প্রবাসেও যখন বাঙালি নারী হিসেবে বৈষম্যে পড়ি

যুক্তরাজ্যের শ্রমআইনের একটি হলো ছাত্র হলে সপ্তাহে বিশ ঘণ্টার বেশি কাজ করা যাবে না। কিন্তু সাপ্তাহিক ছুটির দিন ফুলটাইম করা যায়।

শাফিনেওয়াজ শিপু, যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2017, 02:01 PM
Updated : 8 March 2017, 02:12 PM

আর যদি কেউ নিয়ম ভাঙে তাহলে ছাত্রত্বই বাতিল করে দেবে। বলতে গেলে প্রতিটা মুর্হূত কাটে দুশ্চিন্তার মধ্যে।

স্টুন্ডেট ভিসায় প্রথম যখন যুক্তরাজ্য আসি অন্য সবার মতো আমারও প্রথমে কাজ পেতে কষ্ট হয়। তবে আমার ছোট বোন থাকাতে কাজ যোগাড় করতে খুব একটা কষ্ট হয়নি।

এরপর একদিন লেখাপড়া ও নিজের খরচ চালাতে একটা দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজে ঢুকলাম। কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তে আতঙ্কের মধ্যে থাকতাম। আমি বাঙালি হওয়াতেই হয়তো এতো বৈষম্যের শিকার হয়েছি। আজকে যদি আমি অন্য দেশের নাগরিক হতাম- ইউরোপিয়ান অথবা সাদা চামড়ার, তাহলে হয়তো বৈষম্যের শিকার হতাম না।

অনেকদিন কাজ করার পর অফিসে যখন পুরাতন হলাম, তখন চিন্তা করছিলাম- এবার হয়তো বৈষম্যের পরিমাণ কমবে। কিন্তু না, উল্টো আরও বেড়ে গেল। দুঃখজনক হলেও সত্য বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো এক বাঙালি ম্যানেজার।

প্রথমত আমি নারী। দ্বিতীয়ত আমি এই দেশে আছি স্টুন্ডেট ভিসায়। এই দুটি কারণে বৈষম্যের পরিমাণ আরও বেড়ে গেল।

ডিসেম্বর মাসটার জন্য আমরা ছাত্ররা অপেক্ষা করি ফুলটাইম কাজ করার জন্য। আর সেই সাথে বড়দিন তো আছেই। যুক্তরাজ্যে বড়দিনের পরের দিন কাজ করলে প্রতি ঘণ্টার পারিশ্রমিক দ্বিগুণ হয়ে যায়।

গেলো বছর বড়দিনের পরের দিনের ঘটনা। কাজের জন্য ম্যানেজার আমাকে কল করেছিলেন দোকান খোলার করার জন্য। তিনি বললেন যে আমার প্রতিটি ঘণ্টার পারিশ্রমিক দ্বিগুণ করে দেওয়া হবে। আমি তো কোনো কিছু চিন্তা না করে এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম।

ভেবেছিলাম এটাই সুযোগ টাকা উপার্জন করার। কনকনে ঠাণ্ডার কথা চিন্তাও করিনি একবার। সত্যি কথা কী, বেশি টাকার কথা চিন্তা করে সাথে সাথেই হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম। কারণ যুক্তরাজ্যে বাসা ভাড়া থেকে সবকিছুতেই অনেক খরচ। সেই সাথে আছে টিউশন ফি পরিশোধ করার টেনশন।

যাই হোক, সেই দিন দোকান খোলার জন্য ভোর চারটায় বেরিয়ে পড়লাম। অনেক খুশিতে ছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম পারিশ্রমিক দ্বিগুণ হলে কিছু টাকা জমাতে পারবো।  শেষ পর্যন্ত ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত কাজ করলাম।

ওই দিন কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার পথ ধরেছি। এমন সময় ম্যানেজার আমাকে ফোন দিলেন ধন্যবাদ জানাতে। কারণ যুক্তরাজ্যে ২৬ ডিসেম্বরে সাবওয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দোকান খোলাটা অনেক কষ্টকর সবার জন্য।

কিন্তু তারপরও আমি তাকে বলেছিলাম, আমার কোনো কষ্ট হয়নি কাজ করতে। তবে কষ্ট পেয়েছি তখনই, যখন সে তার (ম্যানেজার) আসল কথাটি বলা শুরু করলেন। 

আমি তো মনে করেছিলাম ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য তিনি আমাকে কল দিয়েছিলেন। কিন্তু তা না। তিনি আমাকে বললেন, “আপনি আজ অনেক কাজ করেছেন, আপনাকে কালকে আর আসতে হবে না। আপনার কাল ছুটি।”

তখন আমি বললাম, “আমি তো ছুটি চাই না। বরং আমার আরও আওয়ার (কাজের সময়) দরকার।” বললাম, “তাহলে তো কালকের কাজের জন্য আমি বেতন পাচ্ছি না!” তখন তিনি বললেন, “আপনি যেহেতু আজকের জন্য দ্বিগুণ পাচ্ছেন, তাহলে আগামীকাল আসার দরকার কী?”

আমি স্তম্ভিত হয়ে তাকে বললাম, “তাহলে আপনারা আজকের কাজের জন্য আমাকে দ্বিগুণ দিচ্ছেন না? আমার তো আগামীকালও কাজ আছে, তাহলে এই কাজের আওয়ারগুলো কেন কাটছেন?”

তখন তিনি বললেন, “দুঃখিত। আসলেই আমার কিছুই বলার নেই, স্যার হুকুম দিয়েছেন।”

আমি বললাম, “লেবার ল’ এদেশে এতো শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও আপনারা আমাদের ওপর অনেক অত্যাচার করছেন। এটা কিন্তু ঠিক না। আজকে আমি যদি ছেলে হতাম, তাহলে কি পারতেন আমার সাথে এটা করতে?”

তারাও খুব ভালো করে জানে- আরে মেয়ে মানুষ তো! আর তার উপর স্টুডেন্ট, যেভাবে বলবো সেভাবেই শুনবে। 

যাই হোক, এরপর আমি অভিযোগ করলাম। তার পরের দিন থেকে আমার আওয়ার আরও কমে গেল। বাহ! চোরের মার বড় গলা, এটাই বুঝলাম। হয়তো অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, কেন এই কাজটি ছেড়ে দিলাম না? কারণ এই দেশে নতুন কোন কাজে নিজেকে মানিয়ে নিতে অনেক সময় চলে যায়। আর তার উপর আওয়ারও কম পাওয়া যায়। সবকিছু চিন্তা করে চাকরিটা ছেড়ে দেইনি।

হতে পারে আমি এই কর্মক্ষেত্রে অনেক আওয়ার পেয়েছিলাম, কিন্তু বৈষম্যের কবলে পড়ে তিক্ত হয়ে গিয়েছিলাম তখন। ইউরোপিয়ানরাও আমাদের সাথে কাজ করতো, কিন্তু তাদের সাথে এমন করতে পারতো না।

বুঝতে পারলাম যে আমরা শুধু বাংলাদেশেই অবহেলিত নই, এমনকি যুক্তরাজ্যেও অবহেলিত। তাও আবার বাঙালিদের দ্বারা। শুধুমাত্র নারী হয়ে জন্ম নেওয়ায় আজকে সব সহ্য করতে হচ্ছে। আমরা বাঙালিরা যে জায়গায় যাই না কেন, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সেই পুরাতন আমলেরই রয়ে গিয়েছে। 

বৈষম্য শব্দটির সাথে আগে অপরিচিত ছিলাম। যখন ছোট ছিলাম তখন, কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে এই শব্দটিই কিনা আমাদের রক্তের সাথে মিশে গেছে।

কেউ কী বলতে পারেন, কোথায় আমরা গিয়ে ঠাঁই নেবো? যেখানেই যাবো, অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হবোই। এর থেকে কি রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই? বিবেকবান উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।

লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী ও সাবেক গণমাধ্যমকর্মী

ই-মেইল: topu1212@yahoo.com

ছবি: শারমিন জান্নাত ভুট্টো

লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com । সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!