পাসপোর্ট এর মেয়াদ যত ফুরিয়ে আসছিলো, চিন্তা ততই বাড়ছিলো। এমন চিন্তা আমার মনে হয় কমবেশি সবারই হয়। আর পাসপোর্ট করতে গিয়ে কারও যদি আমার মতো আজব অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে হয়তো চিন্তা একটু বেশিই হয়।
Published : 10 Mar 2018, 10:57 AM
আমার জীবনের প্রথম পাসপোর্ট করিয়েছিলাম ফাঁদে পরে দালালের সাহায্য নিয়ে, যে কম পয়সায় করিয়ে দেবে পাসপোর্ট। দালাল বলে দিয়েছিলো, পুলিশ ভেরিফিকেশন হবে। যদি ওসি সাহেব আপনার বাড়িতে এসে যায়, তাহলে হাজারখানেক লাগবে। আর যদি আপনি আগ বাড়িয়ে থানায় চলে যান, তাহলে পাঁচশ’র ভেতরে সেরে নিতে পারবেন।
টাকা তো বড় ব্যাপার না। বিদেশে যখন যাব, টাকা তো কতো কামাতে পারবো। কেনো পাসপোর্ট বানাবো, বিদেশ কেনো যাবো- এসব জিজ্ঞেস করে ওসি সাহেব পিটুনি দেবে না তো! এমন ভয় কাজ করতো মনের মধ্যে।
সে ছিলো এক ভীতিকর অবস্থা! জানালার এই অফিসার বললেন, আমি যে দালালের সাহায্যে পাসপোর্ট করিয়েছি, সেই দালালের কাছে যেন একটু খোঁজ নেই। সর্বশেষ হিসেব করে দেখলাম, যদি ট্রাভেল এজেন্সির সাহায্য নিয়ে পাসপোর্ট করাতাম, তাহলে অনেক কম খরচে করতে পারতাম।
আমাদের দেশে পাসপোর্ট অফিস আর বিমানবন্দরে অহেতুক লোকের ভিড় কবে যে ফুরোবে। একবার রাতে এমিরেটস বিমান যোগে তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নেমে বাইরে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছিলাম, আর এমিরেটস বাসের অপেক্ষা করছিলাম বাড়ি যাওয়ার জন্যে।
হঠাৎ টের পেলাম কেউ একজন আমার শার্ট ধরে টানছে। দেখলাম ছোট্ট এক বাচ্চা। বয়স ছয়-সাত বছর হবে হয়তো। এমন সুন্দর করে হাত-পা বাঁকা করে বলছে, “মামা দেন না, দুইটা টাকা।” কয়েক বছরের প্রশিক্ষণ ছাড়া অমন করে কেউ হাত-পা বাঁকা করতে পারবে না।
যাহোক, বলছিলাম ঘরে বসে পাসপোর্ট করিয়ে নেওয়ার গল্প। পাসপোর্টের মেয়াদ তখনও চার মাস বাকি। জার্মানিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের ওয়েবসাইট পড়ে জানতে পারলাম, পাসপোর্ট করতে মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার কমপক্ষে চার মাস আগে আবেদন করতে হয়। ডিজিটাল পাসপোর্ট নবায়ন হয় না। নতুন করে বানাতে হয়।
তবে কারও কাছে যদি ডিজিটাল পাসপোর্ট থাকে, তাহলে সেটি দিয়ে নতুন পাসপোর্ট সহজে করিয়ে নেওয়া যায়। যেহেতু আমার ডিজিটাল পাসপোর্ট, তাই আমাকে কী করতে হবে, কীভাবে আবেদন করতে হবে- তা বিস্তারিত জানতে চেষ্টা করলাম। দূতাবাসের ওয়েবসাইট পড়ে ও টেলিফোন করে ভালো করে জেনে নিলাম, কীভাবে কী করতে হবে।
সবচেয়ে খুশির সংবাদ ছিলো যে আমাকে পাসপোর্ট করার জন্য কোথাও যেতে হবে না। অ্যাপয়েন্টমেন্ট, ফিঙ্গার প্রিন্ট, ছবি উঠানো, দূতাবাসে দৌড়াদৌড়ি এসব চিন্তা, ঝামেলা করতে হবে না। যেহেতু আমার ডিজিটাল পাসপোর্ট আর আমি নতুন পাসপোর্টে কোনো তথ্য বা ছবি পরিবর্তন করবো না, সেহেতু ঘরে বসে চিঠির মাধ্যমে কাজটি করিয়ে নিতে পারবো।
দূতাবাসের কাছে থাকা আমার পাসপোর্টের তথ্য ও ছবি ব্যবহার করে নতুন পাসপোর্ট বানিয়ে আবার চিঠির মাধ্যমে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
যেভাবে ঘরে বসে পাসপোর্টের আবেদন করলাম:
প্রথমে ব্যাংকে গিয়ে দূতাবাসের অ্যাকাউন্টে ফি জমা করে রশিদ নিলাম। তারপর অনলাইনে ফরম পূরণ করে বারকোড সংবলিত সেই ফরমটি প্রিন্ট করে নিলাম। প্রিন্ট করা ফরমে স্বাক্ষর করে নিলাম। অবশ্য অনলাইনে ফরম পূরণ করতে আমার একটু সমস্যা হয়েছিলো। পরে দূতাবাসে ফোন করে তার সমাধান নিলাম।
পাসপোর্ট করতে প্রয়োজনীয় আরও যেসব দলিলপত্র পাঠাতে হবে, তার একটা তালিকা আগেই করে রেখেছিলাম। সেগুলোর সাথে আমার স্বাক্ষর করা ফরম ও টাকা জমার রসিদ একসঙ্গে একটি খামের ভেতর নিলাম। এটিতে দূতাবাসের ঠিকানা লিখে নিলাম।
খামের মুখ খোলা রেখেই সবগুলো নিয়ে ডাকঘরে গেলাম। খালি খামটিতে ডাকটিকিট লাগিয়ে সেটিকে সবগুলোর সাথে নিলাম। সবগুলো একসাথে ভরে খামের মুখ বন্ধ করে চিঠি রেজিস্টার্ড করে দূতাবাসের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম।
আমি চিঠির মাধ্যমে পাসপোর্টের আবেদন করার সপ্তাহখানেক পরে আমার পাঠানো সেই খামে করে বাংলাদেশ দূতাবাস বার্লিন থেকে একটি চিঠি পাই। চিঠিতে করে আমার পাসপোর্টের ডেলিভারি রিসিট পাঠানো হয়েছিল এবং সেই রিসিটে ইন্টারনেটে আমার পাসপোর্টের অবস্থান জানার জন্যে কিছু নম্বর ছিলো।
এক মাস পর রিসিটে থাকা পাসপোর্ট ডেলিভারি তারিখে ফোন করে জানতে পারি, আমার পাসপোর্ট ঢাকা থেকে তৈরি হয়ে বার্লিনে বাংলাদেশ দূতাবাসে এসে গেছে।
যেভাবে ঘরে বসে পাসপোর্ট নিলাম:
দূতাবাসে না গিয়েও পাসপোর্ট নেওয়া যাবে জেনে ভালোই লেগেছিলো। কারণ দৌড়াদৌড়ির ঝামেলা থেকে একদম বেঁচে গেলাম। এটা কীভাবে করতে হবে- তা আগে থেকেই দূতাবাসের ওয়েবসাইট পড়ে ও দূতাবাসে ফোন করে জেনে রেখেছিলাম।
আবেদনের সময় দূতাবাস থেকে চিঠির মাধ্যমে পাসপোর্টের যে ডেলিভারি রিসিট আমাকে পাঠানো হয়েছিলো, সেটির একটা ফটোকপি ও আমার মূল পাসপোর্ট একটা খামে নিলাম। বাড়তি আরও একটি খালি খাম নিলাম। খালি এই খামটি হচ্ছে ফিরতি চিঠির জন্যে। যেটিতে করে আসবে আমার পাসপোর্ট। সেটিতে আমার ঠিকানা লিখে নিলাম।
খামের মুখ বন্ধ না করে সবগুলো নিয়ে ডাকঘরে গেলাম। খালি খামটিতে ডাকটিকিট লাগিয়ে সেটিকে ডেলিভারি রিসিটের ফটোকপি ও মূল পাসপোর্টের সাথে এক সঙ্গে নিলাম। সবগুলো একসঙ্গে ভরে খামের মুখ বন্ধ করে চিঠি রেজিস্টার্ড করে দূতাবাসের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম।
তার একদিন পরেই ডাকপিয়ন দূতাবাস থেকে পাঠানো পাসপোর্ট ভর্তি ফিরতি চিঠি নিয়ে আমার ঘরের কলিংবেল বাজালেন। দরজা খুলতেই বললেন, আপনার চিঠি নিয়ে এসেছি, দস্তখত করেন। আর এভাবে ঘরে বসেই চিঠির মাধ্যমে পেয়ে যাই আমার নতুন পাসপোর্ট।
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
এই লেখকের আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |