গত দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির লড়াই হলেও এবার নেই বিএনপি।
Published : 25 May 2023, 12:11 AM
দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলর বেছে নিতে ভোট হচ্ছে বৃহস্পতিবার। এটা গাজীপুর সিটির তৃতীয় নির্বাচন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে এই নির্বাচনের দিকেই এখন নজর সবার।
গতবারের চেয়ে এবার গাজীপুর সিটিতে প্রায় ৪২ হাজার ভোটার বেড়েছে। এবার মোট ১১ লাখ ৭৯ হাজার ভোটারের এ সিটিতে ভোট করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
সবশেষ নির্বাচনে ছয়টি কেন্দ্রে ইভিএম ও তিন কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা থাকলেও এবার পুরো সব কেন্দ্রে ইভিএমের পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা থাকছে। ভোটের আপডেট ও ফলাফল দ্রুত সংগ্রহে ব্যবহার করা হবে ট্যাব।
এ নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো অংশ না নিলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, গণফ্রন্ট, ইসলামী আন্দোলন, জাকের পার্টিসহ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অংশ নিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লা খান ও জাতীয় পার্টির এমএম নিজামউদ্দিন থাকলেও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা টিকে না থাকায় তার মা জায়েদা খাতুন ও সরকার শাহনূর ইসলাম রনি মাঠে থাকায় জমে উঠতে পারে এই নির্বাচন।
এদিকে অনিয়ম ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে থাকা কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন ভোটের নির্বিঘ্ন পরিবেশ নিশ্চিতের পাশাপাশি অবাধ, নিরপেক্ষ ভোটের বিষয়ে আশ্বস্ত করেছে।
ঢাকা বিভাগীয় আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম জানান, ইভিএমসহ নির্বাচনের মালামাল প্রস্তুত হয়েছে। ভোটের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।
টঙ্গী ও গাজীপুর পৌরসভাসহ প্রায় ৩৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠিত হয়। ওই বছর ৬ জুলাই নির্দলীয় প্রতীকে হয় প্রথম নির্বাচন।
দ্বিতীয় নির্বাচন হয় ২০১৮ সালের ২৬ জুন। এবার ২৫ মে হতে যাচ্ছে এ সিটির তৃতীয় নির্বাচন।
কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর গেল বছর কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এখন গাজীপুর, বরিশাল, সিলেট, খুলনা ও রাজশাহীর ভোট করবে।
এ লক্ষ্যে গত ৩ এপ্রিল পাঁচ সিটির তফসিল ঘোষণা করা হয়। গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ২৫ মে ভোটের তারিখ রাখা হয়।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ছিল ২৭ এপ্রিল; বাছাই ৩০ এপ্রিল; প্রত্যাহারের শেষ সময় ছিল ৮ মে।
এছাড়া ১২ জুন খুলনা ও বরিশাল সিটিতে এবং ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটিতে ভোট হবে।
গাজীপুর সিটি নির্বাচন ২০২৩
ভোট চলবে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত
১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন ভোটারের মধ্যে পুরুষ ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন; ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী এবং ট্রান্সজেন্ডার ১৮ জন।
একজন মেয়র, ৫৭ জন কাউন্সিলর এবং ১৯ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরকে নির্বাচিত করবেন ভোটাররা।
৪৮০টি ভোট কেন্দ্রের ৩৪৯৭টি কক্ষে ভোটগ্রহণ হবে
সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট হবে।
গণনা শেষে ফল ঘোষণা হবে বঙ্গতাজ মিলনায়তনে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় ও নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে।
প্রার্থী কত
# মেয়র পদে ৮ জন। তাদের পাঁচজন দলীয় প্রতীকে এবং তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্দলীয় প্রতীকে ভোট করছেন।
# সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৪৬ জন প্রার্থী।
# সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ৭৯ জন ভোটের লড়াইয়ে আছেন।
# সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে নির্দলীয় প্রতীকে ভোট হচ্ছে।
মেয়র পদে যারা লড়ছেন
আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা খান (নৌকা)
জাতীয় পার্টির এম এম নিয়াজ উদ্দিন (লাঙ্গল)
গণফ্রন্ট্রের আতিকুল ইসলাম (মাছ)
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজী আতাউর রহমান (হাত পাখা),
জাকের পার্টির মো. রাজু আহম্মেদ (গোলাপ ফুল)।
স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে জায়েদা খাতুন ‘টেবিল ঘড়ি; সরকার শাহনূর ইসলাম রনি ‘হাতি’এবং মো. হারুন-অর-রশীদ ‘ঘোড়া প্রতীক’ নিয়ে লড়ছেন।
ভোটের কর্মীবাহিনী
>> গাজীপুরে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকার আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম।
>> তার সঙ্গে একদল সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহায়ক কর্মকর্তা, পর্যবেক্ষক সমন্বয়কারী।
>> প্রিজাইডিং অফিসার ৪৮০ জন, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ৩৪৯৭ জন, পোলিং অফিসার ৬৯৯৪ জন এবং মোট ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তা প্রায় ১১ হাজার।
নজর রাখবেন যারা
গাজীপুর সিটি নির্বাচন পর্যবেক্ষণে থাকছেন দুইটি সংস্থার ২০ জন সদস্য। আর ঢাকা ও স্থানীয়ভাবে অনুমতিপ্রাপ্ত বিভিন্ন গণমাধ্যমের অন্তত পাঁচশ সাংবাদিক ভোটের সংবাদ সংগ্রহে থাকবেন।
ইসির সহকারী জনসংযোগ পরিচালক আশাদুল হক জানান, পর্যবেক্ষণ নীতিমালা মেনে সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকরা কাজ করবেন।
এছাড়া সাংবাদিকদের মোটরসাইকেল ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা
# ৪৮০ ভোট কেন্দ্রে দশ হাজারের বেশি নিরাপত্তা সদস্য মোতায়েন করা হবে। বিজিবি-র্যাবের হাজারো সদস্য থাকবেন টহলে। পুলিশ-আনসারের টহল টিমে রয়েছে পাঁচ শতাধিক লোকবল।
# প্রতিটি কেন্দ্রে সাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর ১৬ জন ও ১৭ জন করে সদস্য থাকবেন।
এছাড়া ৫৭ জন নির্বাহী হাকিম, ১৯ জন বিচারিক হাকিম ভোটের দিন দায়িত্ব পালন করবেন। তফসিল ঘোষণার পর থেকে মাঠে রয়েছেন আরও ৩ জন নির্বাহী হাকিম।
# পুলিশ-এপিবিএন-আনসার ব্যাটালিয়ান নিয়ে ৫৭টি মোবাইল টিম, ১৯টি স্ট্রাইকিং টিম; র্যাবের ৩০টি টিম এবং ১৩ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) বিজিবি থাকবে নিরাপত্তার দায়িত্বে।
# আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনাররা সরাসরি নজর রাখবেন সিসি ক্যামেরায়।
আগের ফলাফল
নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ২০১৩ সালের প্রথম নির্বাচনে নির্দলীয় প্রতীকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয় হয় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর কাছে।
২০১৮ সালে দলীয় প্রতীকে আওয়ামী প্রার্থী জয় পায় বিএনপি প্রার্থীকে পরাজিত করে। ২০২৩ সালে এসে অবশ্য ভোটে নেই বিএনপি।
শুধু ইউনিয়ন ও পৌরসভা নয়, সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ৩৩০ বর্গ কিলোমিটারে দুটি সংসদীয় এলাকাও দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে।
টেলিভিশনের জয় ২০১৩ সালে: আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে থাকা পৌরসভা ও ইউনিয়নগুলো নিয়ে গঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে বিপুল ভোটে হারেন সরকার সমর্থিত মেয়র প্রার্থী।
১৯৯১ সালের পর থেকে সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া জয়ে রাজধানীর কাছাকাছি এই এলাকাকে নিজেদের ‘ঘাঁটি’ ভেবে আসছিলেন দলটির নেতারা।
সেই ‘ঘাঁটিতে’ গোলযোগহীন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের আজমত উল্লাহ খানকে ১ লাখেরও বেশি ভোটে হারান বিএনপি সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী এম এ মান্নান। টেলিভিশন প্রতীকে মান্নান পান ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৪৪০ ভোট। দোয়াত-কলম প্রতীকে আজমত পান ২ লাখ ৫৮ হাজার ৮৬৭ ভোট।
সেই নির্বাচনে ১০ লাখ ২৬ হাজার ৯৩৮ জন ভোটারের মধ্যে ৬৮ শতাংশ ভোট দেন।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লা ১৯৯৫ সাল থেকে টঙ্গী পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন।
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম মেয়র পদে প্রার্থী হলেও দলীয় হস্তক্ষেপে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। কিন্তু মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় পেরিয়ে যাওয়ায় ব্যালট পেপারে তার নাম থেকেই যায়। তাতে হাজার দেড়েক ভোটও পান জাহাঙ্গীর।
নৌকার জয় ২০১৮ সালে: ২০১৮ সালে দলীয় প্রতীকে ভোট হয়। তাতে দুই লাখ দুই হাজারেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন নৌকার প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম।
এ নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও জালভোটসহ বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ৯টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত হয়।
ঘোষিত ফল (৪১৬ কেন্দ্র) অনুযায়ী, মেয়র পদে নৌকা প্রতীকে জাহাঙ্গীর পান ৪ লাখ ১০ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির হাসান সরকার ধানের শীষ প্রতীকে পান ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬১১ ভোট।
এতে ১১ লাখ ৩৭ হাজারের বেশি ভোটারের এ নির্বাচনে ভোট পড়ে ৫৮%।
একনজরে গাজীপুর সিটি করপোরেশন
বাংলাদেশের সিটি করপোরেশনগুলোর মধ্যে গাজীপুর প্রতিষ্ঠাকালের দিক থেকে কনিষ্ঠতম এবং আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড়। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের আয়তন ৩২৯ দশমিক ৫৩ বর্গকিলোমিটার।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের উত্তরে গাজীপুর সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়ন, দক্ষিণে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও সাভার উপজেলার ইয়ারপুর ইউনিয়ন, পূর্বে গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়িয়া ইউনিয়ন, কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরি ইউনিয়ন ও শ্রীপুর উপজেলার প্রহ্লাদপুর ইউনিয়ন এবং পশ্চিমে কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক ও মধ্যপাড়া ইউনিয়ন এবং সাভার উপজেলার শিমুলিয়া ও দামসোনা ইউনিয়ন।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের জনসংখ্যা প্রায় ৬৫ লাখ।
৫৭টি ওয়ার্ড নিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠিত। দেশের প্রায় ৭৫% গার্মেন্টস শিল্প এই অঞ্চলে অবস্থিত।
আরও খবর
গাজীপুর সিটি নির্বাচন: ভোটকেন্দ্রের তথ্য বিনিময় হবে ‘হোয়াটসঅ্যাপে’
বিধি ভেঙে শোভাযাত্রা: গাজীপুরে কাউন্সিলর প্রার্থীকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা
গাজীপুরে ৩২৫ কাউন্সিলর প্রার্থীর ১৩২ জন স্কুলের গণ্ডি পেরোননি
গাজীপুর ভোট: সেনা মোতায়েন চেয়ে কূটনীতিকদের চিঠি দিলেন জায়েদা
আওয়ামী লীগের কোন্দলে মানুষ ঝুঁকছে হাতিতে: রনি সরকার
গাজীপুরের ভোটের দিকে অনেক দেশ ও সংস্থা তাকিয়ে আছে: আলমগীর
গাজীপুরে নৌকার প্রচারে রিয়াজ-ফেরদৌস-মাহিরা
আজমতের ইশতেহারে গুরুত্ব যানজটে, হোল্ডিং ট্যাক্স হবে ‘সহনশীল’
ভোটের নামে তামাশা না করার আবেদন জাহাঙ্গীরের
টঙ্গীতে জায়েদা খাতুনের গণসংযোগে আবারও হামলা
গাজীপুরে নারী ভোটারদের প্রতি সচেতন থাকতে এনআইডি ডিজির পরামর্শ
গাজীপুরে হামলার নিন্দা, ভোটের মাঠে নিরাপত্তা চান জায়েদা
আজমত ও জায়েদার ভোট ‘নিজের’ টাকায়, রনির খরচ দিচ্ছেন শ্বশুর ও চাচা