এ যেন স্বপ্নের শহর!

ছোটবেলা থেকেই কেন জানি এই দেশটির প্রতি আমার অনেক আগ্রহ ছিল। কারণ অনেক ইতিহাস এই দেশকে ঘিরে, মানে বর্তমানে আমি যে দেশে আছি।

শাফিনেওয়াজ শিপু, যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2017, 04:08 AM
Updated : 25 April 2017, 04:09 AM

জ্বী, আমি ইংল্যান্ডের কথাই বলছি। আসলেই তো! এইখানে আসার পর যা দেখছি, তাতেই আমি মুগ্ধ হচ্ছি! এরপর পরিকল্পনা করলাম, যতদিন এই দেশে আছি, আস্তে আস্তে চেষ্টা করবো পুরো ইংল্যান্ড দেশটিকে উপভোগ করার।

এই পরিকল্পনাটা যখন এখনকার আত্মীয়-স্বজনদের সাথে শেয়ার করলাম, তখন তারা উপদেশ দিলো- এই দেশটি যদি পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে চাও, তাহলে সবার আগে স্কটল্যান্ডে যাও। শুনে প্রথমেই মনে হয়েছিল, কী আছে এমন সেখানে?

যাই হোক, উপদেশটা পালন করলাম এই দেশে আসার ছয় মাস পরে। তখন এক সাথে হলিডে পেয়েছি বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মক্ষেত্র থেকে। প্রথমেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি আত্মীয়-স্বজনদেরকে, কারণ তাদের জন্য নতুন একটি শহরের ইতিহাস-ঐতিহ্য দেখতে ও জানতে পারলাম।  

অনেকেই হয়তো এখনও মনে করে, স্কটল্যান্ড একটি ভিন্ন দেশ। কিন্তু আসলে তা নয়। এটি এখনও ইংল্যান্ডে অর্ন্তভুক্ত। ফলে স্কটল্যান্ডকে আলাদা দেশ হিসেবে আমরা বলতে পারি না। হতে পারে স্কটিশরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিন্ন ইংরেজদের তুলনায়। তারপরও কোনো কিছু চিন্তা না করে ছুটি পাওয়ার সাথে সাথে আর দেরি করিনি।

প্রথমেই একটু মন খারাপ হয়েছিলো, কীভাবে এতো দূরে ভ্রমণ করবো, এই চিন্তা করে। কারণ যদি ট্রেনে যাই, তাহলে লন্ডন থেকে ৪ ঘণ্টা আর বাসে গেলে ৮ ঘণ্টা লাগে। কিন্তু প্লেনে গেলে মাত্র দেড় ঘণ্টা লাগে। যেহেতু প্লেনের টিকিট পাইনি, সেজন্য একটু মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

তাছাড়া হলিডে পেয়েছি মাত্র ৫ দিনের, যেভাবেই হোক ৪ দিনের মধ্যে আমার ট্যুর শেষ করতেই হবে। অবশেষে যাত্রা শুরু করলাম ট্রেনে করে। খুব একটা বেশি ক্লান্ত অনুভব করিনি, কারণ ট্রেনের জার্নিটা অনেক আরামদায়ক ছিল এবং সাথে ছিল প্রকৃতির দৃশ্য।

যখন এডিনবরা বা এডিনবার্গে পৌঁছালাম, তখন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আশেপাশের দৃশ্য দেখে। বুঝতে পারছিলাম না, কী রকম প্রতিক্রিয়া করবো? ঠিক যেমন সিনেমাতে দেখি, সেই রকমই। ওই মুহূর্তে মনে হচ্ছিলো, আমি আসলেই স্বপ্ন দেখছি!

স্কটল্যান্ড মূলত গ্রেট ব্রিটেনের উত্তর-তৃতীয়াংশে অবস্থিত এবং এই এডিনবরা হচ্ছে স্কটল্যান্ডের রাজধানী। এটি ঠিক, ইংল্যান্ড থেকে এখনও দেশটি আলাদা হয়নি, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্কটল্যান্ড, যেমন- বিচার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সংসদ ভবন, নিজস্ব গির্জা, শিক্ষা ব্যবস্থা এমনকি নিজস্ব টাকাও ধরে রেখেছে।

তাছাড়া স্কটল্যান্ড বিখ্যাত তার প্যালেস, হাইল্যান্ডস, হ্রদ ও স্কচ হুইস্কির জন্য। মোটামুটি একটু ধারণা নিয়েই যাত্রা শুরু হলো পুরাতন ও নতুন এডিনবরা বা এডিনবার্গ দেখার। শুরুতেই ট্যুরিস্ট বাসের টিকিট কেটেছিলাম, কারণ পুরো সিটি উপভোগ ও জানার জন্য এই ট্যুরিস্ট বাস গাইড হিসেবে কাজ করবে। তবে টিকিটের দাম খুব একটা বেশি নয়, ১৫ থেকে ২০ পাউন্ড এবং সেই সাথে রয়েছে স্টুডেন্ট ডিসকাউন্ট। হয়তো অনেকের কাছে টিকিটের দামটা অনেক বেশি মনে হতে পারে, তবে পুরো সিটি দেখার জন্য সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে এই ট্যুরিস্ট বাস।

প্রথমেই যে জিনিসটি আমাকে খুবই অবাক করেছে, তা হলো স্কটল্যান্ডের সংসদ ভবনের নিয়মগুলো অনেকগুলো ভাষায় বর্ণনা করা। যাতে করে বিভিন্ন দেশের ট্যুরিস্টরা বুঝতে পারে, তার মধ্যে বাংলা ভাষাও রয়েছে। এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি- নিজের ভাষা, মায়ের ভাষা দেখা!

এরপর স্কটিশ পার্লামেন্টটা ঘুরে ঘুরে দেখেছি। পুরো এডিনবরা বা এডিনবার্গ হচ্ছে পুরাতন প্রাসাদ ও বিল্ডিং দিয়ে আবৃত, এমনকি প্রত্যেকটি অলি-গলি পর্যন্ত পুরাতন বিল্ডিং দিয়ে ঢাকা। বুঝতে বাকি নেই, এগুলোই স্কটিশদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

ইচ্ছে করলে তারা এই সমস্ত পুরাতনগুলো ভেঙ্গে নতুন বিল্ডিং তৈরি করতে পারতো, তাই না? কিন্তু তারা তা করেনি, কারণ তারা খুব ভাল করে জানে, এই পুরাতন বিল্ডিংগুলো হচ্ছে তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

এই শহরের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে এডিনবার্গ ক্যাসেল। পুরো শহরটির মাঝখানে এডিনবরাহ বা এডিনবার্গ ক্যাসেলটি এমনভাবে অবস্থিত, যার কারণে যে দিকে আপনি যান না কেন, এই ক্যাসেলটি আপনার চোখে পড়বেই। এছাড়াও নতুন ও পুরাতন, দুটো সিটিতেই অনেক ভাস্কর্য রয়েছে, যার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে স্কটিশদের ইতিহাস।

তাছাড়া প্রথমে শহরটিকে দেখলেই মনে হবে, পুরো শহরটি যেন পাহাড়ের গায়ে লেগে আছে। মনে হচ্ছে বিল্ডিংগুলো আকাশের সাথে মিশে আছে। তবে লন্ডন শহরের মতো এতো ব্যস্ততা নেই এখানে, নেই কোনো কোলাহল। আছে শুধু সারা শহর জুড়ে ব্যাগ-পাইপারের আওয়াজ, যা কিনা আপনাকে বা আমাকে প্রতি মুহূর্তে মুগ্ধ করবে।

এই ব্যাগ-পাইপার মিউজিক হচ্ছে স্কটিশদের ঐতিহ্যগত মিউজিক। এছাড়াও অনেক জায়গায় দেখেছি, ইউনিকর্নের ছবি বা চিহ্ন। তারপর জানতে পারলাম, এই ইউনিকর্ন হচ্ছে স্কটল্যান্ডের জাতীয় পশু।      

ও আরেকটা কথা, স্কটল্যান্ড তো বিখ্যাত হুইসকির জন্য। তাই সবাই বলেছিল কীভাবে হুইসকি তৈরি করে, তা দেখে আসার জন্য। সেটি দেখারও সৌভাগ্যও হলো। এমনকি অনেক পুরাতন আমলের হু্‌ইসকি রয়েছে, যা কিনা ১৮০০ ও ১৯০০ সালের। তবে যতো পুরাতন হুইসকি, ততো দাম বেশি।

এর পরদিন বের হলাম এডিনবার্গ দুর্গ বা এডিনবার্গ ক্যাসেল দেখার জন্য, যেটি কিনা স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান। এটি মৃত আগ্নেয়গিরির উপরে অবস্থিত। এই দু্র্গটির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মোনস বেগ, ওয়ান ওক্লক বন্দুক, ক্রাউন জুয়েলার্স, সেন্ট মার্গারেটস চ্যাপেল, গ্রেট হল ও স্কটিশ ন্যাশনাল ওয়ার মিউজিয়াম ইত্যাদি।

তবে দুর্গটির ভেতরে ঢোকার পর খালি মনে হচ্ছিলো, আমি ওই আমলেই আছি। আরেকটি কথা বলে নেই, এখানে টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকতে হয় এবং টিকেটের মূল্য নির্ভর করে বয়সের ওপর, যেমন- ১৬-৫৯ বছরের মধ্যবর্তী প্রাপ্তবয়স্কদের প্রবেশের টিকেট মূল্য হলো ১৬ পাউন্ড আর ৫-১৫ বছরের শিশুদের টিকেটের মূল্য হলো ৯.৬০ পাউন্ড।

এটা সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ৬টা পর্যন্ত উন্মুক্ত রাখা হয়। এরপর হলিরুড প্যালেস, কুইনস গ্যালারি, স্কট মনুম্যান্ট ও রয়েল ব্রিটানিয়া ইত্যাদি সব কিছু দেখে মনে হচ্ছিল- এ যেন স্বপ্নের দেশ!

অবশেষে এই ট্যুরের মাধ্যমে বুঝলাম, কেন মানুষ বলে- ইংল্যান্ড দেশকে জানার আগে প্রথমে স্কটল্যান্ডে যাও। তবে যদি কখনও আবার সময় পাই, তাহলে আবার ছুটে যাবো স্কটল্যান্ডে।

এবার তো গিয়েছি এডিনবার্গে, কিন্তু পরবর্তীতে যাবো গ্লাসগোতে বা এবারডিনে। আরও অনেক কিছু দেখার ও জানার বাকি আছে। কারণ পুরো স্কটল্যান্ডে জুড়ে রয়েছে ইতিহাস আর ইতিহাস!    

 লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী ও সাবেক গণমাধ্যমকর্মী     

ই-মেইল: topu1212@yahoo.com

লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!