জার্মানিতে বসবাসরত প্রায় প্রত্যেক বিদেশি নাগরিককেই ভাষা স্কুলে গিয়ে জার্মান ভাষা শিখতে হয়। আর এখানে ভাষা শেখার সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হলো বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হওয়া। তাদের নিজ নিজ দেশ সম্পর্কে জানা।
Published : 03 Feb 2018, 11:46 AM
কিন্তু কঠিন বিষয় হলো জার্মান গ্রামার। গ্রামারে আমি সব সময়ই কাঁচা- হোক সেটি ইংরেজি, বাংলা কিংবা জার্মান। আমাদের ভাষা শিক্ষিকাকে আমরা ‘ফ্রাউ হোবস’ বলে ডাকি। জার্মান ভাষায় ‘ফ্রাউ’ শব্দের মানে হলো মিসেস, আর ‘হোবস’ হলো তার পারিবারিক নাম। ‘হোবস’ শব্দের অর্থ হলো অনেক সুন্দর। নামের সঙ্গে আমাদের ভাষা শিক্ষিকার মিল রয়েছে।
ভাষা কোর্সে আমরা পনেরো-ষোলজন ছাত্র-ছাত্রী। এর মধ্যে ইতালির তিনজন, সিরিয়ার চারজন, আফগানিস্তানের দুইজন, তুর্কির দুইজন, গ্রিসের একজন ও ক্রোয়েশিয়ার দুই জন। সবার কথা উল্লেখ করা সম্ভব নয়। সবাই কোর্স শুরু থেকেই করছেন। শুধু আমিই নতুন। আমি আগে নতুন অবস্থায় কয়েক মাস ভাষা কোর্স করেছি। তারপর বছরখানেক বিরতি নিলাম। বাকি কোর্স পুরো করতে এখন আবার শুরু করেছি।
পুরো কোর্স পড়তে বছরখানেক লেগে যায়। মোট ছয়টি বইয়ে বারোশর মতো পৃষ্ঠা উল্টাতে হয়। গত সপ্তাহে আমরা বই নম্বর তিন পড়ে শেষ করেছি। আমরা এখন বুক নম্বর চারে। জার্মান ভাষায় বলা হয় মডুল চার।
মডুল তিনের শেষের অংশে পাঠে ছিলো ‘হখযাইত’ সম্পর্কে আলোচনা। জার্মান ভাষায় ‘হখযাইত’ শব্দের মানে হলো বিয়ের অনুষ্ঠান। আলোচনার বিষয় ছিলো জার্মানিতে বা আমাদের নিজ নিজ দেশে কীভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে সেসব। বিয়েতে আমন্ত্রিতরা কী ধরনের উপহার দেন এবং কী ধরনের উপহার দিতে মানা এসব বিষয়।
জার্মানিতে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে আপনার পছন্দ বা বর-কনের পছন্দ যদি আপনার জানা থাকে তাহলে সেই অনুযায়ী উপহার দেওয়া যেতে পারে। উপহার হিসেবে এক বোতল ওয়াইন নিয়েও আপনি কারো বিয়ের অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে যেতে পারেন। আমার সহপাঠী আফগানিস্তানের মারিয়াম বললো, তাদের দেশে কারো বিয়ের অনুষ্ঠানে নিজ পছন্দ মতোই উপহার দেওয়া যেতে পারে। তবে ওয়াইন দেওয়া যাবে না, কক্ষনো না।
আরেক সহপাঠী সিরিয়ার নুর বললো, তাদের দেশে বিয়ের সব খরচ বর বা বরের পরিবার দিয়ে থাকেন। এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানে খাওয়াদাওয়ার খরচও বরকেই মেটাতে হয়। ইতালির নাতালিয়া বললো, তাদের দেশে বিয়ের খরচ বর ও কনে দু’জন মিলেই মিটিয়ে থাকেন। বর ও কনের পরিবার এ ব্যাপারে সাহায্য করেন। আর কারো বাবার টাকা থাকলে বিয়েতে উপহার হিসাবে ইতালির বিখ্যাত ব্র্যান্ডের আলফা রোমিও গাড়িও দেওয়া যেতে পারে। অনেকেই দিয়ে থাকেন গাড়ি, বাড়ি।
আমার কাছে আমাদের দেশে বিয়ে সম্পর্কে জানতে চাইলে আমি বললাম, আমাদের দেশে বিয়ের দিনে কনে খুব কাঁদে। কনের বাবার কাছে অনেকক্ষেত্রে কনে ছাড়াও বরের আরও অনেক দাবি থাকে। কনের বাবাকে শুধু মেয়েই নয়, মেয়ের সঙ্গে বরকে কখনও কখনও গাড়ি-ঘোড়াও দিতে হয়। ক্লাসে আমরা সবাই জার্মান ভাষায়ই বলছিলাম এসব গল্প। আমার গল্প সবাই যেনো কেমন নিস্তব্ধ হয়ে শুনছিলো। আমি ততক্ষণে বুঝতে পারলাম, আমার গল্প হয়তো খুব সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে বা বিরক্তিকর।
বললাম, সংবাদপত্রে পড়েছি আমাদের দেশে কিছুদিন আগে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে কেউ একজন গাছের চারা উপহার দিয়েছেন। শুনতেই সবাই হা হা করে হেসে উঠলো। আমাদের শিক্ষিকা বললেন- এটা ভালো বুদ্ধি, এটা ভালো একটি উপহার।
আমাদের দেশে বিয়েতে আমরা গাভী উপহার দিয়ে থাকি, শুনে আবারও হা হা করে সবার হাসি। আমার ফুফাতো বোনের বিয়েতে আমরা গাভী উপহার দিয়েছি। আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন বিয়েতে গাভী উপহার পেয়েছেন। গাভী বংশবিস্তার করেছে। একটা থেকে অনেকটা গাভী হয়েছে। গাভীগুলো দুধ দিচ্ছে। পরিবারের সবাই মিলে খাচ্ছেন। ক্লাসে সবাই এটা মানলেন, উপহার হিসেবে গরু দেওয়াও ভালো বুদ্ধি।
জার্মানিতে বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে বর যখন কনেকে গাড়ি করে বাড়ি নিয়ে যান বন্ধু-বান্ধব মিলে তখন বরের গাড়ির পেছনে রশি দিয়ে খালি টিনের কৌটা বেঁধে দেন। বরের গাড়ি চলে কনে নিয়ে, আর পেছনে শব্দ হয় টুং টাং টুং টাং। এটা জার্মানির পুরনো রীতি, যদিও এখন আর কেউ তেমন করে না।
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
এই লেখকের আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |