক খেয়েছি।’ আর এসব শুনে মা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও ছোটরা তা মানতে রাজি হয় না। তাই ঈদের দিনের কয়েকটি ছবি ‘অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাসির অভিনয় করে ছবি উঠিয়ে ফেইসবুকে পাঠিয়ে দিই। খাবার মেন্যুতে রাখা পোলাও মাংসের ছবি ইন্টারনেট থেকে নামিয়ে তাদেরকে দিয়ে বলি, ‘এই যে নে, আমার হাতের রান্না।’

আমি জানি না এইগুলো তারা কীভাবে দেখে কিন্তু নিজেকে বড় অপরাধী ও আত্মত্যাচারী মনে হয়। বিষয়গুলো কেবল আমার ক্ষেত্রে যে সত্য তা নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীদের চিত্রও একই। মধ্যপাচ্য ব্যতিত ঈদের দিনগুলোতে বেশিরভাগ দেশে ছুটি মেলে না। নামাজের জন্য কিছু সময় ভাগ করলেও তা পুষিয়ে দিতে হয়, অতিরিক্ত সময় কাজ দিয়ে। যদিও এবার সাপ্তাহিক ছুটি।

ঈদের খুশিতে প্রবাসীরা হয়ে ওঠেন মিথ্যাবাদী, প্রতারক। তবে এই প্রতারণায় মানবীয় পাপ নেই। আছে একরাশ ভালবাসার আনন্দ। যে ভালবাসা হয় বাবা-মা, স্ত্রী কিংবা সন্তান। প্রিয়জনদের ছেড়ে আসা প্রবাসীদের ঈদ নির্জলা মুখোশ।  যদিও বছরে আমি কেবল দুই ঈদে ছুটি নেই, এরপরও আমার অনেক বাঙালি সহপাঠীদের দেখেছি তাদের ছুটি মেলে না। এমনকি ঈদের জামায়াতও কালক্রমে কপালে জোটে না।

 আবার যারা পড়াশোনা করে না, যারা চাকুরি কিংবা ব্যবসা করে, এই ঈদের জামায়াতটুকু আদায়ের সুযোগটুকুও পায় না, এরাই একেকজন হয়ে উঠে বড় ধরনের মিথ্যুক। এরা ঈদের দিনে অফিসে বসে কিংবা ল্যাবে থেকে বলে, এই তো কিছুক্ষণ আগে ঈদের নামাজ পড়ে এসেছি। এখন রান্না সেরে খেতে বসবো।

দেশে প্রিয়জনরা যখন ঈদের আনন্দে, ঠিক তখন অনেক প্রবাসী শ্রমিমের মাথায় ওঠে ইটের স্তুপ কিংবা দোকানের মালপত্র ওঠানামা করিয়ে বলে উঠে ‘আমাদের এখানে তো ঈদ সেই হচ্ছে’। প্রিয় মানুষদের ঈদের পোশাক কিনে দিয়ে এইসব প্রবাসী শ্রমিকদের অনেককে বলতে শুনেছি,অনেক কিছুই কেনাকাটা করা হয়ে গেছে। অথচ এই ঈদের দিনে তাদের মালিকের দেওয়া এক সাঁঝ দুপুরের খাবার এদের কাছে মনে হয় পোলাও-কোরমা। কখনো তারা অন্তর দিয়ে বুঝতে পারে না, তাদের প্রিয়জনের মনের অবস্থা। টাকা-পয়সার অভাব না থাকলেও প্রিয়জন ছাড়া ঈদের আনন্দ যে বস্তুত ফ্যাকাশে, তার বাস্তবতা দেখতে পাই এই দিনগুলোতে।

আজ বিদেশে এসে হয়তো এই বিষয়গুলো অনুধাবন করতে শিখেছি। দেশে থাকলে হয়তো কখনো বুঝতে পারতাম না, প্রিয়জন ছাড়া ঈদের পরিবেশ। বুঝতাম না কীভাবে মিথ্যা বলে পরিবারের সদস্যেদের ভোলাতে হয়। আর এইগুলোই মনে হয় প্রবাসীদের ঈদের এপিঠ-ওপিঠ গল্প।

লেখক: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জাপান প্রতিনিধি

ইমেইল: nadim.ru@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!