হিমঝরা এক রাতে শহর থেকে রিকশায় করে বাড়িতে ফিরছি। এসময় মনে হলো, এ শীতে পাহাড় ভ্রমণ করলে নিশ্চয়ই ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা জমবে ভ্রমণের ঝুলিতে।
Published : 22 May 2024, 04:13 AM
হিমঝরা এক রাতে শহর থেকে রিকশায় করে বাড়িতে ফিরছি। এসময় মনে হলো, এ শীতে পাহাড় ভ্রমণ করলে নিশ্চয়ই ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা জমবে ভ্রমণের ঝুলিতে। আর তা যদি হয় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের কোল ঘেঁষে থাকা এলাকায়, তাহলে তো কথাই নেই!
ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা এক বড় ভাই ছিলেন সঙ্গে। ভাবনাটা জানাতেই ভ্রমণপিপাসু মানুষটা তক্ষুনি পাহাড়ে যেতে রাজি হয়ে গেলেন। দুজন নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি ইউনিয়নে বিজয়পুর গ্রামের চীনামাটির পাহাড় ভ্রমণে যাচ্ছি, এই সিদ্ধান্ত নিতে সামান্যও সময়ক্ষেপণ হয়নি।
পরদিন সকালে বাড়ির সামনের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতেই সূর্য আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। দশ মিনিট হেঁটে হাটখলা বাজারে গেলাম। গুগল ম্যাপের তথ্যমতে, এখান থেকে দুর্গাপুরের বিজয়পুর গ্রামের দূরত্ব ৩৩ কিলোমিটার। মোটরসাইকেলে যেতে লাগবে এক ঘণ্টা ১২ মিনিট। নেত্রকোণা সদরের মৌগাতি ইউনিয়নের এই বাজার থেকে দুইভাবে বিজয়পুর যাওয়া যায়। সরাসরি মোটরসাইকেলে অথবা অটোরিকশা দিয়ে কয়েক ধাপে।
আমরা তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য এক হাজার টাকা দিয়ে সারাদিনের জন্য একটি মোটরসাইকেল ভাড়া করে নিলাম। চড়ে বসলাম। রাস্তার দুই পাশে কখনো সবুজ গাছপালা, কখনো সবুজ ফসলি জমি চোখের পর্দায় দ্রুতগতিতে ভেসে যাচ্ছে। বাতাসে আমার লম্বা চুল দুলছে।
সামনে পড়লো কংস নদী। ঘাটে নামলাম। স্থানীয়রা একে ‘ডেউটুকোন গুদারাঘাট’ নামে ডাকে। এইমাত্র পারাপারের ট্রলারটি যাত্রী নিয়ে ওই পারে গেছে। আমরা অপেক্ষা করছি, পুনরায় এপারে আসতেই গাড়িসহ ট্রলারে উঠে পড়লাম। মনে পড়লো একটি গানের কথা- ‘বন্ধুর বাড়ি, আমার বাড়ি, মাঝখানে বয়ে যায় সোমেশ্বরী...’। দু’এক মিনিটেই অসংখ্য মোটরসাইকেল ও গাড়িসহ ত্রিশ-চল্লিশজন যাত্রী হয়ে গেল। জনপ্রতি ৫ টাকা করে ভাড়া দিয়ে পেরোলাম এই নদী।
দেখলাম সামনে সীমান্ত, আর ডানে বিজিবি ক্যাম্প। বলে রাখি, আমাদের গন্তব্য বিজয়পুরের চীনামাটির পাহাড় হলেও আমরা কিন্তু এক ঢিলে কয়েক পাখি মারবো ভাবছি। তাই পেছনে চীনামাটির পাহাড় রেখেই আমরা সীমান্তের কাছাকাছি চলে এলাম। এখানে বেশকিছু দোকানপাট আছে। দোকানে ভারতীয় সাবান ও শ্যাম্পুসহ অনেক পণ্য পাওয়া যায়। আমরা একটি চায়ের দোকানে বসে চা খেয়ে নিলাম। তারপর বিজিবি ক্যাম্পের ডানদিক দিয়ে একটু পূর্বদিকে গেলাম।
চোখে পড়লো এদিকের লাস্যময়ী সোমেশ্বরী নদী। দু’পাশে চর জেগে আছে। নদীর ওপারে উঁচু উঁচু পাহাড়। মনোলোভা ঘন সবুজ ওই পাহাড়গুলো ভারতের সীমানায় পড়েছে। ওখান থেকে মেঘালয় রাজ্য শুরু। মুগ্ধ চোখে দেখে দেখে ঘাটে নামতেই বৈঠা হাতে এক প্রৌঢ়া নৌকা ভ্রমণের জন্য ডাকতে শুরু করলো। কাছে গেলাম, পরিচিত লাগছে। কথা বলে জানলাম, তিনিই সেই সংগ্রামী নারী, যাকে খবরে দেখেছিলাম। তিনি ৩৫ বছর ধরে নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
ডানে এক কিশোর তার নৌকায় কম টাকায় চড়ার জন্য ডাকছে। কথা বলে চড়লাম তার নৌকায়। আরও আট-নয়জন উঠলো। ছেলেটি নৌকা চালাচ্ছে, তীক্ষ্ণ ওর দৃষ্টি। ছবি তুলছি। মাঝে মাঝে ও ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বৈঠাটি অন্য হাতে নিয়ে একগাল হেসে উঠে হাত নাড়ছে। চারপাশটা অবাক চোখে দেখছি। নদীর পূর্বদিকে ভারত, উত্তরদিকেও। তাই আমরা নদীপথে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছি। আরেকটু দক্ষিণে কীভাবে এই নদীতেই রয়েছে নীল পানি, তা দেখবো। কি স্বচ্ছ সবুজাভ টলটলে নদীর জল, রিমরিম বাতাস আর পূর্বে সুউচ্চ পাহাড়!
দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম নীল পানির উপর। এখানে নদীর বুকে ও নদীর পশ্চিম পাশে অনেক পাথর রয়েছে, তার সঙ্গে আচ্ছাদিত রয়েছে গুল্ম-লতাপাতা ও বিভিন্ন বৃক্ষের শেকড়বাকড়। এখানে সাপ-বিচ্ছুর ভয়ও আছে। আমরা পাথরে নেমে কিছু ছবি তুলে পুনরায় নৌকায় চড়ে ঘাটে চলে এলাম। জনপ্রতি দিতে হলো ৫০ টাকা করে।
এবার মূল রাস্তায় উঠলাম। সড়কের পশ্চিমপাশে ‘কমলাপাহাড়’ নামে একটি পাহাড় আছে। আমরা এই পাহাড়ে গিয়ে উঠলাম। উঠে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। নাম কমলাপাহাড় হলেও একটিও কমলা নেই, তবে গাছ আছে ঠিকই। পাহাড়ের উত্তরে ভারতীয় এলাকা দেখা যাচ্ছে। তবে ঘরবাড়ি নয়, শুধু সবুজ পর্বত।
এবার নিচে নামবো। আমি তাড়াতাড়ি নামার জন্য ধীর গতিতে দৌড় দিলাম। কিন্তু পাহাড় বলে কথা, দৌড়টি এত দ্রুতগতিতে হয়ে গেলো যে নিচে এসে একটি ছোট গাছকে আঁকড়ে ধরে কোনোমতে থামলাম। উঠলাম মূল রাস্তায়। পিছিয়ে এলাম আরো দু’এক কিলোমিটার। ডানে পড়লো হাজং মাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ, সীমান্তে যাওয়ার সময় এটি বামে পড়েছিল। রাশিমণি ছিলেন টঙ্ক আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী। তাকে বলা হয় টঙ্ক আন্দোলনের প্রথম শহীদ। টঙ্ক আন্দোলনের অবদানের জন্য তাকে মণি সিংহের পরই স্থান দেওয়া হয়।
বলে রাখি, আসার সময় পেছনে ফেলে রেখে এসেছি কমলারাণীর দিঘী। এটি ‘সাগরদিঘী’ নামেও পরিচিত। একসময় এর যশ ছিল। জানা যায়, পনের শতকের শেষদিকে সুসং দুর্গাপুরের রাজা জানকি নাথ কমলারাণী নামে এক সুন্দরীকে বিয়ে করেছিলেন। প্রজাদের পানির অভাব হলে এই দীর্ঘ পুকুর খনন করা হয়েছিল। এটিই কমলারাণীর দিঘী নামে পরিচিত। পানিহীন এই দিঘীটি এখন মাঠের মতো। আর পাড়গুলো উঁচু আলের মতো।
এবার স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন পশ্চিমের রাস্তা ধরে চীনামাটির পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। কিছুক্ষণেই চলে এলাম আমাদের গন্তব্যে। এটি ‘সাদামাটির পাহাড়’ নামেও পরিচিত। দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেখা যেন সবে শুরু। প্রকৃতির প্রগাঢ় সৌন্দর্যের কাছে দুপুরের ক্ষুধা হেরে গেল। উঠলাম সর্বদক্ষিণের ছোট্ট পাহাড়টিতে। সৃষ্টিকর্তা যেন এখানে অমায়িক সৌন্দর্যের লীলাক্ষেত্র তৈরি করেছেন।
পাহাড়টিতে আছি। সামনে একটি ছোট্ট জলাশয়। অসাধারণ সবুজ পানি। তার সামনে আরেকটি উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের দক্ষিণ পাশটা কিংবা জলাশয়ের উত্তর পাড়টা যেন কোনো শিল্পীর হাতে নিপুণ নকশা, নিখুঁত গোলাপির সঙ্গে লালচে রং করা। বিস্ময় নিয়ে দেখছি, চোখ শীতল হয়ে যাচ্ছে। উত্তরদিকে ফিরে পাহাড়ের রঙিন কঠিন মাটিতে বসলাম। দেখলাম স্বচ্ছ সবুজ জলে উপর থেকে আঁকা পর্বতরেখার নিচে কোথাও কোথাও ঝোপের মতো গুল্মলতা দুলছে।
এবার আমরা একটি উঁচু পাহাড়ে উঠবো। ৫২ ফুট উঁচু। উঠে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। উপরে একজন মধ্যবয়স্ক লোককে শসা বিক্রি করতে দেখলাম। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে আর ক্লান্ত শরীরকে শীতল করার জন্য অনেকেই শসা খাচ্ছে। আমি শুধু উপরে দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখছি। ছোট ছোট ঘরবাড়ি আর সবুজের সমারোহ, দেখছি মেঘালয় রাজ্যের কিছু অংশ।
বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। পাহাড় থেকে নেমে ফেরার পথ ধরলাম। মোটরসাইকেল চলছে। মেঘালয়ের কোল ঘেঁষে থাকা নয়নাভিরাম চীনামাটির পাহাড়ের মায়া ছেড়ে কুয়াশা আর অন্ধকার চিরে বাড়ি ফিরছি।