আমি এখন মনে করি, এই দেশে ‘কুসংস্কার’ আর ‘গুজবে’ সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে আমাদের এই শিক্ষিত সমাজ। স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করেও এরা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে অপারগ।
আপাতত আমি মনে, বাংলাদেশের পিছিয়ে যাওয়ার জন্য এই শিক্ষিত গোষ্ঠী বেশি দায়ী। এই গোষ্ঠীর কানের ককলিয়া এতোটাই সেনসেটিভ যে কেউ কোনো বার্তা ছড়িয়ে দিতে বললেই অনায়াসে সেইগুলো বিলি করতে দ্বিধা করে না।
সম্ভবত দুই দশক আগে আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন মাঝে মধ্যে ছোট একটা কাগজ পেতাম। যেখানে উল্লেখ করা হতো, ওমুক ব্যক্তি স্বপ্নে দেখেছেন, ‘ধর্মীয় বাণী সম্পর্কিত’ কাগজটি ৪০ কপি বিলি করলে অনেক ধন-সম্পদের মালিক হবেন। অথবা বলা হতো, যে ব্যক্তি এই কাগজ ৫০ জনকে দেবে না, দুই সপ্তাহ পর তার পরিবারের কেউ মারা যাবে ইত্যাদি।
ক্লাসে সেই সময় দেখতাম, যে বন্ধুটি কাগজের অভাবে স্কুলে অংক করেনি, সেই বন্ধুটিও কাগজ কেটে কেটে হাতে লিখে সবাইকে বিলি করতো। এতোদিন পরও আমাদের বিশ্বাসের জায়গায় কোনো কমতি নেই। বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার সাথে সাথে আমরা আমাদের বিচার-বুদ্ধি গিলে খেয়ে ফেলছি।
এমন কোনো হুজুগে ঘটনা নেই, যেগুলোর ম্যাসেজ ফেইসবুকে এসেছে, আর তা আমার মহান ফেইসবুকের বন্ধুরা দিতে ভোলেনি। কয়েকদিন আগে ‘ব্লু হোয়েল’ আতঙ্ক নিয়ে বেশ কিছু ম্যাসেজ ইনবক্সে পেয়েছিলাম, যার মধ্যে বলা হয়েছে +917574999093 এই নম্বর থেকে কোনো ফোন আসলে যেন রিসিভ না করি। আর করলেই নাকি এই মরণব্যাধি আমাকে গিলে খাবে!
আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আমাদের প্রজন্মের মনে এই বিষ কারা ঢোকাচ্ছে? আমি নিজে গতকাল অন্তত অর্ধ শতবার এই নম্বরে ফোন দিয়েছি, আর সব সময় বন্ধ পেয়েছি। নম্বর কোড দেখেও তো কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারতো, এটা কোন দেশের নম্বর?
আবার ধরুন, আপনার ফোনে ইন্টারনেট-ই নেই কিংবা জাভা ভার্সন, তাহলে এই স্মার্টফোনের গেইম চলবে? কিংবা কীভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার অ্যাপস স্টোর থেকে গলিয়ে আপনার মোবাইলে আসবে?
আহা, আমাদের শিক্ষিত জাতি! সারাদিন আমরা ফেইসবুকে ডুবে থাকতে পারি, কিন্তু একটা তথ্য যাচাই করার মুরোদ নেই। যে গেইমটি নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত হয়েছে, সেই গেইম নিয়ে গতকাল আমার জাপানি বন্ধুদের সাথে বেশ আলোচনা করেছিলাম।
আমি আমার জাপানি বন্ধুকে বললাম, “আচ্ছা, তোমাদের দেশে তো আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। তাহলে তোমরা কেনো এই গেইম খেলে মরছো না?” তখন ও বললো, “নাদিম, আমরা সেপ্পোকো করি, যাকে বলা হয় ‘অনার সুসাইড’। তার মানে এই না যে এমন বাজে গেইমের জন্য আমাদের আত্মহত্যাকে দূষিত করতে হবে।”
যেহেতু এই গেইম জাপানে চালু হয়নি, সেহেতু এই গেইমে মৃত্যুর প্রশ্নই ওঠে না। শুধু তাই নয়, এই ধরনের গেইম দেশটি ডাউনলোড লিংকেই ব্লকড।
গেইমটি হোক্স। এটা ধরে নিলাম, আপনার দেশের মানুষ কোনো প্রকার কারণ ছাড়াই বিশ্বাস করে, তাহলে যারা বিটিআরসিতে আছেন, তারা কি বোঝেন না, এই আইপি বন্ধ করা দরকার? প্রযুক্তির বিপরীত শব্দের প্রয়োগ রোধ করবে কারা?
