উপাচার্য জানান, মামলা ও বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেট নিয়েছে৷ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের এখতিয়ার তার নেই৷ তবে ছাত্রদের দাবিগুলো প্রশাসনিক বডির সঙ্গে আলোচনা করে দেখা হবে।
Published : 22 Feb 2024, 10:09 PM
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি মুছে ধর্ষণ ও নিপীড়নবিরোধী গ্রাফিতি আঁকার জেরে মামলা এবং ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা৷
বুধবার রাতে মশাল মিছিল নিয়ে তারা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন।
প্রায় এক ঘণ্টা অবস্থানের পর আন্দোলনকারীদের একটি প্রতিনিধিদল উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করেন৷
এ সময় উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম জানান, মামলা ও বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেট নিয়েছে৷ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের এখতিয়ার তার নেই৷ তবে ছাত্রদের দাবিগুলো প্রশাসনিক বডির সঙ্গে আলোচনা করে দেখার কথা জানান তিনি।
এর আগে ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানবিকী অনুষদের পশ্চিম পাশের দেয়ালে ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি চিত্র মুছে ধর্ষণবিরোধী দেয়ালচিত্র আঁকেন জাহাঙ্গীরনগর ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি অমর্ত্য রায় ও সাধারণ সম্পাদক ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলী। তারা দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী। সেই দেয়ালচিত্রে তারা ‘ধর্ষণ ও স্বৈরাচার থেকে আজাদী’ শীর্ষক একটি বাক্যজুড়ে দেন।
গ্রাফিতি নিয়ে বিভ্রান্তি এড়াতে পরের দিন অর্থাৎ ৮ ফেব্রুয়ারি অঙ্কনকারীরা যৌথ বিবৃতিতে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন জোগাতে এবং নিপীড়কদের হুঁশিয়ারি দিতে নতুন গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। সেখানে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিটি প্রায় তিন বছর পার হওয়ায় অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া পাশের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর একটি বিশাল, স্পষ্ট ও নান্দনিক চিত্রকর্ম দৃশ্যমান ছিল। তাই চলমান ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতার ভিত্তিতে এই গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে।
তাদের দেওয়া বিবৃতির পরও বঙ্গবন্ধুর ছবি মুছে দেয়ালচিত্র অঙ্কনকারীদের শাস্তির দাবিতে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর থেকে আমরণ অনশনে বসেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুই নেতা এনামুল হক ও রিয়াজুল ইসলাম৷
টানা চারদিনের অনশন শেষে ১৯ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের আশ্বাসে ডাবের পানি খেয়ে অনশন ভাঙেন ছাত্রলীগের ওই দুই নেতা।
অনশনকারী এনাম বলেন, “তারা (ছাত্র ইউনিয়ন) চাইলেই অন্য যেকোনো দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি৷ এমনকি আমাদের অনুমতিও নেয়নি৷ আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর গ্রাফিতি মুছে অন্য গ্রাফিতি অঙ্কন করা আমাদের জন্য অপমানজনক।”
এদিকে, এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হেল কাফীকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
মঙ্গলবার সিন্ডিকেট সভায় কমিটির সুপারিশে অমর্ত্য রায় ও ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলিকে এক বছরের বহিষ্কার ও রাষ্ট্রীয় আইনে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন৷
মামলার ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধক আবু হাসান বলেন, “ফাইল থানায় পাঠিয়েছি। কতদূর কাজ হয়েছে সেটা জানা যায়নি।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, সিন্ডিকেট সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের এখতিয়ার তার নেই৷
এ ঘটনায় ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছে ছাত্র ইউনিয়নের জাহাঙ্গীরনগর সংসদের নেতাকর্মীরা৷
নেতাকর্মীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাফিতি নিয়ে রাজনীতি চলছে৷ যেকোনো দেয়ালে প্রতিবাদী গ্রাফিতি আঁকা হলে সেখানে কৌশলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রাফিতি আঁকা হচ্ছে আর এভাবে প্রতিবাদের ভাষা মুছে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী তাপসি দে প্রাপ্তি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর চেতনা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের পুঁজি না, বঙ্গবন্ধু সবার৷ গ্রাফিতি থাকলে সেখানে মুছে আরেকটি করা হবে, এটাই নিয়ম এবং এটাই বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে আসছে৷ দেয়াল লিখন বা গ্রাফিতি আঁকার দায়ে কোনো স্বাধীন দেশে এমন সিদ্ধান্ত নিতে দেখিনি। অথচ এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুত গতিতে ওই দুজনকে বহিষ্কার করেছে। অথচ সেই প্রশাসন, যারা কিনা যৌন নিপীড়ন, দুর্নীতি-অনিয়ম, মাস্টারপ্ল্যানের বিষয়ে কোনো সমাধান দিতে পারছে না।”
এ বিষয়ে অমর্ত্য রায় বলেন, “গ্রাফিতি বা ওয়াল আর্ট হচ্ছে প্রতিবাদের ভাষা, সংগঠনের প্র্যাকটিস। ক্যাম্পাসে এটাই প্রচলিত এবং চার-পাঁচ বছর ধরে গণতান্ত্রিক নিয়ম অনুযায়ী সংগঠনগুলো এই কাজগুলো করে আসছে। তাই প্রথমত এটা অযৌক্তিক যে, বঙ্গবন্ধুর পুরনো একটা ছবি মুছে ধর্ষণবিরোধী গ্রাফিতির কারণে আমাদের বহিষ্কার করা।”
শুধুমাত্র গ্রাফিতির কারণেই প্রশাসন তাদের বহিষ্কার করেনি বরং এর পেছনে অন্য কারণ থাকতে পারে বলেও দাবি তার।
এ বিষয়ে নিপীড়নবিরোধী মঞ্চের সংগঠক, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক পারভীন জলি বলেন, “আগে সেখানে (দেয়াল) ছাত্র ইউনিয়নের একটি গ্রাফিতি ছিল, এরপর ছাত্রলীগ সেটা মুছে বঙ্গবন্ধুর গ্রাফিতি এঁকেছে৷ শেষে ছাত্র ইউনিয়ন পুনরায় সেখানে ধর্ষণ ও নিপীড়নবিরোধী গ্রাফিতি এঁকেছে। আগে একটা গ্রাফিতি থাকা সত্ত্বেও ছাত্রলীগ সেখানে বঙ্গবন্ধুর গ্রাফিতি এঁকেছে যা জাতির পিতার আদর্শের ও চেতনার পরিপন্থি। বঙ্গবন্ধু কোনো নির্দিষ্ট ছাত্রসংগঠনের নয়, তিনি আমাদের সবার৷ ভিন্নমতকে দমন করতে গিয়ে জাহাঙ্গীরনগরে কেউ কেউ এসব করছেন।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগুলোতে গ্রাফিতি আঁকা নিয়ে কোনো বিধি-বিধান নেই, থাকাটা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
“বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান নিশ্চিত হোক ও সংবেদনশীলতার চর্চা বৃদ্ধি পাক এটাই শিক্ষক হিসেবে প্রত্যাশা করি,” বলেন অধ্যাপক পারভীন জলি।
আরও পড়ুন:
যৌন নিপীড়ন: জাবি শিক্ষক মাহমুদুর চাকরিচ্যুত
জাবিতে নিপীড়নবিরোধী মঞ্চের মশাল মিছিল
জাবিতে ধর্ষণ: তৃতীয় দিনের মতো প্রশাসনিক ভবন অবরোধ
জাবিতে ধর্ষণ: আচার্যকে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান
জাবিতে ধর্ষণ: মশাল মিছিল শেষে উপাচার্য ও শিক্ষার্থীদের বিতণ্ডা
জাবিতে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সংহতি সমাবেশে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও
জাবিতে ধর্ষণ: রিমান্ড শেষে কারাগারে ৪ আসামি
জাহাঙ্গীরনগরে ধর্ষণ: ঘটনার যে বিবরণ দিল র্যাব
জাহাঙ্গীরনগরে ‘ধর্ষণ’: বাকি দুই আসামিও গ্রেপ্তার
জাবিতে ধর্ষণ: দিনভর বিক্ষোভে নামল আরও অনেকেই
জাবি প্রশাসনের ব্যর্থতায় যৌন নিপীড়ন বন্ধ হয়নি: ইউজিসি
জাবিতে ধর্ষণ: তৃতীয় দিনেও উত্তাল ক্যাম্পাস
আগের ঘটনায় ব্যবস্থা না নেওয়ায় জাবিতে ফের ধর্ষণ: ১৮ নাগরিক
জাবিতে ধর্ষণের প্রতিবাদের নতুন প্ল্যাটফর্ম ‘নিপীড়নবিরোধী মঞ্চ’
‘ধর্ষকের জন্ম বিচারহীনতায়’: জাহাঙ্গীরনগরে ক্ষোভ
ধর্ষকদের শাস্তির দাবিতে জাহাঙ্গীরনগরে মশাল মিছিল
জাবিতে ধর্ষণ: জড়িতদের সনদ স্থগিত, ক্যাম্পাসে 'অবাঞ্ছিত'
ধর্ষণ: জাহাঙ্গীরনগরের চার শিক্ষার্থী ৩ দিনের রিমান্ডে
ধর্ষণ: বিক্ষোভে উত্তাল জাহাঙ্গীরনগর
জাবিতে ধর্ষণ: ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজ ও মামুনকে সহায়তা করেন চারজন
জাবিতে স্বামীকে আটকে নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার