প্রবাসের চিঠি: সব কাজকেই স্যালুট

ইংল্যান্ডে আসার পর, এখানকার পরিবেশ ও মানুষের সাথে কথা বলার পর সাহস পেয়েছিলাম এখানকার ‘ওড জব’গুলো, মানে ফুড শপ বা রেস্টুরেন্টে কাজ করার।

শাফিনেওয়াজ শিপু, যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2017, 07:22 AM
Updated : 25 May 2017, 07:22 AM

খুব চিন্তায় ছিলাম বেশ কয়েকদিন, কারণ এ ধরনের কাজ করলে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে মুখ দেখাবো কীভাবে এবং বাংলাদেশের মানুষ কী ভাববে আমাকে? সব কিছু মিলে এক ঘোরের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলাম। কিন্তু তারপরও সাহস ও উৎসাহ পেয়েছিলাম প্রতিনিয়ত আমার ছোট বোনের কাছ থেকে।  

এই দেশে নাগরিকত্ব ও ব্রিটিশ পাসপোর্ট পাওয়ার আগ পর্যন্ত সাধারণত সবাইকে এই ধরনের কাজ করতে হয়। তারপর অনেক দিন অপেক্ষার পর এই কাজ পেয়েছিলাম এবং সেই সাথে কোনো কিছু চিন্তা না করে আল্লাহর নামে শুরু করলাম ফুড শপের কাজটি।

প্রতিদিন কাজে যেতাম চোখ ভরা কান্না ও চিন্তা নিয়ে। কিন্তু তারপরও মনে হতো, যদি কাজ না করি, তাহলে বাসা বাড়া,টিউশনি ফিস এবং খাওয়ার খরচ কীভাবে যোগাড় করবো? এই সমস্ত চিন্তা করে কাজে চলে যেতাম।

আমি ‘সেলস্ মেম্বার’ বা কর্মী হিসেবে সামনে কাজ করতাম। তাই অনেক ভয় কাজ করতো- এই বুঝি কোনো বাঙালি দেখে ফেলবে। কে কী বলবে এবং কেউ দেখে ফেলছে কিনা, এই সমস্ত বিষয়গুলো সারাক্ষণ মাথায় কাজ করতো ওই সময়ে। 

বাংলাদেশের মানুষদের তো আসলে কোনো ধারণা নেই, আমরা এখানে কী পরিমাণ কষ্ট করে টাকা উর্পাজন করি। আসলে ধারণা হবেও বা কী করে, ওরা তো আমাদের এই হাসি মুখ দেখে বুঝে নেয় যে আমরা এখানে অনেক ভালো আছি। কিন্তু এই হাসির আড়ালে যে কতো কষ্ট-দুঃখ লুকিয়ে আছে, সেটা বিচার করার ক্ষমতা তাদের নেই। তারা শুধু একটা জিনিসই চিন্তা করে, বিদেশে আছি মানে কতো না ভালো আছি! আর সেই সাথে অনেক টাকা উপার্জন করছি।

এই ফুড শপে প্রথম দিন যখন ৩০টা ট্রে বা প্লেট পরিষ্কার করতে বলা হলো, তখন আমার মনে আছে, আমি কেঁদে দিয়েছিলাম। ওই মুহূর্তে আমার ম্যানেজার আমাকে বুঝাচ্ছিলো, “দেখো সাফী, আমরা জানি বেশিরভাগ মানুষ ভালো পরিবার থেকে আসে। কিন্তু তারপরও এই কাজগুলো করতে হয়। কারণ এই দেশে পাসপোর্ট পাওয়ার আগ পর্যন্ত তোমাকে এভাবে সংগ্রাম করে যেতে হবে।”

ম্যানেজার শুধু আমাকে বোঝাচ্ছিলো তা নয়, এমনকি আমার এক ব্রিটিশ কলিগও আমাকে বললো যে, “দেখো, তুমি এমন দেশে এসেছো যেখানে সবাই সব ধরনের কাজকে শ্রদ্ধা করে। কোনটি ছোট আর কোনটি বড় কাজ, এগুলো কেউ চিন্তা করে না। সুতরাং কে কী বললো মাথায় নিবা না। তুমি তোমার কাজ করে যাও।”  

আরেক ম্যানেজার বললো, “দেখো, আমি কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে এই কাজ করছি। ১০ বছর সংগ্রাম করার পর আজকে এই অবস্থানে এসেছি। প্লিজ সাফী, সব ঠিক হয়ে যাবে, সবেমাত্র তোমার জীবন সংগ্রাম শুরু হলো।”  

তারপরও প্রথম এক মাস খুব কষ্ট ও কান্না নিয়ে কাজ করতাম। তারপর কিছু মানুষের উৎসাহ ও সমর্থনের কারণে দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়ে শুরু করে দিলাম সংগ্রাম জীবন। কিন্তু কিছু চিন্তা তারপরও বেশ কিছুদিন আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিলো।

এটা ঠিক, কোন কাজ ভালো আর কোনটি খারাপ, এতো কিছু যদি চিন্তা করতো এই জাতি, তাহলে আজকে বৃটেন এতো উন্নত হতে পারতো না।  উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাচেতনা একটি জাতিকে উন্নতির পথে যে নিয়ে যেতে পারে আজকের বৃটেন হচ্ছে তারই প্রমাণ।

মানুষ কী ভাববে বা বাংলাদেশে কীভাবে বলবো এই জবের কথা, সারাক্ষণ আমাকে এই চিন্তাটি ঘিরে রাখতো। কারণ আমাদের দেশে এই ধরনের কাজকে কেউ ভালো চোখে দেখে না এবং মেয়ে মানুষ এই ধরনের কাজ করবে চিন্তাই করতে পারে না। শুধু এটাই না, অনেকেই আবার বলে, এ ধরনের কাজ কোনো ভালো পরিবারের মেয়েরা করে না।  

আমার মনে আছে, ২০০৭ সালের একটা কাহিনী। তখন আমি একটা টিউশনি করতাম নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য। সবসময় ভালো লাগতো না বাবার কাছ থেকে টাকা চাইতে, যার কারণে শুরু করে দিলাম এই কাজটি।

ভালোই যাচ্ছিলো এই টিউশনিটি, কিন্তু হঠাৎ একদিন অসুস্থতার কারণে যেতে পারিনি বলে ছাত্রীর মা বাসায় ফোন করে আমার খোঁজ নেন। এরপর একদিন তিনি আমাকে বাসায় ডেকে রীতিমতো অনেক প্রশ্ন করেছিলেন, যা কিনা আমার জন্য অপমানজনক ছিলো।

তিনি আমাকে বললেন, “আমি তো মনে করেছিলাম তুমি গরিব ঘরের মেয়ে, এজন্য তোমাকে কাজটি দিয়েছিলাম। তুমি কেন আমাকে বলোনি তোমার পরিবারের অবস্থা ভালো। শোনো মেয়ে তোমার আসলে এই ধরনের জব করা উচিত না। কারণ এগুলো গরিব ঘরের মেয়েরা করে। সুতরাং এগুলো করো না।”

এই রকম আরও অনেক অপমানজনক কথা বলেছিলেন তিনি। তারপর ওই দিনের পরে আমি আর ওই ছাত্রীকে পড়াতে যাইনি। তখন থেকে শুধু এই জিনিসটি মনে হতো যে, আমাদের দেশের মানুষ সব ধরনের কাজকে সহজে মেনে নিতে পারে না।

কিন্তু এখন বাংলাদেশের মানুষদের চিন্তা-ভাবনার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যার প্রমাণ পেয়েছি ১০ বছর পর। হঠাৎ এতো বছর পর সেই ছাত্রীর মায়ের সাথে কথা হলো এবং উনি জিজ্ঞেস করলেন- এখনকার জীবনযাপন সম্পর্কে। তখনো একটু ইতস্তত বোধ করছিলাম, কীভাবে বলবো- ফুড শপে কাজ করি। কিন্তু বলার পর তিনি আমাকে উল্টো আরও বোঝালেন, “দেখো, কোনো কাজকে ছোট করে দেখা উচিত নয়। সব কাজই করা উচিত, তাহলে বুঝবে টাকা উর্পাজন করাটা কতো কষ্টের।”

বিশ্বাস করুন, আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমার ছাত্রীর মায়ের কথা শুনে! এতো পরিবর্তন ওনার মধ্যে! তখন মনে পড়ে গেল সেই দিনের কথা, যখন তিনি আমাকে বাসায় নিয়ে টিউশনি কাজকে কেন্দ্র করে অপমান করেছিলেন। 

যাক, সেই কষ্ট ও ক্ষোভটা মুছে গেলো ওনার কথা শুনে। এর মাধ্যমেই বোঝা গেল, বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তারপরও সবার উদ্দেশ্যে বলছি, “কোনো কাজকে ছোটো করে দেখা উচিত নয়। সব কাজকে শ্রদ্ধা করা উচিত।”

এই ধরনের মনোভাব জাগ্রত করা উচিত, যাতে করে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আগ্রহ পায় সব ধরনের কাজ করার। তা না হলে দেশে বেকারত্বের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে এবং ছেলেমেয়েরা ধংসের পথে এগিয়ে যাবে।

লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী ও সাবেক গণমাধ্যমকর্মী     

ই-মেইল: topu1212@yahoo.com

লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!