“আরে আপু, কেমন আছেন? কতোদিন পর আপনাকে দেখলাম?” -এভাবে শুরু হলো আমাদের কথোপকথন।
Published : 03 Oct 2017, 10:40 AM
গত সপ্তাহে কেনাকাটা করার জন্য শপিং সেন্টারে গিয়েছিলাম। ঠিক তখনই দেখা হলো এই মানুষটির সাথে। তিনি আবার এই শপিং সেন্টারে কাজও করেন। কথা প্রসঙ্গে অনেক কিছু জানতে পারলাম, যেমন: এই কাজ করতে কী কী যোগ্যতা লাগে। আর সেই সাথে বেতনও বা কেমন ইত্যাদি।
এই ঘটনাটি বলার কারণ বলছি। আমরা বাঙালি নারীরা যে শুধু বাংলাদেশে বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হচ্ছি, তা নয়। এমনকি ইংল্যান্ডের মতো এতো উন্নত দেশে এসেও খুব একটা ব্যতিক্রম দেখছি না।
এ বৈষম্যের পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে- ভাষার ভিন্নতা, কাজের অনুমতি না থাকা ও এশিয়ান দোকান। ইংরেজি ভাষার দুর্বলতার কারণে কিন্তু অনেকেই তখন বাধ্য হয়ে বাঙালি বা এশিয়ান দোকানগুলোতে কাজ করে। আর এর সুযোগ নিয়ে তখন কম বেতনে কর্মচারীদের নিয়োগ করা হয়।
যখন জিজ্ঞেস করলাম, “ঘণ্টায় আপনি কতো পান?” তখন উত্তরে জানতে পারলাম, ঘণ্টায় মাত্র চার পাউন্ড, যেখানে ইংল্যান্ডে সর্বনিম্ন মজুরি হচ্ছে সাড়ে সাত পাউন্ড।
আর তাছাড়া এ ধরনের কাপড়ের শপে মজুরি কম হওয়াতে পুরুষরা সাধারণত এ ধরনের কাজ করতে চায় না। আর যারা করে, তারা তুলনামূলক বেশি মজুরি পায় নারীদের তুলনায়, ঘণ্টায় সাড়ে পাঁচ পাউন্ড।
সবচেয়ে যে জিনিসটি আমার খারাপ লেগেছে, তা হলো ওই আপুকে এই ধরনের চাকরি করতে হচ্ছে, তাও আবার হিন্দি বা বাংলা ভাষায়। বললাম, “কিন্তু আপু, আপনি তো জানেন এই এশিয়ান দোকাগুলো বেতনের এই অবস্থা। তাহলে কেনো করছেন?”
কি হাস্যকর কথা! উনি চাকরি করে আর তার স্বামী বাসায় বসে থাকে। মাস শেষে স্বামীকে টাকা না দিতে পারলে স্বামীর অত্যাচারের শিকার হতে হয়। ভাবতে অবাক লাগে, আমরা নারীরা কতোটা অসহায় ও অবহেলিত! কিন্তু তিনি সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে। উনি কিন্তু ইচ্ছে করলেই পারে এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু তার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব কী বলবে, এই ভয়ে সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছে!
আমরা নারীরা যদি ইচ্ছে করে অনেক কিছু সমাধান করতে না চাই চক্ষুলজ্জার ভয়ে, তাহলে কীভাবে চলবে! এতোবার বোঝালাম, এটা বাংলাদেশ নয়, ইংল্যান্ড। এখানে বরং নারীদের অধিকার অনেক বেশি। কেউ চাইলেই তার সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।
যাই হোক, বুঝিয়ে ওনাকে খুব একটা বেশি লাভ হয়নি। কিন্তু দেখুন, এই মানুষটি যেমন বাসায় বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, ঠিক তেমনি বাইরেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন!
আজকে ইংরেজি ভাষায় দুর্বল আর এশিয়ান দোকান হওয়ার কারণে হয়তো তার এই ধরনের কাজ করতে হচ্ছে কম বেতনে। কিন্তু যদি তিনি ইংরেজ কোনো দোকানে কাজ করতেন, তাহলে এ সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হতে হতো না।
গত বছরও তাকে বলা হয়েছিলো, ইংরেজি কোর্স করতে। কিন্তু তার স্বামী তখন তাকে অনুমতি দেইনি শিখতে। কারণ তিনি মনে করেন, মেয়ে মানুষ ঘরে বসে থাকবে। বাইরে কাজ করার দরকার নেই। আর মেয়ে মানুষের চাকরির টাকা নাকি হারাম। আমার যতদূর মনে আছে, একবার আপু আমার সাথে শপিং সেন্টারে গিয়েছিলো জামা-কাপড় কিনতে। ও মা, বাসায় আসার পর ওনার ওপর অত্যাচার- কেন বাইরে গেলো! কিন্তু কী অবাক কাণ্ড, এখন এই আপুটার টাকায় সংসার চলছে!
আসলে কী, এ ধরনের পুরুষদের লজ্জা নেই। যখন যা মন চায়, তখনই ভুয়া হাদিস-ফতোয়া জারি করে নারীদেরকে বন্দি করে রাখতে চায়। আমার খুব বলতে ইচ্ছে করে, ভাই, এসব ফতোয়া ও ভুয়া হাদিস বন্ধ করেন। দুনিয়া বড় কঠিন।
হিন্দি বা বাংলা ভাষায় চাকরি করতে হয় বলে তার ইংরেজি শেখার যে আগ্রহ, তা একেবারে কমে গেলো। কিন্তু এবার ভাবুন তো, কার ক্ষতি হলো? আমরা নিজেরা কিন্তু আমাদের নিজেদের সমস্যা সৃষ্টি করি অনেক সময় এবং সেই সমস্যা থেকে বের হতে পারি না অন্যরা কী বলবে চিন্তা করে।
শুনুন, বৈষম্য সব জায়গায় আছে। ঘরের বাইরেও আছে, আবার ভেতরেও আছে। কিন্তু সেই বৈষম্যের শিকার আপনি যদি জেনে-শুনে হোন, তাহলে বোকামি ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়? এজন্য সবারই উচিত, যে দেশে আপনি যাবেন, সে দেশের ভাষার ওপর কিছুতা দক্ষতা বা জ্ঞান নিয়ে যান। তাহলে আপনি এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হবেন না।
লেখক:
প্রবাসী শিক্ষার্থী ও সাবেক গণমাধ্যমকর্মী
ছবি কৃতজ্ঞতা: আনোয়ার জাহিদ ও লেখক
ই-মেইল: [email protected]
লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |