কর্ণফুলীর ঘাটগুলোতে শ্রমিকদের কাজের সময় আর দিনরাত্রির হিসাব নেই। তারা জানেও না শ্রম আইন কিংবা আনুষ্ঠানিক শ্রম ঘণ্টার বিষয় আশয়। মে দিবসের কথাও তাদের জানা নেই।
Published : 01 May 2024, 12:29 AM
তাপপ্রবাহের দিনগুলোতেও বিরাম নেই তাদের, ভর দুপুরে প্রখর রোদের মধ্যে মাথায় করে বয়ে নিয়ে চলেছেন বোঝা; কর্ণফুলী নদীর তীরে আনুমাঝির ঘাটে দলবেঁধে এক নাগাড়ে কাজ করে চলেছেন তারা।
তাদেরই একজন আমজাদ হোসেন। তপ্ত রোধে মাথায় প্লাস্টিকের চটের বিড়া। মাথার ওপর করে নিয়ে যাচ্ছেন লবণের টুকরি। দেখতে দেখতে তার এ কাজ করার বয়স এক যুগ হয়ে গেছে। ২০১২ সাল থেকে তিনি লবণ ওঠানামার কাজ করছেন।
বাড়ি ভোলার চরফ্যাশনে, প্রায় ১২ বছর ধরে আছেন চট্টগ্রামে। এ কাজই করছেন শুরু থেকে।
কাজের এক ফাঁকে, কপাল থেকে ঘাম মুছে আমজাদ বলেন, এক বোট লবণ খালাস করতে অন্তত ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি বোট থেকে লবণ খালাস করলে তারা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান। তবে শ্রমিকের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে তা কমবেশি হয়।
তিনি বলেন, এখানে কেউ স্থায়ী শ্রমিক না। যতদিন শরীরের শক্তিতে পারে ততদিন কাজ করে। না হলে অন্য দিকে চলে যান। আবার কাজ না করলে কোনো রোজগার নাই।
শুধু বৈশাখের তপ্ত দুপুরেই নয়, শীত-বর্ষা সব মওসুমেও বিরামহীন কাজ চলে তাদের। কাজে এল মজুরি মেলে, না হলে না।
আনু মাঝির ঘাটের শ্রমিকরা বলেন, সকাল ৬টা থেকে শুরু হয় তাদের কাজ, চলে রাত ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত।
আমজাদ বলেন, “যতক্ষণ বোট থাকবে আমরা মাল নামাব। আবার ‘ধোলাইয়ের’ পর সেগুলোর বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর জন্য গাড়িতে তোলার কাজও করতে হয়।”
অপরিশোধিত লবণ পরিশোধনের কাজটি শ্রমিকদের কাছে ‘ধোলাই’ নামে পরিচিত।
শুধু আনুমাঝি ঘাট নয়, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ১৬টি ঘাটের শ্রমিকদের নিত্যদিনের কাজের চিত্র কমবেশি এমনই। এসব ঘাটে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের মালামাল, খাদ্যশস্য, লবণ কিংবা পাথর ওঠানামা করা হয় জাহাজ কিংবা ট্রলার থেকে।
তপ্ত রোদে শরীর থেকে ঘাম ঝরলেও দম ফেলার ফুসরত নেই তাদের। যত দ্রুত একটি ট্রলার বা লাইটারেজ জাহাজ থেকে মালামাল খালাস করতে পারবেন, ততেই দ্রুত কাজ ধরতে পারবেন আরেকটির।
ভোরের আলো ফোটার পর থেকে দুপুরের তপ্ত রোদ, অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে যান তারা; যাদের নেই কোনো কর্মঘণ্টা, নিয়োগপত্র ও শ্রমিকের আইনগত সুবিধাদি।
এসব শ্রমিকদের ভাষ্য, “শরীরে যতক্ষণ ‘শক্তি’ আছে, ততক্ষণ কাজ করতে হবে। কাজ না করলে কোনো রোজগার নাই। কেউ এক কাপ চাও খাওয়াবে না।”
শ্রম ঘণ্টার হিসাব নিকাশের বালাই নেই তাদের কাছে। তারা জানেও না শ্রম আইন কিংবা আনুষ্ঠানিক শ্রম ঘণ্টার বিষয় আশয়। মে দিবসের কথাও তাদের জানা নেই।
শ্রমের ন্যায্য মূল্যের জন্য শ্রমিকদের জীবন বাজি রাখা আন্দোলনের ইতিহাস তারা শোনেইনি।
১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে হে মার্কেটের শ্রমিকরা শ্রমের ন্যায্য মূল্য এবং আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলন দমনে সেদিন শ্রমিকদের ওপর গুলি চালানো হয়েছিল। ১০ শ্রমিকের আত্মত্যাগে গড়ে ওঠে বিক্ষোভ। প্রবল জনমতের মুখে যুক্তরাষ্ট্র সরকার শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ করতে বাধ্য হয়।
১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের প্যারিসে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর শ্রমিকদের সংগ্রামী ঐক্যের অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস ঘোষণা করা হয়।
১৮৯০ সাল থেকে সারাবিশ্বে শ্রমিক সংহতির আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে মে মাসের ১ তারিখে 'মে দিবস' পালিত হয়।
কিন্তু মে দিবস আসে-যায়, কর্ণফুলী ঘাটে কাজ করা শ্রমিকদের কাজের বিরাম নেই; বেশির ভাগই জানেই না ‘মে দিবস’ কী?
