আজমত ও জায়েদার ভোট ‘নিজের’ টাকায়, রনির খরচ দিচ্ছেন শ্বশুর ও চাচা

রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, “কোথায় থেকে তারা টাকা পাবেন, কীভাবে খরচ করবেন, সেটি সুস্পষ্টভাবে নির্বাচন কমিশনের ফরমে উল্লেখ করেছেন। নির্বাচনের পর আমরা তাদের হিসাব খতিয়ে দেখব।”

গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 May 2023, 04:02 AM
Updated : 19 May 2023, 04:02 AM

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে যারা লড়ছেন, তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা খান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন নিজের টাকায় ভোট করার হিসাব দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনে।

আরেক আলোচিত প্রার্থী ‘বিএনপি পরিবারের’ স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহ নূর ইসলাম রনি যে খরচ করছেন, তার সিংহভাগ তার সম্পত্তির ভাড়া থেকে এসেছে। কিছু অর্থ দিয়েছেন শ্বশুর, কিছু অর্থ এক চাচা।

আগামী ২৫ মে ঢাকা গাজীপুর নগরে এই ভোটে মেয়র প্রার্থীরা খরচ করতে পারবেন সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা।

প্রচারে নামার আগেই প্রার্থীরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে যে হলফনামা জমা দিয়েছেন, সেখানে নির্বাচনের খরচ ও প্রাপ্তির উৎস সম্পর্কেও জানাতে হয়েছে। সেখানে এসব তথ্যের উল্লেখ আছে।

রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোথা থেকে তারা টাকা পাবেন, কীভাবে খরচ করবেন, সেটি সুস্পষ্টভাবে নির্বাচন কমিশনের ফরমে উল্লেখ করেছেন। নির্বাচনের পর আমরা তাদের হিসাব খতিয়ে দেখব।”

কার টাকার কী উৎস

আজমত উল্লা খান জানিয়েছেন, তিনি তার খরচের সর্বোচ্চ সীমা ৩০ লাখ টাকাই খরচ করবেন। এই পরিমাণ টাকা তার হাতে আছে। নিজের পেশা ও ব্যবসা থেকে এই টাকা জমেছে তার।

হলফনামায় আইন পেশা থেকে আওয়ামী লীগ নেতা আজমত বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ৬ লাখ টাকা। সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকে আমানতের মুনাফা থেকে আসে আরও ৬২ হাজার ৫০৫ টাকা। কৃষি ও তৈরি পোশাকসহ তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে বছরে সম্মানি ভাতা আসে ২৪ লাখ ৩ হাজার টাকা।

সব মিলিয়ে বছরে আয় হয় ৩১ লাখ ৬৫ হাজার ৫০৫ টাকা।

আজমত হাতে নগদ দেখিয়েছেন চার লাখ ৩১ হাজার ৭৩৬ টাকা। স্ত্রীর হাতে নগদ দেখিয়েছেন দুই লাখ ৩৪ হাজার ৫০৬ টাকা।

সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের নির্বাচনে খরচের টাকা আসবে তার ব্যবসা থেকে। হলফনামায় তিনি একটি পোশাক কারখানায় মালিকানার অংশীদারিত্বের তথ্য দিয়েছেন। সেখান থেকে প্রতি বছর আয় আসে।

প্রার্থিতার সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামায় ২০২২-২০২৩ করবর্ষে একমাত্র আয়ের খাত ব্যবসা থেকে ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা আয় দেখিয়েছেন জায়েদা।

আয়কর রিটার্নের পরিসম্পদ, দায় ও ব্যয় বিবরণীতে তিনি ব্যবসার পুঁজি (মূলধনের জের) হিসেবে দেখিয়েছেন ৪ কোটি ৬৬ হাজার টাকা।

অনারেবল টেক্সটাইল কম্পোজিট লিমিটেডে ২৫০০টি শেয়ার আছে তার। তবে এ থেকে আয় কত, তা জানানো হয়নি।

জাতীয় প্রার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিনও নির্বাচনে খরচ করতে চান ৩০ লাখ টাকা। এই টাকার সিংহভাগ দিচ্ছেন তার মেয়ে ও স্ত্রী।

এর মধ্যে স্ত্রী নূর জাহান তার ব্যবসা থেকে দেবেন ১০ লাখ এবং তার প্রবাসী মেয়ে নাফিয়াতুজ সাবরিনা চৌধুরী তার ব্যবসা থেকে দেবেন ১৫ লাখ টাকা। নিজের ব্যবসা থেকে বাকি ৫ লাখ খরচ করবেন লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী।

সাবেক সচিব নিয়াজ বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন চার লাখ টাকা। তার নগদ টাকার পরিমাণ ১২ লাখ ১৯ হাজার ৯৩৪ আর ব্যাংকে জমা ২ লাখ টাকা। স্থায়ী আমানত রয়েছে ৫৫ লাখ টাকা, স্ত্রীর নামে ব্যাংকে রয়েছে ৭৫ লাখ টাকা।

নিজের ৫০ ভরি স্বর্ণ ও স্ত্রীর ১০০ ভরি স্বর্ণ রয়েছে। তার ৩ দশমিক ৬৬ একর কৃষিজমি ও সাত বিঘা অকৃষি জমি রয়েছে।

স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনুর ইসলামের নগদ টাকা আছে ২৫ লাখ; আর ব্যাংকে আছে ১০ লাখ ৫৫ হাজার ৩০৮ টাকা। স্বর্ণ আছে ৫৩ ভরি।

ঘরভাড়া থেকে ১৮ লাখ ও এক চাচার কাছ থেকে তিন লাখ টাকা পাবেন তিনি। বাকি টাকার মধ্যে ব্যবসায়ী শ্বশুর এনামুল হক দেবেন পাঁচ লাখ টাকা। আশরাফুল নামে একজনের কাছ থেকে ধার নেবেন দুই লাখ টাকা। মতিউর রহমান নামের এক ব্যক্তি ‘স্বেচ্ছায় দান’ করবেন সম পরিমাণ টাকা।

রনির চাচা হাসানউদ্দিন সরকার ২০১৮ সালে ধানের শীষ নিয়ে আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর আলমের কাছে হেরে গিয়েছিলেন।

হাসান সরকার এবার তার দল বিএনপির সিদ্ধান্তে ভোট থেকে দূরে। তবে তার পরিবার রনি সরকারের পাশেই আছে।

যে চাচা টাকা দেবেন, তিনি হাসান সরকার কি না, এই প্রশ্নে রনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “না, হাসান চাচার কাছ থেকে টাকা নিচ্ছি না। আমার আরও চাচা আছেন এবং তারা সম্পদশালী। তাদের মধ্যে নাজিম চাচা দেবেন তিন লাখ।”

এই নির্বাচনে আলোচিত আরেক প্রার্থী ইসলামী আন্দোলনের গাজী আতাউর রহমান ভোট করছেন মূলত দলের অনুদানের টাকায়। তিনি সবচেয়ে কম টাকা খরচ করার ঘোষণা দিয়েছেন।

হাত পাখা মার্কার এই প্রার্থী নিজের সম্ভাব্য নির্বাচনী ব্যয় দেখিয়েছেন ৯ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা অনুদান হিসেবে দিয়েছে তার দল। ভাই মোরশেদ আলম ধার দেবেন এক লাখ। বাকি তিন লাখ শিক্ষকতা পেশা তার নিজের আয়।

গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ৩ লাখ টাকা, জাকের পার্টির রাজু আহমেদ ২ লাখ আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হারুন অর রশিদ ১৬ লাখ টাকা সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাব দেখিয়েছেন।

কোন খাতে কত ব্যয়

আজমত যে ব্যয় দেখিয়েছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা দেখিয়েছেন মাইকিংয়ে। এছাড়া হ্যান্ডবিল ছাপানো ও বিতরণে ছয় লাখ, পোস্টারে সাড়ে চার লাখ, ঘরোয়া বৈঠক বা সভায় ২ লাখ ৮৭ হাজার, লিফলেটে খরচ ২ লাখ টাকা, ডিজিটাল ব্যানারে ১ লাখ ৬৫ হাজার, পথসভা ও প্রতীকের পেছনে ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা খরচ ধরেছেন।

বাকি খরচ হবে কর্মীদের পেছনে। এর মধ্যে ৭৫০ জন কর্মীর জন্য ২ লাখ ১৩ হাজার ৭৫০, ভোটকেন্দ্রে এজেন্টদের যাতায়াত খরচ ৬০ হাজার, ক্যাম্প বা অফিস খরচ ৪০ হাজার এবং অফিস আপ্যায়ন খরচ ধরা হয়েছে ৩০ হাজার টাকা।

জায়েদা খাতুন কর্মীদের পেছনে আরও বেশি খরচ করবেন। ভোটের দিন কর্মীদের জন্য বরাদ্দ ৫ লাখ ১৩ হাজার টাকা। কেন্দ্রীয় ক্যাম্প বা অফিস খরচ ও সেখানকার কর্মীদের জন্য ২ লাখ ৩০ হাজার, নির্বাচনী ক্যাম্প ও কর্মীদের জন্য আরও ১ লাখ ৯০ হাজার এবং অফিস আপ্যায়ন ১ লাখ ৭৪ হাজার টাকা রেখেছেন।

তিনি লিফলেটের জন্য ৮ লাখ, পোস্টারের জন্য ৩ লাখ ৪২ হাজার, ঘরোয়া বৈঠকের জন্য ২ লাখ ৫৬ হাজার ৫০০, যাতায়াতের জন্য আড়াই লাখ, মাইকিংয়ে ৯৬ হাজার ৯০০, পথসভার জন্য ৪৫ হাজার ৬০০ টাকা সম্ভাব্য খরচের ধারণা দিয়েছেন।

রনি সরকার লিফলেটে সাড়ে চার লাখ, পোস্টারে তিন লাখ, ব্যানারে আড়াই লাখ, হ্যান্ডবিলে ৪০ হাজার টাকা খরচ দেখিয়েছেন।

এছাড়া ঘরোয়া বৈঠক ও সভায় সাড়ে তিন লাখ, মাইকিংয়ে আড়াই লাখ, পথসভায় ৫০ হাজার, প্রচারে আরও ৪০ হাজার টাকা খরচ দেখিয়েছেন।

৫৭টি ক্যাম্পের জন্য রনি দুই লাখ, কর্মীদের পেছনে দেড় লাখ, অফিসে আপ্যায়নে ৯০ হাজার ও কেন্দ্রীয় ক্যাম্প খরচ দেখিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা।

জাতীয় পার্টির নিয়াজ উদ্দিন হ্যান্ডবিলে ৬ লাখ, লিফলেটে দুই লাখ, ডিজিটাল ব্যানারে ১ লাখ ৬৫ হাজার, মাইকিং, পথসভা ও তার প্রতীকের পেছনে ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা করে, নিজের যাতায়াতে ৭০ হাজার, পথসভায় ৬০ হাজার, ঘরোয়া বৈঠকে ৫০ হাজার ৫০০ টাকা খরচ দেখিয়েছেন।

এছাড়া কর্মীদের জন্য চার লাখ ১৭ হাজার ৭০০ টাকা, নির্বাচনী ক্যাম্পের জন্য ৪ লাখ, অফিসের জন্য ৩ লাখ অফিস আপ্যায়নে ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ রেখেছেন লাঙ্গল মার্কার প্রার্থী।

ইসলামী আন্দোলনের গাজী আতাউর রহমান সবচেয়ে বেশি খরচ করবেন যাতায়াতে। এই খাতে তিনি ব্যয় দেখিয়েছেন পাঁচ লাখ টাকা। এছাড়া পোস্টারে ১ লাখ ৭০ হাজার, নির্বাচনী ক্যাম্প, লিফলেট ও কর্মীদের পেছনে এক লাখ ২০ হাজার টাকা করে খরচ করবেন।

এছাড়া হ্যান্ডবিল ও মাইকিংয়ে ৬০ হাজার টাকা করে, আপ্যায়নে ৪০ হাজার, ব্যানারে ৫০ হাজার, নির্বাচনী প্রতীকের পেছনে ৩০ হাজার এবং ঘরোয়া বৈঠক বা পথসভায় ২০ হাজার টাকা খরচ দেখিয়েছেন হাতপাখার প্রার্থী।