লন্ডনের চিঠি: প্রবাসে কষ্টের মাঝেও সুখ

প্রবাসে কষ্টের মাঝেও সুখ- এই শিরোনামটি দেওয়ার পেছনে শুধু একটিই কারণ, সেটি হলো নিরাপত্তা। একটি মানুষের বেঁচে থাকার পেছনে এই একটি শব্দ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শাফিনেওয়াজ শিপু, যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 May 2017, 05:35 AM
Updated : 15 May 2017, 05:35 AM

নিরাপত্তা আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই প্রয়োজন এবং আপনাকে ও আমাকে বাঁচিয়ে রাখার সাহস দেয়। এক কথায়, আমরা বুঝি সুরক্ষিত থাকা। এই সুরক্ষা সব দিক থেকেই হতে পারে, যেমন- শারিরীক, মানসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ভীতি ও দুর্ঘটনা ইত্যাদি।

আগে বুঝতাম না, মানুষ কথায় কথায় কেন বলতো প্রবাসের জীবনযাপন অনেক কষ্ট হলেও দেশের থেকে অনেক ভালো আছি। কেন বলতো এবং এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে, হয়তো আমি এখন বুঝতে পারছি এই দেশে আসার পর। শত কষ্টের মাঝেও মানুষ কেন থাকতে চায়?

কে না চায় শান্তিমতো জীবনযাপন করতে? এই দেশে আসার পর একটি ঘটনার মাধ্যমে আমার আরও টনক নড়েছে। ঘটনাটি শেয়ার করলে আপনারা সহজেই বুঝতে পারবেন, আমাদের দেশের সাথে কতোটুকু তফাৎ সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে।

একদিন আমি কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার পথে রাস্তায় এক মাতাল আমার হাত ধরার চেষ্টা করলো। তার উদ্দেশ্য ছিলো পাশের একটা গ্যারেজের দিকে আমাকে নিয়ে যাওয়া।  তবে তার আগেই আমি নিজের হাত সরিয়ে নিতে পারলাম। আর আমার চিৎকারে দ্রুত ওই রাস্তায় যাতায়াতকারী লোকজন ছুটে এসেছিলো। লোকটিও মুহূর্তকাল নষ্ট না করে ভেগে গিয়েছিলো।

ও! আরেকটি কথা। এই দেশে ৯৯৯ হচ্ছে ইমারজেন্সি নাম্বার এবং কল দেওয়ার সাথে সাথে আপনি আপনার সেবা পেয়ে যাবেন যেকোনো মুহূর্তে, যেকোনো সময়ে। তারপর দেরি না করে আমার ভাই পুলিশকে কল দেওয়ার ৭ মিনিটের মধ্যে ওরা চলে আসলো এবং এরপর আমাকে নিয়ে বের হলো সেই লোকটিকে খোঁজার জন্য।

সৌভাগ্যত্রুমে আমরা ওই লোকটিকে পেয়ে যাই আশেপাশের একটি স্টেশনের সামনে এবং সাথে সাথে পুলিশ ওই লোকটিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যায়। এরপর আরেকজন পুলিশ বাসায় এসে আমার স্টেটমেন্ট ও আমাকে একটি কার্ড দিয়ে গেল। বললো, যদি আবার কোনো সমস্যা হয়, তাহলে এই কার্ড আমাকে সাহায্য করবে। এক কথায়, খুবই মুগ্ধ হলাম তাদের সেবার মান ও ব্যবহার দেখে।

এ তো গেলো পুলিশ সার্ভিস, এরপর আসি মানবাধিকার ও চিকিৎসা সেবা নিয়ে। ঘটনাটি ঘটার পর থেকে মানবাধিকার ও হাসপাতাল থেকেও অনবরত ফোন করে তারা আমার খোঁজ নিচ্ছিলো আমার মানসিক অবস্থা জানার জন্য। সেই সাথে আমি আর কোনো অতিরিক্ত সেবা চাই কিনা জানার জন্য।  

প্রথমে একটু বিরক্ত হয়েছিলাম এতো ফোনকল রিসিভ করতে করতে। কারণ আমার দেশে তো এই ধরনের সেবা কখনো পাইনি, এজন্য বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর মনে হলো, না, ঠিকই আছে। কে না না চায় এই ধরনের সেবা! আমি একজন মেয়ে বা নারী হিসেবে এই ধরনের সুবিধা পেতে বাধ্য।

এরপর তারা আমার অনুমতি নিয়ে লোকটিকে ছেড়ে দিয়েছিলো জেলখানা থেকে। কারণ আমি আর চাচ্ছিলাম না কোনো ঝামেলার মধ্যে যেতে। যেহেতু এই দেশে আজকে আছি কালকে নেই। তারপরও তারা আমাকে বলেছিলো, লোকটিকে তারা আদালতে নিয়ে যাবে যদি আমি অনুমতি দেই এবং এরপর তাকে শাস্তি দেওয়া হবে।

এমনকি তারা আরও বলেছেন, যদি কখনো আমি আবার এই লোকটিকে আমাদের এই এলাকায় দেখি, তাহলে সাথে সাথে যেন তাদেরকে, মানে পুলিশকে খবর দিতে। সবচেয়ে মজার কথা কী, এরপর থেকে কখনো এই লোকটিকে আর দেখা যায়নি আমাদের এলাকায়।

বাহ্‌! তারিফ না করে পারছি না এদের সেবা নিয়ে। আসলেই কী, আসার পর থেকে এই দেশের নিয়ম-কানুন প্রতি মুহূর্তে আমাকে মুগ্ধ করছে এবং এখনও করছে। আমরা সবাই জানি, এখনকার জীবনযাপন আমাদের দেশের থেকে একেবারেই ভিন্ন। কিন্তু তারপরও কেন জানি এর মাঝেও সুখ পাই। এই সুখ জিনিসটা অনুভব করার পেছনে শুধু একটি কারণ, সেটি হলো নিজের জীবনের নিরাপত্তা।

এই ঘটনাটি আপনাদের সাথে শেয়ার করার পেছনে শুধু একটাই কারণ। বর্তমানে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই নিরাপত্তা বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা কিনা স্বপ্ন দেখতে বাধা সৃষ্টি করছে আমাদের প্রজন্মকে। আমাদের দেশে যে হারে খুন, রাহাজানি এবং ধর্ষণ হচ্ছে, সেই অনুযায়ী কোনো বিচার তো হচ্ছে না। বরং আরও ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। উল্টো বিচার চাইলে মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

প্রতিনিয়ত এতো কিছু ঘটছে আমাদের দেশে, তারপরও আমরা সব সহ্য করে যাচ্ছি। কেউ কোনো প্রতিবাদ করছি না নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। যে দেশে কোনো নিরাপত্তা সেই, সেই দেশে কীভাবে আপনি বিচার আশা করবেন? তাহলে আপনারাই বলুন, কেন মানুষ দেশে আসতে চাইবে, যেখানে কোনো নিরাপত্তা নেই, আছে শুধু অশান্তি।

শুনলাম আমাদের দেশেও নাকি এই রকম ইমারজেন্সি নাম্বার ও সেই সাথে সেবাও চালু করা হয়েছে। যদি তাই করে, তাহলে কেন জনগণ সেবা পাচ্ছে না সঠিক সময়ে। আজকে আমাদের দেশ দিনের পর দিন ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র নিরাপত্তাহীনতার কারণে।

নিরাপত্তা প্রত্যেকটি দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং জনসচেতনতা ছাড়া কখনোই নিরাপত্তা বিষয়টি জোরদার করা সম্ভব নয়। নিরাপত্তা বাস্তবায়নে শুধু সরকারকে এগিয়ে আসলেই হবে না, সেই সাথে জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে।  

লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী ও সাবেক গণমাধ্যমকর্মী     

ই-মেইল: topu1212@yahoo.com

লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!