সারাবিশ্বে শ্রমিক সংহতির আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে বুধবার বাংলাদেশেও পালিত হবে মহান 'মে দিবস'।
ঘাটের কাজে নেই দিবসের ছোঁয়া
মাঝিরঘাটে ফিরোজ নামে আরেক শ্রমিক বলেন, গরমের কারণে একটানা কাজ করা সম্ভব হয় না। কিছুক্ষণ কাজ করে বিশ্রামে যেতে হয়। চা নাস্তা খেয়ে আবার কাজ ধরতে হয়।
কিছুটা দূরের আজিজ কলোনি ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, কাজের ফাঁকে ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন কয়েকজন শ্রমিক।
আব্দুল হাই নামে এক শ্রমিক বলেন, কখনও তিনি লবণ ওঠানামা, আবার কখনও পাথর এবং অন্যান্য মালামাল ওঠানামার কাজ করেন। প্রতিদিন আয় হয় ছয় থেকে সাত’শ টাকা।
তিনি বলেন, এক টুকরিতে ৫৩-৫৬ কেজি পর্যন্ত লবণ থাকে। হিসাবে প্রতি টুকরি লবণ ওঠানামায় মজুরি পান আট টাকা। একইভাবে অন্যান্য মালামালের বস্তাগুলোও হয় কাছাকাছি ওজনের।
অন্য ঘাটে শ্রমিকরা জাহাজের ক্রেনের জালে তুলে দিচ্ছেন পাথর, সেগুলো ক্রেন দিয়ে তোলা হচ্ছে ট্রাকে। আবার কয়েকটি ঘাটে গমসহ বিভিন্ন খাদ্যশস্য ভর্তি বস্তা জাহাজ থেকে নামিয়ে নেওয়া হচ্ছে গুদামে কিংবা ট্রাকে।
মাঝিরঘাট স্ট্যান্ড রোড এলাকায় রয়েছে ছোট বড় মিলিয়ে ৫৬টি লবণ মিল। যেগুলোর মধ্যে অন্তত ৩০টি মিলে লবণ প্রক্রিয়াজাত করার কাজ হয়। এসব মিলে লবণ আনা নেওয়া এবং প্রক্রিয়াজাতকরণসহ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত আছে কয়েক হাজার শ্রমিক।
পাশাপাশি ঘাটগুলোতে বিভিন্ন লাইটারেজ থেকে পাথর এবং খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য মালামাল নামানোর কাজগুলোও করে থাকেন এসব শ্রমিক।
এগুলোর কয়েকটি ঘাটে গিয়ে দেখা যায় কিছু শ্রমিক মাথায় লবণের টুকরি, বস্তা আবার কেউ ক্রেনের নেটে পাথর বোঝায়ের কাজ করছেন। আবার কিছু ক্লান্ত শ্রমিক কাজের ফাঁকে ছায়ায় একটু জিড়িয়ে নিচ্ছেন।
শ্রমিকরা বলেন, তারা মূলত বিভিন্ন ঠিকাদারের অধীনে কাজ করেন। এ ঠিকাদারগুলো তাদের কাছে ‘মাঝি’ নামে পরিচিত। মিল বা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন মাঝির (ঠিকাদার) সাথে চুক্তি করে শ্রমিক সরবরাহের জন্য। তাদের সরবরাহ করা শ্রমিকদের মাধ্যমেই মূলত ট্রলার কিংবা জাহাজ থেকে মালামাল উঠানামা করেন।
প্রতিদিন কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলা ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা থেকে অপরিশোধিত লবন নিয়ে চট্টগ্রামে আসে শতাধিক বোট। যেগুলোর প্রতিটিতে ১২ থেকে ১৩’শ মণ পর্যন্ত লবন থাকে।
লবণ নামিয়ে মিলে গুদামজাত এবং প্রক্রিয়াজাত করে সেগুলো পুনরায় গাড়িতে তুলে দেন বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর জন্য।
ঘাটে থাকা শ্রমিকরা বলেন, এ কাজের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা নেই। প্রতিদিন নতুন নতুন লোক আসে, আবার চলেও যায়। ঘাটে মাঝির কাছে আসলেই কাজ পাওয়া যায়।
মাঝবয়সী শ্রমিক আব্দুল হাই বলেন, যতক্ষণ নিজের শক্তি আছে, ততক্ষণ কাজ করতে পারবেন। কাজ না করলে কেউ এক কাপ চাও খাওয়াবে না।
“২০ বছর ধরে চট্টগ্রামে আছি। ঘাটে শ্রমিকের কাজ করি। কখনও লবণ, আবার কখনও পাথর ওঠানামা করি।”
তবে শ্রমিকদের ভাষ্য, লবণ বা অন্যান্য মালামাল উঠানামার চেয়ে পাথর ওঠানামা বেশি কষ্টের। জাহাজের হেজ থেকে পাথর ক্রেনের নেটে তুলে দিতে হয়। সেগুলোতে প্রচুর ধুলা হয়।
পাথর উঠানামার ধুলার কারণে অন্যান্য শ্রমিকদেরও কাজে ব্যাঘাত হয় ভাষ্য তার।
ঘাটের এ শ্রমিকরা বলেন, আমাদের কাছে ‘মে দিবস’ যা, সাধারণ দিনও তা। কাজ করতেই হবে। কাজ বন্ধ থাকলে রোজগারও বন্ধ। রোজগার না থাকলেও খাব কী?
‘বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬’ এর ধারা-২ এর উপধারা ৭-এ বলা আছে “কোন ঘর-বাড়ি বা আঙ্গিনা যেখানে বৎসরে কোন দিন সাধারণত পাঁচ বা ততোধিক শ্রমিক কর্মরত থাকেন এবং উহাদের যেকোন অংশে কোন উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু থাকে সেটি কারখানা বলে বিবেচিত হবে।”
কিন্তু নদীর ঘাটে কাজ করা শ্রমিকরা কোন কারখানার অধীনস্থ শ্রমিক নন।
পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কেন্দ্র (ওএসএইচ সেন্টার), বিলস-ডিটিডিএ প্রকল্প সমন্বয়ক ফজলুল কবির মিন্টু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শ্রম আইনের ৩ (ক) এর উপ-ধারা ৩ অনুসারে ঠিকাদারের অধীনে নিযুক্ত শ্রমিকরাও শ্রম আইনের আওতাভুক্ত থাকবেন।
“অর্থাৎ শ্রম আইন অনুসারে সকল প্রকার সুবিধা ও অধিকার তারা ভোগ করতে পারবেন।”
এদিকে শ্রম আইনের ১০০ নম্বর ধারায় বলা আছে, “কোন প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিক কোন প্রতিষ্ঠানে সাধারণত দৈনিক আট ঘন্টার অধিক সময় কাজ করিবেন না, বা তাহাকে দিয়ে কাজ করানো যাইবে না।
১০৩ নম্বর ধারায় বলা আছে, দোকান, বাণিজ্য বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রতি সপ্তাহে দেড় দিন এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একদিন ছুটি পাবেন।
এছাড়া ১১৬ ধারায় অসুস্থতা জনিত ছুটির বিষয়ও উল্লেখ আছে।
কিন্তু কর্ণফুলী নদীর ঘাটের মত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক শ্রমিক। যাদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। যাদের নেই কোনো কর্মঘণ্টা কিংবা ছুটি। কাজ করলেই তাদের পেট চলে, বসে থাকলে চলে না।