ঝড়ের বিপদ কমে আসায় সমুদ্র বন্দরগুলোতে বিপদ সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।
Published : 17 Nov 2023, 03:52 PM
খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে মোংলা-পায়রা উপকূল পেরিয়ে পুরোপুরি স্থলভাবে উঠে এসেছে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’; বৃষ্টি ঝরিয়ে দুর্বল হয়ে পরিণত হয়েছে স্থল নিম্নচাপে।
ঝড়ের বিপদ কমে আসায় মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে তার বদলে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। একইভাবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরসমূহকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে তার বদলে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।
ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে শুক্রবার বেলা ১টার দিকে উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’। পরের দুই ঘণ্টায় বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে বেলা ৩টার দিকে তা পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসে।
আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বিকেল ৪টার দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঝড়টি দুর্বল হয়ে গভীর নিম্নচাপ আকারে পটুয়াখালী ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। ওই ঘূর্ণিবায়ুর চক্র স্থলভাগের ওপর দিয়ে আরো উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হবে এবং বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে হতে এক পর্যায়ে গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে।
পটুয়াখলীতে বিকাল ৩ টা ৪০ মিনিটে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১০২ কিলোমিটার উঠেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “আপাতত ভয়ের আর কোনো কারণ নাই। তবু আমরা ৩ নম্বর সংকেত দিয়ে রেখেছি কারণ আগামী ২৪ ঘণ্টা বৃষ্টি হবে ও কিছুটা ঝড়ো হাওয়া থাকবে।”
আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকা এবং বন্দরের ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।
ঝড় কেটে গেলেও সাগর উত্তাল থাকায় উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়া অফিস বলেছিল, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর, ফেনী, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরের নিম্নালাঞ্চ স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩ থেকে ৫ ফুট বেশি উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে ভারি (৪৪-৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতি ভারি (৮৯ মিলিমিটারের বেশি) বর্ষণ হতে পারে। অতি ভারি বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধস হতে পারে বলেও সতর্ক করেছে আবহাওয়া অফিস।
ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে উপকূলীয় জেলাগুলোতে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই চলছে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টি।
শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে সারা দেশে সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ- বিআইডব্লিউটিএ।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে পণ্য ওঠানামা কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ।
সাগরে মাছ শিকারে যাওয়া বেশিরভাগ ট্রলার নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরলেও বরগুনায় ঘাটে ফেরেনি তিন শতাধিক জেলেসহ ২০টি ট্রলার।
চার মৃত্যু
ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে অব্যাহত বর্ষণে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় বসতঘরের মাটির দেয়াল চাপায় এক পরিবারের চারজন নিহত হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজারের মরিচ্যাঘোনার পানিরছড়া নামক এলাকায় এ ঘটনাটি ঘটে।
নিহতরা হলেন- ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের পানিরছড়ার ফকির মোহাম্মদের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৫০), ছেলে শাহিদুল মোস্তফা (২০), মেয়ে নিলুফা ইয়াছমিন (১৫) ও সাদিয়া বেগম (১১)।
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, ফকির মোহাম্মদ পাহাড়ের পাদদেশে মাটি দিয়ে বসতঘরটি তৈরি করেছিলেন। রাতে ভারি বৃষ্টি হওয়ায় ঘরের উপরে ও চারপাশে ত্রিপল দিয়ে ঘুমান সবাই। রাত ৩টার দিকে মাটির দেয়াল ধসে চাপা পড়ে ফকির মোহাম্মদ ছাড়া বাড়ির সবাই মারা যান।
আশ্রয়কেন্দ্রে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ
ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কারণে জানমাল বাঁচাতে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন নারী ও শিশুসহ উপকূলের ২৫ হাজারের বেশি মানুষ।
তাদের মধ্যে ১১ হাজার ২২৩ জন নারী, ১০ হাজার ৭৯৫ জন পুরুষ, ৩ হাজার ৬৪ জন শিশু, ২০৩ জন প্রতিবন্ধী রয়েছেন।
এছাড়া ১ হাজার ৩০৮টি গরু/মহিষ, এক হাজার ৭০৩টি ছাগল/ভেড়া ও ২৭৪টি অন্যান্য গবাদি পশুকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার কথা জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ তথ্য এখনও আসেনি জানিয়ে তিনি বলে, “আশা করি তেমন ক্ষয়ক্ষতি হবেও না। উপকূলীয় এলাকায় ৯২৯টি মেডিকেল টিমসহ সবাইকে সতর্ক রাখা হয়েছে।”
আবহাওয়াবিদ শাহীনুল ইসলাম বলেন, “মানুষকে সাবধান করার জন্য আমরা বিপৎসংকেত দিয়েছি। তবে এটা শক্তিশালী সাইক্লোন না, খুবই দুর্বল প্রকৃতির। তাই জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সেরকম হবে না, মানুষ যদি সচেতন থাকে।”
লঘুচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়
পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগরে গত ১৪ নভেম্বর একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়ার পর সেটি উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে সেই ঘূর্ণিবায়ুর চক্র ১৫ নভেম্বর নিম্নচাপে পরিণত হয়। তারপর বাঁক নিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে বৃহস্পতিবার পরিণত হয় গভীর নিম্নচাপে।
রাতভর শক্তিসঞ্চয়ের পর সেই গভীর নিম্নচাপ শুক্রবার ভোরে পরিণত হয় ঘূর্ণিঝড়ে। তখন এর নাম হয় মিধিলি (Midhili)।
আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয় বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সাইক্লোন সংক্রান্ত আঞ্চলিক সংস্থা এসকাপ। এ অঞ্চলের ১৩টি দেশের দেওয়া নামের তালিকা থেকে পর্যায়ক্রমে নতুন ঘূর্ণিঝড়ের নাম ঠিক করা হয়। মিধিলি নামটি মালদ্বীপের দেওয়া।
নিম্নচাপের প্রভাবে রাজধানীসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকেই বৃষ্টি চলছিল। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তা বাড়তে থাকে।
শুক্রবার সকাল ৬টায় ঘূর্ণিঝড় মিধিলি মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ৩৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল। তখন দেশের চার সমুদ্র বন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়।
এরপর সকাল ৯টায় আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে জানানো হয়, মোংলা বন্দরের ২৬৫ কিলোমিটার এবং পায়রা বন্দরের ২৭০ কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছে মিধিলি। তখন হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়।
এর আগে গত ২৪ অক্টোবরে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়’ হামুন। এটি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার কাছ দিয়ে বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করে। তাতে গাছপালা-ঘরবাড়ির ক্ষতি হয় বেশ, প্রাণ যায় অন্তত চারজনের।
সেই তুলনায় ঘূর্ণিঝড় মিধিলি বেশ দুর্বল বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ।
আরও পড়ুন