জাপানের চিঠি: কুমামতো ক্যাসেলের ক্ষত

গেল বছর আমরা বাঙালিরা যখন পহেলা বৈশাখ উদযাপন করছিলাম, তখন জাপানে ঘটে গেছে স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ ভূমিকম্প।

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Sept 2017, 04:47 AM
Updated : 21 Sept 2017, 09:22 AM

২০১১ সালের সুনামির পর সবচেয়ে বড় ধরনের এই ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিলো কুমামতো প্রদেশে। পর পর কয়েকদিন কয়েক দফা ভূমিকম্পে শহরটির বেশকিছু এলাকার মানুষ দীর্ঘদিন খোলা আকাশের নিচে ছিল। আমরা সেই সময় সংবাদ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।

যদিও সেই সময় কুমামতো শহরে আসতে পারিনি, তবে সংবাদ সংগ্রহের জন্য এই শহরের বেশকিছু বাঙালি ও জাপানির সাহায্য নিতে হয়েছিল। সেই ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত শহরটি দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে সেই সময় থাকলেও এবার তা পূরণ হলো।

কুমামতো বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর ওসাকা বিমানবন্দর থেকে আমরা উড়াল দিলাম কুমামতো বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। আমার সাথে রয়েছেন ল্যাবের দুই সহপাঠী শিগেনোরি ইনাগাকি ও হাজিমে শিনোদা। ৪৯১ কিলোমিটার পথ উড়াল দিয়ে যখন আমাদের বিমানটি বন্দরে অবতরণ করলো, তখন দুপুর ১২টা। বিমান থেকে দেখা যাচ্ছিলো, বেশকিছু ভবন দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে আছে। 

বিমানবন্দরটি শহর থেকে কিছুটা বাইরে থাকায় আমরা বিমান থেকে নেমেই সাটল বাস চেপে সরাসরি শহরের উদ্দেশ্যে বের হই। হোটেলে নিজেদের ব্যাগপত্র রেখেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে। যদিও আমাদের লক্ষ্যস্থল ছিলো শহরের প্রাণ ‘কুমামতো ক্যাসেল’।

জাপানে একশ’টি ক্যাসেল রয়েছে। এর মধ্যে যে তিনটি ক্যাসেল বড়, সেই হেমিজি ও মাসুমতো ক্যাসেলের পরই এই কুমামতো ক্যাসেল। যেটি বিশ্ব সপ্তাচর্যের অংশ। ২০১৬ সালে আমরা সংবাদ করেছিলাম, এই ক্যাসেলটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। বিমানেও আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছিলাম। কিন্তু কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা উপলব্ধি করতে পারিনি।

সোমবার যখন আমরা তিনজন ক্যাসেলের প্রধান ফটকে গেলাম, তখন দেখলাম একজন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ বসে আছেন। আমাদের দেখে একটু চেয়ে ফের আবার মুখ ফিরিয়ে নিলো। জাপানি ভাষায় শুধু একটা কথাই বললো, এটা ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে। আমরা এই ফটক বন্ধ করেছি, আপনারা অন্য ফটকে যান।

আমরা তিনজন হাঁটছি। কয়েকধাপ যেতেই দেখলাম, ক্যাসেলের পূর্ব পাশের কোণ ধসে পড়েছে। গভীর গর্ত হয়েছে মনে হয়। তবে পাথর-সুরকি দিয়ে সেটা মেরামতের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে ক্ষতের ছাপ ঢাকতে পারেনি।

১৪৬৭ সালে ইডেতা হিডেনবু এই ক্যাসেলটি প্রতিষ্ঠা করলেও আধুনিক এই ক্যাসেলটির রূপ পায় ১৯৬০ সালে। এরপর ২০০৮ সালের সপ্তাদশ শতাব্দিতে ক্যাসেলের অবকাঠামোর কিছুটা পরিবর্তন করে নতুনত্বের ছাপ পায় কুমামতো ক্যাসেল।

প্রতিদিন এই ক্যাসেলে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমায়। প্রতি বছর ১৭ লাখ দশনার্থী এখানে আসেন। আর সেই ক্যাসেলটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। ক্যাসেলের পশ্চিম ফটকে ঢুকতে রাস্তার নিচের দিকে তাকাতে দেখলাম, জাপানিরা বলছে ‘তেনসুকাকু (ভবন)’, মানে নীচ থেকে মাটি খসে পড়েছে। বড় বড় পাথরগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। 

ক্যাসেলের ফটকে গিয়ে দেখতে পেলাম, একটা পানির বেসিনে এক ছোট শিশু পানি ঢেলে নিজের হাত-মুখ ধুচ্ছে। আমার সাথে থাকা আমার সহপাঠীরাও তা করলো। আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতেই ওরা বললো, এ্টা পবিত্র পানি। যা খুবই কার্যকরী। 

যাই হোক, ওখান থেকে একটু গিয়েই আমরা দেখতে পেলাম, ক্যাসেলের মূল ভবনটি নির্মাণ করা হচ্ছে। চারিদিক পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম, ওইখানে যে প্রাচীন ক্যাসেলটি ছিলো, তার বিন্দুমাত্র চিহৃ এখন আর নেই। রড দিয়ে ক্যাসেলের কংকাল তৈরি হয়েছে। 

কিছুদূর গিয়ে আমরা দেখতে পেলাম, একটি মন্দিরে জাপানিরা ভিড় জমিয়েছে। এই মন্দিরটির কোনো ক্ষতি হয়নি। জাপানিরা এখানে মানত করছে। সেখানে দেখা মিললো কুমামতো ক্যাসেলের প্রধান কর্মকর্তা হিডেও কাওয়াতার।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “আসলে দৃষ্টিনন্দন এই ক্যাসেলটি দেখতে প্রতিদিন নানা ভাষার মানুষ এখানে ভিড় জমাতো। ভূমিকম্পের পর মূল ভবনটিতে প্রদর্শনী বন্ধ করা হয়েছে।” 

২০১৬ সালের জুন থেকে সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আসলে এই ক্যাসেলের ৭৯ হাজার স্কয়ার মিটার দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এইগুলো মেরামত করতে লাগবে কমপক্ষে ৩০ বছর।তবে ২০ বছর, মানে ২০৩৬ সালের দিকে মূল ক্যাসেলটি নির্মাণ শেষ হবে বলে আমরা আশা করছি।”

তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিলো, তখন তার এক সহকারী আমাদেরকে একটি ডায়েরি থেকে পুরাতন ক্যাসেলের ছবি দেখাচ্ছিলো। সেই সাথে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এই দর্শনীয় স্থানটিকে মেলানোর চেষ্টা করছিলো।

ক্যাসেলের এই ভদ্রমহিলা বলছিলেন, “আমরা খুব হতাশ হয়েছি। আমরা ভাবিনি যে এতো বড় ক্ষতিতে পড়বে ক্যাসেলটি। যেখানে লোকসমাগমে পরিপূর্ণ থাকতো, সেখানে হাতে গোণা কয়েকজন মানুষ আসছে। যারা দেখছে, তারাই হতবাক হচ্ছে।”

এরপর আমরা ক্যাসেলের মূল যে রাস্তাটি আগন্তুকদের আকর্ষণ করে, সেই চেরি ব্লোজম রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুদূর গিয়ে দেখলাম, একটা বড় মাঠ। সেখানে স্থানীয় কিছু জাপানি ব্যায়াম করছেন।

আমার হাতে ক্যামেরা দেখে এক মধ্য বয়সী জাপানি বললেন, “এই মাঠের মাঝখান থেকে ছবি তুললে দেখবেন, পুরো ভবনের ধ্বংসযজ্ঞ ধরা পড়ছে।” আমি তার কথা শুনে হাতের ক্যামেরা নিয়ে কিছু ছবি তুললাম। সত্যিই তো, দেয়াল ধসে পড়া ভবনে নির্মাণ কাজের দৃশ্য দেখে কেউ বলবে না, এটা কোনও মনোমুগ্ধকর ক্যাসেল!

আমি আমার সহপাঠী ইনগাকিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এই অবস্থা দেখে তোমার কেমন লাগছে?” জবাবে সে বললো, “টেরিবল (ভয়ানক)!” আমি কোনোদিন এখানে আসিনি। ছোটকাল থেকে শুনতাম, এই ক্যাসেলটি অনেক বিখ্যাত। কিন্তু এই অবস্থা দেখে আমার সেই ধারণায় ভাটা পড়লো।

আর এক সহপাঠী শিনোদা বললো, “আমি বুঝি না ঈশ্বর কেনো তার উপাসনালয়কে এতো আঘাত করবে। একবার ভূমিকম্প হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর আবার আঘাত হেনে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। মনে হয়েছে, এটাতে দৈত্য ভর করেছে।”

ক্ষত-বিক্ষত কুমামতো ক্যা্সলের চিত্র দেখে আমরা যখন হোটেলে ফিরছিলাম, তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। এই ভাঙ্গা ক্যাসেল দেখতেই আমাদের আড়াই ঘণ্টা কীভাবে পার হয়েছে, টেরই পাইনি।

জাপানিদের ঐতিহ্য ধরে রাখার সংগ্রাম সত্যিই অনেক মধুর। এরা যুগ যুগ ধরে প্রাচীন ধারা-উপধারা এই আধুনিক যুগেও অনায়াসে মেনে নিচ্ছে। সরকারও কোটি কোটি টাকা খরচ করে ক্যাসেলকে স্বাভাবিক সৌন্দর্য দিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যর প্রেমে মজে আছে জাপানিরা। 

লেখক: এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান প্রতিনিধি

ইমেইল: nadim.ru@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!