“সমুদ্রের নীল জলরাশি আমাকে টানে, আমাকে ডাকে। আমি এ চাকরি ভালোবাসি। আবারও সুযোগ পেলে সমুদ্রে যেতে চাই,” বলেন ক্যাপ্টেন রশিদ।
Published : 17 May 2024, 01:01 AM
জিম্মিদশার শুরুর দিন থেকেই প্রচণ্ড মানসিক চাপে ছিলেন সোমালি জলদস্যুর কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা। তাদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে দলনেতা হিসেবে জলদস্যুদের সঙ্গে বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিতে হত ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদকে।
তেত্রিশ দিনের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়ে আরও একত্রিশ দিন পরে দেশের মাটিতে ফিরে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন তারা। বৃহস্পতিবার এক সাক্ষাৎকারে ক্যাপ্টেন রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন সেই দুর্বিষহ সময়ের নানা ঘটনার কথা।
এরমধ্যে ঈদের দিন জাহাজে নাবিকদের নামাজ পড়ার যে ছবি সারা দেশের মানুষকে একটু হলেও স্বস্তি দিয়েছিল, সেই ছবির কারণেই বড় ধরনের বিপদে পড়তে যাচ্ছিলেন জাহাজের চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান। সেদিনও তাকে রক্ষায় মূল ভূমিকা নিতে হয় ক্যাপ্টেন রশিদকে।
ভয়ঙ্কর সেসব অভিজ্ঞতার পরও সাগরের নীল জলরাশি হাতছানি দিয়ে ডাকে এই নাবিককে। সুযোগ পেলে আবারও তিনি সমুদ্রগামী জাহাজে উঠে পড়তে চান।
মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে আরব আমিরাতে যাবার পথে গত ১২ মার্চ সোমালি উপকূল থেকে প্রায় ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে সশস্ত্র জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ।
সেদিনের কথা স্মরণ করে জাহাজের ক্যাপ্টেন রশিদ বলেন, “সশস্ত্র দস্যুরা জাহাজে ওঠার পর এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই। ওই সময় নাবিকদের মনোবল চাঙ্গা রাখা দরকার ছিল। জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে এটা আমার জন্য ছিল চ্যালেঞ্জ।”
রশিদ নিজেও মানসিকভাবে খুব একটা ভালো অবস্থায় ছিলেন না। তবে দলনেতার দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি সেটা কাউকে বুঝতে দেননি। নিজেকে শক্ত রেখে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে যান।
তিনি বলেন, জলদস্যুরা জাহাজে উঠে অস্ত্রের মুখে তাদের জিম্মি করে। প্রথমে তারা ১০ জন জাহাজে ওঠে। দ্বিতীয় দফায় আরও ১২ জন। জাহাজ সোমালিয়া উপকূলের কাছে নিয়ে যাবার পর সবমিলিয়ে ৬৫ জন জলদস্যু সশস্ত্র অবস্থায় ডেকে অবস্থান নেয়।
“শুরুর সময় থেকে আমি চেষ্টা করেছি জলদস্যুদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণের মাধ্যমে সম্পর্ক সহজ করার। মূলত আমরা যাতে সুস্থ থাকতে পারি, কোনো প্রাণহানির ঘটনা যাতে না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রেখে তাদের সাথে আলোচনা চালানোর চেষ্টা করেছি।”
ক্যাপ্টেন রশিদ জানান, জলদস্যুদের দ্বিতীয় দলের সঙ্গে ইংরেজি জানা একজন দোভাষী জাহাজে ওঠে। তখন তাদের সঙ্গে আলোচনা করা সহজ হয়।
“যেদিন জলদস্যুরা জাহাজের দখল নিল, সেদিন দ্বিতীয় রোজা। আতঙ্কের পরিবেশের মধ্যে আমরা ওইদিন ঠিকমত ইফতারও করতে পারিনি। প্রথম দিন জাহাজের ডেকে জড়ো হয়ে সবাই ফলমূল দিয়ে ইফতার সেরেছিলাম। পরে জলদস্যুদের সাথে সম্পর্ক সহজ হওয়ার পর নাবিকরা স্বাভাবিকভাবেই ইফতারি ও সেহেরি করতে পেরেছে।”
তিনি জানান, জিম্মি হওয়ার পর শুরুর কয়েক দিন ২৩ নাবিকের সবাইকে একটি টয়লেট ও ওয়াশরুম ব্যবহার করতে হয়েছে। দস্যুদের দোভাষী আসার পর তার মাধ্যমে কৌশলে কথা চালিয়ে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হয়েছে।
“জিম্মি পরিস্থিতিতে জাহাজে সকল কাজই তাদের দলনেতার অনুমতি নিয়ে করতে হত। আহমেদ নামের ওই দোভাষী জাহাজে ওঠার পর থেকে আমরা তাকে সমস্যাগুলোর কথা বলার চেষ্টা করি। তখন থেকে নাবিকরা ডেকের বদলে কেবিনের বিভিন্ন টয়লেটে ব্যবহারের অনুমতি পায়।”
জলদস্যুরা জাহাজের ডেকের সি সাইডের ওয়াশরুম ব্যবহার করত। তাতে জাহাজে সংরক্ষিত পানি ব্যবহারও কম হত। নাবিকদের বন্দিদশার সময়ে দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খাবার ও পানি সংকটের কথা বলা হলেও ‘সত্যিকার অর্থে সংকট ছিল না’ বলে জানান ক্যাপ্টেন রশিদ।
তিনি বলেন, “দস্যুদের চাপে রাখার জন্যই আমরা খাবার ও পানি সংকটের কথা বলেছিলাম। কৌশল হিসেবেই পানি ও খাবারের বিষয়টি আমরা সামনে এনেছি। আমাদের জাহাজে পর্যাপ্ত খাবার ছিল, যা দিয়ে কয়েক মাস চলা সম্ভব ছিল। আমরা মুক্ত হবার পর আরব আমিরাত যাওয়া ও দেশে ফেরার সময় পর্যন্ত পানি ছিল। এ কৌশল আমাদের কাজ দিয়েছিল সে সময়।”
জিম্মিদশায় সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কী ছিল? ক্যাপ্টেন রশিদ বলেন, জাহাজে জলদস্যুদের যে কমান্ডার, তার কথাতেই সেখানে সব চলত। সে গুলি করতে বললে অন্যরা গুলি করবে– এমনই পরিস্থিতি ছিল।
“আমরা সন্ত্রস্ত অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলাম। দোভাষীর মাধ্যমে মালিকপক্ষের সঙ্গে মুক্তি নিয়ে নেগোসিশেনও হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে নাবিকদের ঈদের দিন নামাজ পড়ার ছবি ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাইরে চলে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে দস্যুরা খেপে যায়।
“চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খানের ক্যামেরায় ওই ছবি তোলা হয়েছিল। দস্যুদের কমান্ডার ক্ষেপে গিয়ে আতিকসহ সকল নাবিককে জাহাজের ব্রিজে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখে। অস্ত্রের মুখে আতিককে মারতে উদ্যত হয়।”
ওই অবস্থায় দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলে দস্যুদের কমান্ডারকে জড়িয়ে ধরে তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন ক্যাপ্টেন রশিদ।
“পরবর্তীতে কোনো রকমে পরিস্থিতি শান্ত হয়। আতিকের ওই ক্যামেরা তারা ছিনিয়ে নিয়েছিল। তখন একটা কঠিন সময় গেছে আমাদের।”
এক প্রশ্নের জবাবে রশিদ বলেন, জাহাজ দস্যুদের দখলে থাকলেও কৌশলে ইন্টারনেট এবং জাহাজের অবস্থান নির্ণয় করার যন্ত্র তারা চালু রেখেছিলেন সবসময়। নাবিকরা লুকিয়ে নিয়মিতই ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলত। সেটা বন্দিদশায় তাদের মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখতে সহায়ক হয়েছিল।
“ক্যাপ্টেন হিসেবে আমি নিজেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে জাহাজের মালিকপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতাম। জাহাজ কোন এলাকায় অবস্থান করছে তাও মালিকপক্ষ প্রতিদিনই জানতে পেরেছে। কিন্তু ঈদের দিনের ছবি বাইরে চলে যাওয়ার পর জলদস্যুরা জাহাজের ইন্টারনেট বন্ধ করতে চাপ দেয়।
“ডেক, ব্রিজসহ বিভিন্ন স্থানের ইন্টারনেট রাউটার বন্ধ করা হলেও মালিকপক্ষের সাথে যোগাযোগের জন্য কৌশলে একটি কানেকশন অক্ষত রাখতে পেরেছিলাম। বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়া পর্যন্ত ওই ইন্টারনেট সংযোগ অক্ষত ছিল।”
ক্যাপ্টেন রশিদ বলেন, বন্দি অবস্থায় খাবার ও পানি বাঁচানো এবং জলদস্যুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট’ ছিল তাদের মূল চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া অস্ত্রের মুখে থাকা বন্দি নাবিকদের মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখাটাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ক্যাপ্টেন হিসেবে সেই দায়িত্ব অনেকটাই পালন করতে পেরেছেন বলে এখন তার মনে হয়।
নাবিকরা সবাই বাংলাদেশি মুসলমান জানার পর জলদস্যুরা ‘কিছুটা সদয়’ হয় বলেও মনে করেন রশিদ। তিনি বলেন, নাবিকরা নিয়মিত নামাজ রোজা করতেন। দস্যুরা সেটা পর্যবেক্ষণ করত।
তবে এমনিতে দস্যুরা সবাই ‘নির্দয় প্রকৃতির’ ছিল জানিয়ে ক্যাপ্টেন রশিদ বলেন, “এক মাসের বেশি সময় পার করেও তাদের পারমিশন ছাড়া কোনো কিছু করা যেত না। এমনকি তারা নিজেদের লোকদেরও কোনো বিষয়ে ন্যূনতম ছাড় দিত না।”
জিম্মিদশার তেত্রিশ দিনের মাথায় বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে মুক্তি পায় আবদুল্লাহ এবং এর ২৩ নাবিক। সেখান থেকে আরব আমিরাতের বন্দরে পৌঁছে কয়লা খালাস করে চুনাপাথর তোলা হয়। সব শেষে আবদুল্লাহ বাংলাদেশের কুতুবদিয়া উপকূলে পৌঁছায় ১৩ মে।
পরদিন জাহাজের ২৩ নাবিক মালিকপক্ষ এস আর শিপিংয়ের একটি লাইটারেজ জাহাজে করে চট্টগ্রামে বন্দরে পৌঁছায়।
ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ পরিবার নিয়ে থাকেন ঢাকায়। ১৯৮৯ সালে তিনি ক্যাডেট হিসেবে জাহাজে কাজ শুরু করেন। কেএসআরএম গ্রুপের মালিকানাধীন এস আর শিপিংয়ের তিনটি জাহাজে ক্যাপ্টেন হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
ক্যাপ্টেন হিসেবে রশিদের অভিজ্ঞতা প্রায় ১৬ বছরের। এরমধ্যে সর্বশেষ যাত্রায় তাকে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হল।
আবদুর রশিদ বলেন, “জাহাজের চাকরি আমার পেশা। সমুদ্রের নীল জলরাশি আমাকে টানে, আমাকে ডাকে। আমি এ চাকরি ভালোবাসি। আবারও সুযোগ পেলে সমুদ্রে যেতে চাই।”