কিছুদিন আগে তো সেই টাইটানিক শহরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। বিখ্যাত কানাডিয় মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক ও লেখক জেমস ক্যামেরুনকে ধন্যবাদ জানাই টাইটানিক মুভিটির জন্য। কারণ তার মাধ্যমেই আমাদের প্রজন্মের একটি বড়ো অংশ জানতে পেরেছিলাম টাইটানিক ট্রাজেডির কথা।
তারপরও এর পুরো ইতিহাস যে উত্তর আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টকে ঘিরে তা আগে জানতাম না। স্কটল্যান্ড থেকে আসার পর পরিকল্পনা করলাম বেলফাস্টে যাওয়ার।
আসলে আমরা যারা ইংল্যান্ডে থাকি, মোটামুটি সবাই এখানকার ব্যস্ত লাইফের ওপর বিরক্ত হয়ে যাই, তখন এই ব্যস্ত লাইফ থেকে স্বস্তি পাওয়ার জন্য কিছুদিনের জন্য হলেও লন্ডন শহর থেকে অনেক দূরে চলে যাই।
তাছাড়া সবাই জানি যে, ইংল্যান্ডের যেইখানে যাই না কেন, কোণায় কোণায় রয়েছে ইতিহাস আর ইতিহাস। অ্যাডিনবার্গের পর এবার টার্গেট হলো বেলফাস্টে যাওয়ার। বেলফাস্টে যাওয়ার পেছনে শুধু একটিই কারণ, সেটা হলো টাইটানিকের ইতিহাস জানার।
মোটামুটি দেড় থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে পৌছেঁ গিয়েছিলাম বেলফাস্ট এয়ারপোর্টে। বুঝতে আর বাকি রইলো না যে, প্লেন জার্নির কারণে আমাদের অনেকটুকু সময় বেঁচে গিয়েছে। যখন বেলফাস্ট সিটিতে আসলাম তখন এক অন্য রকম অনুভূতি কাজ করেছিল চারদিকের সিগ্যাল পাখি ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখে।
হোটেলে উঠার পর দুপুরের খাওয়াটা শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম বেলফাস্ট সিটি দেখার জন্য। মোটামুটি একটা আইডিয়া ছিল যে কোনো শহর দেখার জন্য প্রথমেই ট্যুরিস্ট বাসের সাহায্য নেওয়া উচিত।
শুধু তাই নয়, এমনকি যেকোনো ঐতিহাসিক স্পটেও আপনি নামতে পারবেন এই ট্যুরিস্ট বাসের মাধ্যমে। কিন্তু পুনরায় আর টিকেট কাটতে হবে না। এক টিকেটে আপনি যেকোনো জায়গায় নামতেও পারবেন আবার উঠতেও পারবেন। এমনকি বাস কন্ডাকটর সাহায্য করবে পুনরায় কোন জায়গা থেকে উঠতে হবে। তবে খুব একটা বেশি নয় টিকেট মূল্য, প্রতি টিকিট সাড়ে ১২ পাউন্ড করে, আবার সেই সাথে আরো আছে স্টুডেন্ট ডিসকাউন্ট।
আগেই বলে নিচ্ছি উত্তর আয়ারল্যান্ড কিন্তু আলাদা কোনো দেশ নয়। এই বেলফাস্টই হচ্ছে উত্তর আয়ারল্যান্ডের বৃহত্তম শহর। এই শহরেই প্রথম জাহাজ শিল্পের বিকাশ ঘটেছিলো বলে মনে করা হয়।
ট্যুরিস্ট বাসের যে জিনিসটি নজর কেড়েছিলো সেটি হলো বাসের ধারাভাষ্যকর প্রত্যেকটি জায়গার সাথে পরিচয় করে দিচ্ছিলো। যার ফলে ঐ জায়গাগুলোর ইতিহাস সম্বন্ধেও আমরা জানতে পেরেছি।
তবে টাইটানিক কোর্য়াটার হচ্ছে বেলফাস্টের ট্যুরিস্টের জন্য সবচেয়ে প্রিয় ও আর্কষণীয় জায়গা। তাছাড়া সবারই জানা আছে যে, এই বৃহদাকার জাহাজটি ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল হিমশৈলের সঙ্গে সংঘর্ষে ডুবে যায়।
তবে অনেকেরই জানা নেই যে, এই টাইটানিক নামটি কোথা হতে এসেছে? গ্রিক পুরাণের শক্তিশালী দেবতার নামানুসারে টাইটানিক নামটি করা হয় এবং এর পুরো নাম ছিলো আরএমএস টাইটানিক।
এমনকি আরেকটি জিনিস জানতে পারলাম, সেটি হলো টাইটানিকের আগে ও পরে আরো দুটি জাহাজ ছিলো যা কিনা আমাদের জানার বাইরে এবং এই তিনটি জাহাজকে একত্রে বলে ‘থ্রি সিস্টারস’। তার মধ্যে টাইটানিক হচ্ছে মেজো বোন, অলিস্পিক হচ্ছে বড় এবং ব্রিটানিক হচ্ছে ছোট বোন।
এমনকি সেই সাথে আরো আছে লাইট অ্যান্ড মিউজিক এর মিশ্রণ, যা কিনা আপনাকে ওই আমলে নিতে বাধ্য করবে। তাছাড়া পাম্প হাউজের পাশে ট্রুরিস্টদের জন্য কফি শপও করা হয়েছে।
ওহ! আরেকটি কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেটি হলো ১৯১১ সালে এই থমসন গ্রেভিং ডক ছিলো পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় ডক। এই ড্রাই ডকের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৮৫০ ফিট এবং তখনকার সময়ে টাইটানিক বা অন্যান্য জাহাজের জন্য ব্যবহার হতো।
আরেকটি পাশাপাশি ডক আছে, যার নাম আলেকজান্দ্রা গ্রেভিং ডক। এ ডকের ভেতরে একটি জাহাজ আছে যার নাম এইচএম কেরোলিন। তবে টাইটানিক মিউজিয়াম দেখার আগে আমরা এসএস নমেডিক জাহাজে উঠেছিলাম। এখানেও টিকেট করে উপভোগ করতে হয়।
সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলাম টাইটানিক বেলফাস্ট দেখে। কারণ এই ছয়তলা বিল্ডিংটির আকৃতি টাইটানিক জাহাজের সামনের অংশটির মতো। তবে টাইটানিক বেলফাস্ট গ্যালারি দেখতে হলে টিকেট করে ঢুকতে হবে।
টিকেটের মূল্য প্রাপ্তবয়ষ্কদের জন্য ১৮ পাউন্ড, ৫-৬ বছরের শিশুদের জন্য ৮ পাউন্ড, ফ্যামিলি প্যাক হচ্ছে ৪৪ পাউন্ড যেখানে ২জন প্রাপ্তবয়ষ্ক ও ২ জন শিশু অর্ন্তভুক্ত।
এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ইভেন্ট ও ইভেন্ট অনুযায়ী রয়েছে টিকেটের মূল্য। তবে এক কথায় টাইটানিকের স্বাদ নিতে হলে সবাইকে এখানে আসা উচিত।
মুভি হওয়ার আগে মানুষ নাকি খুব একটা বেশি জানতো না টাইটানিকের ইতিহাস সম্বন্ধে, বাসের ধারাভাষ্যকরের মতে। এরপর ধীরে ধীরে বেলফাস্ট সিটিটি বিখ্যাত হয়ে গেলো শুধুই টাইটানিকের জন্য।
খুব খারাপ লাগছিলো যখন বেলফাস্ট সিটি থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম লন্ডনের উদ্দেশ্যে। মন চাচ্ছিলো না চলে যেতে, কিন্তু কি আর করা! যেতে তো হবে।
আবার ফিরে আসলাম সেই ব্যস্ত লন্ডনে। তারপরও মনে হচ্ছিলো অনেক কিছু দেখার এখনো বাকি আছে। হয়তো স্বল্প সময়ের জন্য পাহাড় পর্বত, সমুদ্র ও ক্যাসেল কিছুই দেখা হলো না।
যদি আবার সময় ম্যানেজ করতে পারি তাহলে আবার ছুটে আসবো এই উত্তর আয়ারল্যান্ডে। যে কথাটি না বললেই হয় না, সেটি হলো শেষ পর্যন্ত কিন্তু আমার টাইটানিক স্বপ্ন পূরণ হলো।
লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী ও সাবেক গণমাধ্যমকর্মী
ই-মেইল: topu1212@yahoo.com
লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |