ক্যারোলিনের কাপড় বিক্রির গল্প

২০১৬ সালের জুন মাসে কাজের খোঁজে কিলে এসেছি। জার্মানির একদম উত্তরের শ্লেসভিগ-হোলস্টাইন রাজ্যের রাজধানী শহর কিল। আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয় ‘সেইলিং সিটি’, মানে ‘পালতোলা শহর’।

নাঈম হাবিব, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Jan 2018, 11:29 AM
Updated : 8 Jan 2018, 11:29 AM

এটি ‘স্টুডেন্ট সিটি’ নামেও পরিচিত। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চশিক্ষা নিতে অনেকেই আসেন এ শহরে। আমি গেছি কাজের খোঁজে। তিনদিনের জন্য একটা কামরা নিয়েছি। এ তিনদিন ইন্টারনেট ঘেঁটে স্বল্পমেয়াদি আরেকটা কামরায় বন্দোবস্ত করেছি।

জার্মানিতে যদি কাজ না থাকে তাহলে দীর্ঘমেয়াদে বাসা-বাড়ি ভাড়া নেওয়া কঠিন। কেউ বাসা-বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না। ভাড়া নেওয়ার পর আপনি যদি প্রতি মাসে বাড়িভাড়া মেটাতে না পারেন আর স্বেচ্ছায় যদি বাড়ি ছেড়ে না যান তাহলে বাড়িওয়ালা চাইলে আপনাকে বের করে দিতে পারবে না। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে কয়েক মাস বা বছরখানেকও লেগে যেতে পারে।

তাই বাড়িভাড়া দিতে বাড়িওয়ালারা একটু কঠোর। শুধু কাজ থাকলেই হবে না। সর্বশেষ তিন মাসের বেতনের স্লিপসহ ফরম পূরণ করে বাড়িভাড়া নেওয়ার জন্য আবেদন করতে হয়। তারপর বাড়িওয়ালা ভেবে দেখবেন আপনার কাছে বাড়িভাড়া দেবেন কিনা।

ব্যাগপত্র নিয়ে হল্টেনাউয়ের রাস্তায় আমার নতুন বাসায় উঠেছি। এক বাসা দুই রুম। একটা রান্না ঘর, একটাই বাথরুম। দুই রুমের একটা ব্যালকনি। যার কাছ থেকে রুম ভাড়া নিয়েছি সে মেয়েটির নাম এলিজাবেথ। এলিজাবেথ রাজনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করে। সে জানালো, রাজধানী বার্লিনে তার কিছু ক্লাস আছে। তাকে বার্লিন যেতে হবে একমাসের জন্য। তাই ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দিয়ে তার রুম ভাড়া দিয়েছে এক মাসের জন্য।

এলিজাবেথের বান্ধবীর নাম ক্যারোলিন। এ বাসায় দুই রুমের এক রুমে সে থাকে। এক মাসের জন্য এখন আমি হবো ক্যারোলিনের হাউসমেট। ক্যারোলিনের অনেক জামাকাপড়। এই ধরুন বিশ-পঁচিশ জোড়া জুতো, পনেরো বিশটি শীতের জ্যাকেট। এতো শুধু বাসার বারান্দার হিসাব। তার রুমের ভেতর আরও কত জোড়া আছে সে হিসাব কে জানে!

প্রতিবার যখন ঘরে ফিরি মনে হয় ঘর নয় যেন কোনো কাপড়ের আর জুতোর দোকানে গেছি। বারান্দায় টানানো হ্যাঙারে আমার গায়ের জ্যাকেটটি রাখার জায়গাও নেই। পায়ের জুতো তো দরজার বাইরেই রেখে আসি। এভাবেই চাপাচাপি করে আর কাজের খোঁজে চলে যাচ্ছিলো দিন। কেউ ডাকলে ইন্টারভিউ দিতাম আর আশায় থাকতাম।

একদিন বাসায় ফিরে দেখি ক্যারোলিন তার দোকান গুছিয়ে নিয়েছে। বাসায় এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড় আর জুতো একটা বড় ব্যাগের মধ্যে নিচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি ক্যারোলিন কোথাও যাচ্ছিস? আগে বললিনা যে?’ ক্যারোলিন বললো, ‘যাচ্ছি তবে বেশি দূরে নয়। কাল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মার্কেট বসবে। সে মার্কেটে আমার পুরনো সব কাপড় ও জুতো বিক্রি করে দেবো।’ আমি বললাম, ‘ভালো বুদ্ধি! কোনো হেল্প দরকার হলে আমাকে বলিস।’

গরমকালে জার্মানির ছোট বড় সব শহরেই দেখা মেলে এমন মার্কেটের। কখন কোথায় আগে থেকে বিজ্ঞাপন দিয়েই বসে এ মার্কেট। জার্মান ভাষায় বলা হয় ‘ফ্লহমার্কট’। এ ‘ফ্লহ’ এর ইংরেজি শব্দ হলো ‘ফ্লি’। আর ফ্লি বা ফ্লহ হলো এক ধরণের পোকা, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখির রক্ত খায় এমন পোকা। এরা কাপড়ে বাসা বেঁধে থাকে ও রোগজীবাণু ছড়ায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে এসব অস্থায়ী মার্কেট বসতো। যাদের একটার বেশি জামাকাপড় ছিলো তারা তাদের অতিরিক্ত জামাকাপড় এসব মার্কেটে বিক্রি করে দুই পয়সা আয় করতো। দীর্ঘদিন না ধোয়ার কারণে ময়লা হওয়া সেইসব জামাকাপড়ে ‘ফ্লহ’ জাতীয় একধরণের পোকার দেখা মিলতো। আর সেই থেকে এ মার্কেটের নাম হয়ে যায় ‘ফ্লহ মার্কেট’।

পুরনো কাপড়, জুতো থেকে শুরু করে থালা-বাসন, ঘরের বিভিন্ন জিনিস এমনকি পুরনো অনেক মূল্যবান জিনিসপত্রও কিনতে পারবেন এ ফ্লহ মার্কেট থেকে। যে কেউই বিক্রি করতে ও কিনতে পারেন এখানে। জার্মানরা কিংবা জার্মানিতে বসবাসরত বিদেশিরা খুব আনন্দের সঙ্গে তাদের পুরনো জিনিসপত্রের কেনাবেচা করেন এমন মার্কেটে।

গরমের সময় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে খুব সকালে বসে এ মার্কেট। কম দামে ভালো জিনিসপত্র কেনার আশায় অনেকে খুব সকাল সকাল চলে আসেন। আমাদের দেশে সামর্থবানদের ঘরে আলমারিতে যেসব জামাকাপড় আর সোনাদানা জমা হয়ে থাকে যেগুলি আমরা বিলিয়ে বা ফেলে দেওয়ার সাহস রাখি না। যেসব জিনিসপত্র যা আমাদের কাজে লাগে না তা দিয়ে দেশেও এরকম মার্কেটের আয়োজন করা যেতে পারে।

এতে নিম্নবিত্তরা সস্তায় ভালো জুতো-কাপড় পরার সুযোগ পাবেন। আর সামর্থবানরা কিছু পয়সা আয় করতে পারবেন। আর এ আয় করা টাকা দিয়ে এ মার্কেট থেকেই কোনো নিম্নবিত্তের পুরনো গামছা-লুঙ্গি কমদামে কেনাও যেতে পারে। এমন মার্কেট মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে একে অন্যের আরও কাছে আসার সুযোগ করে দেয়।

সেদিন মার্কেট শেষে ক্যারোলিন হাসিমুখেই বাড়ি ফিরেছিলো। ক্যারোলিন তার জামাকাপড় আর জুতো বিক্রি করে দেড়শ ইউরো আয় করেছিল, বাংলাদেশি টাকায় তা প্রায় পনেরো হাজার টাকা।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!