গতকাল রাতে আবার নতুন একটা ম্যাসেজ পেলাম ইনবক্সে। এক ছোট বাচ্চা তার বাবার চিকিৎসার জন্য অর্থ যোগাড় করতে একটা ছবি শেয়ার করলে নাকি সে এক টাকা করে পাবে। কে দেবে, কোথায় থেকে আসবে সে টাকা? মার্ক জুকারবার্গ দেবে? হাস্যকর যুক্তি দিয়ে ইনবক্স ভরিয়ে আমাদের বন্ধুরা প্রমাণ করতে চাচ্ছে, তারা অনেক মহৎ।
যে বন্ধুটি ফেইসবুকে কয়েক বছর থাকার পরও কোনোদিন ম্যাসেজ করেনি, সে কিনা আমার ও আমাদের পরিবারের ভালোর জন্য বার্তাগুলো পাঠিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। আহা, বন্ধু আমার!
এই যে গত এক মাস ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নোবেল পুরস্কার নিয়ে প্রচারণা সত্যি বোকামির সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়েছিল। গুজব কত ধরনের হতে পারে, এটা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। নাম সর্বস্ব কিছু অনলাইন পত্রিকা আর ফেইসবুকের প্রচারণায় পেয়ে গেল প্রধানমন্ত্রীর নোবেল পুরস্কার।
আপনি এখন পর্যন্ত কোনো পত্রিকা বা ম্যাগাজিন দেখাতে পারবেন না যেখানে নোবেল পুরস্কারের সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম এসেছে, এরপর তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন? দেখুন না এই বছরের কথা, যারা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তাদের প্রতিক্রিয়ার কথা। কেউ কি আগে থেকে নোবেল পাওয়ার আশায় বিভোর হয়ে ছিলেন?
তবে হ্যা, এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেবল ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট’রা। নোবেল কমিটি মনে হয় এই জায়গাটিতে এসে তাদের আবেগ ধরে রাখতে পারে না। তাই এমনিতেই মার্কিন প্রেসিডেন্টরা নোবেল পাওয়ার দৌঁড়ে এগিয়ে থাকেন।
আচ্ছা ধরুন, আপনি শেখ হাসিনাকে খুব ভালবাসেন। তার নেতৃত্বকেও ভালবাসেন। আর এই ভালবাসার মানে এই নয় যে তাকে বিশ্ববাসীর কাছে হাসির পাত্র বানাবেন। ফেইসবুকে ‘Nobel prize’ পেইজে যখন থেকে স্ট্যাটাস আপডেট হতে শুরু করেছে, তখন থেকে আমরা বাঙালিরা যে কমেন্টগুলো করেছি, তা কি কেউ পড়েছেন? দেখুন না আমাদের শান্তির পরিচয় কেমন হয়? এইসব অসাড় মন্তব্য দেখে আমি সত্যিই লজ্জিত। আর নোবেল পাওয়া নিয়েও ইনবক্সে ম্যাসেজ কম ছিল না।
শুধু আজ নয়, এর আগেও যে বার্তাগুলো আমি পেয়েছি, যারা আমাকে দিয়েছে, তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ চুকিয়েছেন। আবার এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও আছেন। যে শিক্ষা আমাদের মনের অন্ধকার দূর করতে পারেনি, সেই শিক্ষার আদৌ কি প্রয়োজন আছে? যে শিক্ষা সহজে গুজবকে গিলিয়ে দিতে পারে, সেই শিক্ষার বাধবাধ্যকতা কি খুব জরুরি?
এইভাবে একটা জাতি চলতে পারে না। এই বার্তাগুলো দেখার পর নিজেকে সত্যিই অসহায় লাগে। যে গ্রুপটি একাত্তরে যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ভারত হয়ে যাবে প্রচারণা করেছিল, যে গ্রুপটি চাঁদে তাদের যুদ্ধাপরাধী ব্যক্তিকে কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়াই দেখতে পেয়ে মরার মিছিল তৈরি করে, তারাই বাঁশের দূর্গ তৈরি করে ফেইসবুকে এই প্রপাগান্ডাগুলো ছড়িয়ে আমাদের জাতির তেরোটা বাজিয়ে ছাড়ছে।
এরা এমনই উর্বর মস্তিষ্কের অধিকারী যে নাম-কা-ওয়াস্তে একবার কোনো ইস্যু বিশ্বাসযোগ্য করে প্রচার করতে পারলেই এদের ফায়দা। কারণ, এরা তো অন্ধকারে শিকার করতে বেশি ভালবাসে। গ্রামের অশিক্ষিত মানুষদের পুঁজি করেই এরা টিকে আছে, তাই শিক্ষিত গোষ্ঠীর আগা-মাথা খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আছে। সুযোগ পেলেই ‘গুজবের’ হুলিয়া জারি হয়ে যাবে।
হোক্স আমরা গিলে খাই। অনায়াসে আমরা গুজবকে রপ্ত করতে পারি। নাসিরনগরের রসরাজ কিংবা রামুর মতো ঘটনা রুখতে চাই পরিকল্পনা। প্রযুক্তি অনেক আসবে, তবে ক্ষতিকর দিকগুলো রুখবার ক্ষমতা থাকা বাঞ্ছনীয়।
লেখক: এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান প্রতিনিধি
ইমেইল: nadim.ru@gmail.com
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |