জাপানের চিঠি: ধর্মীয় উৎসব সবার

দেশে এখন দূর্গাপূজা চলছে। সপ্তমী কাটিয়ে আজ অষ্টমীতে। ধর্মের বিধি-নিষেধ এড়িয়ে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধন কেবল এই বাংলাদেশেই চিত্র।

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Sept 2017, 04:47 AM
Updated : 28 Sept 2017, 04:47 AM

আবহমান ধরে চলে আসা এই ধর্মীয় উৎসব হয়ে ওঠে বাঙালির। বন্ধুত্বের চাদর মেলে ধরা এইসব উৎসব ঘিরে তাই বাংলাদেশ মেতে ওঠে অন্যরকম ভঙ্গিতে। যদিও এই মুহূর্তে দেশের বাইরে, তবুও দূর্গাপূজার যে স্মৃতি মনে জমে আছে, তা চোখের সামনে অনায়াসে ভেসে উঠে। শৈশব-কৈশোরের এই পূজার সুখস্মৃতি রোমন্থন করার মধ্যেও আনন্দ লুকিয়ে থাকে।

আমি বেড়ে উঠেছি নওগাঁর বদলগাছীর এক পল্লী গ্রামে। গ্রামটিতে তিনটা পাড়া রয়েছে। এক পাড়ায় মুসলমান, একটিতে সাঁওতাল আর আর একটিতে হিন্দু। আর এই হিন্দু পাড়ায় আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে।

বুধবার যখন বাসায় মায়ের সাথে কথা বলছি, ঠিক তখন মা নাড়কেলের নাড়ু তৈরি করছিলো। সামগ্রিক ব্যস্ততায় আমি ভুলে গিয়েছিলাম, সেদিন থেকে দুর্গা পূজা শুরু হয়েছে। তবে মায়ের নাড়ু তৈরি করার কথা শুনে মনে পড়ে গেলো, এখন তো আশ্বিন মাস। আর এই আশ্বিন মাস এলেই তো আমাদের গ্রামে ঘরে ঘরে নাড়ু, মুরকি তৈরি ধুম পড়ে যায়।

আমার বাবা-মা দু্’‌জনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। বাবা মসজিদে যায়। তবে এই পূজার উৎসবে ধর্মীয় বিভেদ কখনও আমাদের শরীরে লাগে না। আমরা ছোটকাল থেকে বেড়ে উঠেছি একটা ভালোবাসার মেল-বন্ধনের মধ্যে দিয়ে।

আমার এই ছোট গ্রামে প্রতি বছরই দুর্গা পূজা হতো। সেই ধারাবাহিকতা এখনও অটুট রয়েছে। গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলো ধীরেন্দ্রনাথ প্রামাণিক। উনি পেশায় স্কুল শিক্ষক ছিলেন। আমরা তাকে জ্যাঠামশায় বলে ডাকতাম।

এই জেঠুদের আঙিনায় রয়েছে দুর্গার মন্দির। গ্রামের সব বন্ধুরাই ছিলো হিন্দু। তবে ধর্মীয় কোনো বিদ্বেষ ছিলো না। আমরা খেলতাম এক সাথে, ঘুরতে বেড়াতামও একসাথে। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ঘোরার মধ্যেও ছিলো না কোনো জড়তা। 

স্কুলে যেতাম একসাথে। এই বন্ধুদের সাথে থাকতে থাকতেই ওদের কাছ থেকে শুনতাম, দুর্গা পূজার ইতিবৃত্ত। পুরো বছর ধরে তারা এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে। খেলাধুলা করার সময় এক বন্ধু আর এক বন্ধুকে এসে বলতো, “শোন, আমার বাবা আগামী দুর্গা পূজায় নতুন জামা-প্যান্ট কিনে দেবে।”

আরেক বন্ধু এসে বলতো, “আমার দাদা আমার জন্য নতুন খেলনা কিনে দেবে।” তাই আমরা অপেক্ষা করতাম, কবে দুর্গাপূজা শুরু হবে। কবে আমরা একসাথে আবার আনন্দ করতে পারবো।

যাই হোক, এভাবে ১১টি মাস অপেক্ষা করে শরতে দুর্গা ঘরে আসতো। যেদিন থেকে গ্রামে দুর্গা তৈরির কারিগর বা শিল্পীরা আসতো, আমরা কেউ জেঠুদের ওই আঙিনা ছাড়তাম না। খড়কুটো, বাঁশের কাঠামো হয়তো স্কুলে যাওয়ার আগে দেখে আসতাম, আর স্কুল থেকে ফিরেই দল বেঁধে গিয়ে কারিগরদের পাশে বসে যেতাম।

এভাবে কোনো সপ্তাহে প্রতিমার তৈরির শিল্পীরা এসে বাঁশের ফ্রেম, আবার কোনো সপ্তাহে এসে আঁঠালো মাটি লাগিয়ে তৈরি করে যেতো আস্ত মানুষ সদৃশ প্রতীমা। এরপর চলতো রোদে শুকানো। আর এই সবগুলো আমরা খুব কাছ থেকে তৈরি করা দেখতাম।

প্রতীমাগুলো যখন শুকিয়ে যায়, এরপর আসে রঙ করার কাজ। আর এই সময় মন্দিরগুলো সাজানোর ধুম পড়ে যায়। ঘরে ঘরে শুরু হয়, বিভিন্ন মিষ্টান্ন তৈরির ধুম। আমরা মুসলাম হলেও আমাদের ঘরটাও বাদ পড়ে না। সেই ছোটকাল থেকেই দেখে আসছি, বাবাও এই পূজার জন্য নারকেল, গুড় কিনে আনতো।

সবার ঘরে নাড়ু-মুরকি থাকবে, আর আমরা যদি খেতে চেয়ে না পাই, সেজন্য বাবা মূলত এ আয়োজন রাখতো। শারদীয় দুর্গা পূজায় আমরা ছেলেরা দৌড়-ঝাঁপ করতাম। গ্রামে তখনও বিদ্যুৎ ছিলো না। তাই রাতের পূজায় হ্যাইজাক (বিশেষ ধরনের বাতি) ছিল আলোর জন্য যথেষ্ট। 

গ্রামে পূজা দেখতে আশেপাশের মুসলমানরাও দল বেঁধে এখানে আসতো। সবাইকে বসতে দেওয়া হতো আঙিনায়। আর  বাজতো মাইক। শারদীয় পূজার এই মাইকের বাংলা-হিন্দি গান পুরো এলাকায় মাতিয়ে রাখতো। পুরোহিতের পূজার মন্ত্র আর ঢাকের বাজনা মিলেমিশে হতো একাকার। নারী-পুরুষ ভিড় করতো এখানে। 

কারণ একটাই, পূজা শেষে আরতী দেখার জন্য। ধুপের আগুনে ধোঁয়াশা পরিবেশে চলতো এই আরতী। ঢোলের তালে তাল মিলিয়ে মাটির এই আরতীর পাত্রে থাকতো কাঠ-কয়লা। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম সেই নাচ। যদিও মাঝে মধ্যে মধ্যরাত অবধি চলতো সেই আসর।

মিষ্টান্ন বিলি চলতো সবার হাতে হাতে। গ্রামে আসতো নতুন নতুন আত্মীয়। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, আমরা মুসলমান হলেও আমাদের আত্মীয়-স্বজনরাও প্রতি বছর এইসময় পূজা দেখতে আসতো। বলতে গেলে, এটা আমাদেরও এক ধরনের উৎসব।

সপ্তমী, অষ্টমী কাটিয়ে যখন নবমী আসতো, তখন সবার মধ্যে একধরনের বিষণ্নতা কাজ করতো। কারণ, দশমীতে কেবল সকালে পূজায় শেষ হয়ে যেতো সব। সবার চোখে জল ছল ছল করতো। মন্দির থেকে নামিয়ে সকল প্রতীমাকে আনা হতো আঙিনায়। চলতো বিদায়ের সুর।

তবে দশমীর বিকেলে গ্রামে বসতো গ্রামীণ মেলা। যে মেলায় আসতো ছোটদের হরেক রকমের খেলনা, মিষ্টান্ন ও বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা। গ্রামের পাশে এক পতিত জমিতে বসতো এই মেলা। আশেপাশের সবাই দল বেঁধে মেলায় আসতো। 

সন্ধ্যার পর যখন বিসর্জন পর্ব শুরু হতো, তখন পুকুরের চারপাশে জমে যেতো মানুষ। গ্রামের পাশে নদী না থাকায় এই পুকুরই হয়ে যেত বিসর্জনের স্থান। দুর্গাকে বিদায় দিতে গিয়ে অনেক বন্ধুরা কেঁদে ফেলতো। আবার কেউ কেউ দুর্গাকে যেন বিসর্জন না দেওয়া হয়, সেই বায়না ধরতো বাবাদের কাছে। আমরা এইগুলো দেখে কিছুটা কষ্টও পেতাম। 

এভাবে প্রতি বছর আমাদের গ্রামে হয়ে চলছে দুর্গা পূজা। ছেলেবেলার এই স্মৃতি যেন কিছুতেই পথ ছাড়ে না। ওদের দুর্গা পূজায় চলতো আমাদের নিমন্ত্রণ। আর আমাদের ঈদ উৎসবে দাওয়াত দিতাম গ্রামের বন্ধুদের। বলতে গেলে, ওরা আমাদের ঈদের জন্য অপেক্ষা করতো। সেমাই-পোলাও খেতে ওদের কোনো দ্বিধা ছিলো না। আমরাও কখনো মনে করতাম না, আমরা দুই ধর্মের।

আমরা মনে করতাম, মন্দিরে যে ঈশ্বর থাকে, মসজিদে যে সৃষ্টিকর্তা থাকে- তা অভিন্ন। একই সত্ত্বার ভিন্নরূপ। সেই আদর্শে আমরা বড় হয়েছি। আজও আমরা কখনো সেই বিভেদ মনের ভেতর আনতে পারিনি। ছোটবেলায় আমরা নামাজ পড়তে যাই, আর আমাদের প্রতিবেশীরা মন্দিরে পূজা করে। মসজিদ থেকে ফেরার সময় মন্দিরে দেখা হতো অনেকের সাথে।

পড়াশোনার জন্য প্রায় এক যুগ ধরে বাড়ির বাইরে থাকায় ছেলেবেলার দুর্গাপূজা আর কখনো সেভাবে দেখা হয়নি। শুনেছি, এখন গ্রামের শারদীয় পূজায় আমাদের হিন্দুপল্লীতে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সামগ্রিক পরিবেশে দেখা দিয়েছে কোনো এক ভয়ানক উগ্রবাদের থাবা। তবে এই শঙ্কার মধ্যে শারদীয় দুর্গাপূজা চলছে। 

আমরা যে সময়গুলোতে ধর্মীয় বিদ্বেষের বাইরে বড় হচ্ছি, সেখানে নতুন প্রজন্ম ঘৃণা নিয়ে বড় হচ্ছে। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’-এই চিরন্তন বাক্যে বিষ মাখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কখনও আমরা মনে করছি না, ধর্মের বাইরেও আমরা বাঙালি। পরস্পরের বন্ধু-ভাই। আমাদের রক্তের হিমোগ্লোবিন একই। উপসনালয় ভিন্ন হলেও ধর্মীয় বিশ্বাসবোধের জায়গা বলেন আর নৈতিক দীক্ষা বলেন, সবকিছুই সমান।

আমাদের ধর্মে যেটা নিষেধ, ওদের ধর্মেও যেটা নিষেধ। বিভেদের জায়গা কোথাও নেই। তবে কেনো মানুষ আজ জাতিগত বা ধর্মীয় উগ্রবাদে বিশ্বাসী হয়ে উঠছে? কেন আমরা মানতে পারছি না, ধর্মীয় উৎসব শুধু পালনকারীদেরই নয়, সবার। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই আমরা ভাই-ভাই।

সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির এই বাংলা মা সবার জন্য। একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটতে হবে। ধর্মীয় মেমব্রেনের মধ্যে আড়ষ্ট থেকে সামনে যাওয়া সম্ভব নয়। ধর্মীয় নৈতিকতার শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ি।

লেখক: এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান প্রতিনিধি

ইমেইল: nadim.ru@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!