আমরা ‘আদিবাসী’ (ইনডিজেনাস) শব্দটিকে ‘আদি বাসিন্দা’ (আরলিয়েস্ট মাইগ্রেন্টস) হিসেবে পাঠ করতে ও কাউন্টার দিতে শিখেছি। প্রপাগান্ডা মেশিন বোধহয় এভাবেই কাজ করে। ‘আদিবাসী’ মোটেও আদি বাসিন্দা অর্থে ব্যবহৃত হয় না।
Published : 26 Jan 2025, 03:21 PM
স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের প্রতীক নূর হোসেন যেদিন শহীদ হলেন, সেদিন তার বুকে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, আর পিঠে ছিল ‘গনতন্ত্র মুক্তি পাক’। অনেকেই খেয়াল করে থাকবেন, গণতন্ত্র বানানটা ভুলভাবে লেখা হয়েছে তার পিঠে। এমন ভুল বিদ্বৎসমাজের দাবিদার অনেকেই হরহামেশা করেন এবং ফেইসবুকে তাদের ভুল বানানের লেখাপত্র পড়লে লজ্জা পেতে হয়!
নূর হোসেনকে ওই ছাঁচে ফেলা যাবে না। এমন ভুল দুটি কারণে হতে পারে। এক, যিনি লিখেছিলেন, তার বানানবোধ ছিল না; অথবা দুই, বানানবোধ থাকলেও ওই সময়ের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ উত্তেজনা ও আবেগের তাড়নায় বানানটা অনাবধানতাবশত ভুল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু, যখনই নূর হোসেনের প্রসঙ্গ এসেছে, তখন তার আবেগমিশ্রিত দ্রোহের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ওই ভুল বানানটিই লেখা হয়েছে, তবে সেটা অবশ্যই উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে— ‘গনতন্ত্র’।
ভুলকে আমাদের অবশ্যই ভুল বলতে হবে। কিন্তু, মহত্তম কালের দ্রোহের সাক্ষী হিসেবে ওই ভুলকে যথাবস্থায় রেখেই আমাদের স্মরণও করতে হবে। ওই ভুল লেখা সমেতই নূর হোসেন জ্যান্তরূপ ‘পোস্টারবয়’ হয়েছেন। আমরা শতসহস্র চেষ্টা করলেও পোস্টার হয়ে ওঠা ওই ছবিতে থাকা ভুল বানান শোধরাতে পারব না। সেটি তার শক্তিতেই জেগে থাকবে।
২.
সাতাশির আন্দোলন থেকে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান হয়ে চব্বিশের গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে আসি। এই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম শক্তির জায়গা হলো সারা দেশের দেয়ালে দেয়ালে ছেয়ে যাওয়া গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্র। ৫ অগাস্টের পরে ঢাকাকে বলা হয়েছে ‘দ্য সিটি অব গ্রাফিতি’।
দেয়ালচিত্র কিংবা গ্রাফিতি কিংবা চিকা মারার ক্ষেত্রে প্রথাগতভাবে অত্যন্ত অগ্রসর থাকেন সাধারণত ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বুর্জোয়া ছাত্র সংগঠনগুলো এখন আর এসব নিজেরা করে না, পেশাদার অঙ্কনশিল্পী দিয়ে করায়। কিন্তু, বামপন্থিরা এখনও ওই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, নিজেরাই দেয়ালে দেয়ালে রং-তুলি দিয়ে স্লোগান, দাবি বা মেনিফেস্টো লিখে।
চব্বিশের আন্দোলন বাংলাদেশে এদিক থেকে এক বৈপরীত্য উপহার দিয়েছে। দেয়ালগুলো শুধু পেশাদার অংকনশিল্পী, চারুশিল্পী কিংবা ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে চিত্রিত হয়নি। শতশত আনকোড়া শিক্ষার্থী রং-তুলি নিয়ে দেয়ালে আঁকিবুকি করেছেন, এমন অনেকেই আছেন যারা জীবনে প্রথমবারের মতো রং-তুলি ধরেছেন এই আন্দোলনের সময়েই। অথচ পেশাদার হোক বা আনকোড়া হাত, শহরের সমস্ত গ্রাফিতি হৃদয় স্পর্শ করে গেছে সচেতন মানুষের।
এরকম অসংখ্য গ্রাফিতির মধ্যে একটি বেশ আলোচিত হয়েছিল আন্দোলনের কালেই এবং আন্দোলনের পরে তো বটেই। আর এখন তো তর্কে-বিতর্কে সেটি এক ‘ভাইরাল’ গ্রাফিতি— ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। একটি গাছ, পাঁচটি পাতা— হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসী— আর শেকড়ের দিকে লেখা ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’।
৩.
অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের আকাঙ্ক্ষার যে স্পিরিট থেকে এই গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে, সেটার সততা নিয়ে আমার তখনও কোনো প্রশ্ন ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু, এই গ্রাফিতি যখন প্রথমবার ফেইসবুকে আসে, সম্ভবত চব্বিশের অগাস্টের দিকে, তখন থেকেই এর চিন্তাকৌশল নিয়ে আমার মনে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। এই তর্ক-বিতর্কের কালে ওই প্রশ্নগুলোই সামনে তুলে আনছি।
প্রথমত, সারা দুনিয়ার তথা বাংলাদেশের চারটি প্রধান ধর্মকে গাছের পাতায় স্থান দেয়া হয়েছে। তাহলে এর মধ্যে আরেকটি পাতায় নৃতাত্ত্বিক পরিচয় (আদিবাসী) জুড়ে দেয়া হলো কেন?
দ্বিতীয়ত, এই গ্রাফিতিতে কোন পরিচয়টি দিয়ে কাকে সিগনিফাই করা হচ্ছে? চারটি ধর্মের জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি বাংলাদেশে আদিবাসীরাও আছেন নাকি আদিবাসীদের মধ্যেও এই চারটি ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী আছে?
তৃতীয়ত, যদি চারটি ধর্মের সঙ্গে আদিবাসীদেরও প্রাধান্য দেয়ার বক্তব্য এই গ্রাফিতি ধারণ করে, তাহলে প্রশ্ন হলো, এই চার ধর্মের বাইরে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী আদিবাসী গোষ্ঠী কি নেই? আমার জানা মতে, গারোদের আদি ধর্ম সাংসারেক, সাঁওতালদের প্রাচীন ধর্ম সারি ধরম, ম্রোদের নতুন ধর্ম ক্রামা, বাঙালিদের মধ্যে খুবই নগণ্য সংখ্যায় হলেও বাহাইরা আছে।এর বাইরেও কিছু প্রকৃতিপূজারী মানুষ আছেন। থাকলে, তারা এই গ্রাফিতিতে কোথায়?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যা-ই হোক না কেন, ধর্মগোষ্ঠী ও নৃগোষ্ঠীর দুটি ভিন্ন বর্গকে এক বৃক্ষের পাতা ও ছাতার মধ্যে আনতে চাওয়া একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি। এটা এই গ্রাফিতির ‘মার্জিনাল এরর’ হলেও, এটাই আবার এর ‘মেজর এরর’ও বটে। কাঁচা চিন্তার কারণে এই ভুলটা হয়ে থাকতে পারে।
আবার, শুরুতেই শহীদ নূর হোসেন প্রসঙ্গে যা বলেছি, শুধু অজ্ঞতা বা কাঁচা চিন্তা থেকে ভুল হয়, এমনটা নাও হতে পারে। মুহূর্তের উত্তুঙ্গ উত্তেজনা ও চরম রুদ্ধশ্বাস এক পরিস্থিতিতে দ্রোহী আবেগের আতিশয্য থেকেও ভুলটা হতে পারে। আমরা যদি ধরেও নেই যে, চারটি ধর্ম ও আদিবাসী নৃগোষ্ঠীকে সমানুপাতে মূল্যায়ন করার স্পিরিট থেকেই এই গ্রাফিতির সৃষ্টি, তাহলেও বলতে হবে, বিচিত্র নৃগোষ্ঠীর আবাসস্থল এ অঞ্চলে বাকিগুলো না থাকলে চিন্তাটা ইনক্লুসিভ হয়ে উঠবে না। তাই ভুলকে আমাদের ভুল বলতে পারতে হবে।
আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে একটি পোস্টার বেশ আলোড়ন সৃষ্টিকারী— ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলমান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান/ আমরা সবাই বাঙালি’। কিন্তু, বহু আগেই এই বক্তব্যের অসারতা নিয়ে আমরা কথা বলতে শিখেছি— বাংলা বা বাংলাদেশের আমরা সবাই বাঙালি না; আমরা কেউ বাঙালি, কেউবা আদিবাসী; কেউবা আদিবাসীও না, বাঙালিও না (যেমন বিহারিরা)। তাই ঐক্যের প্রশ্নে রাজপথে স্লোগান ওঠে ‘তুমি কে আমি কে/ বাঙালি, বাঙালি’-এর পরিবর্তে ‘তুমি কে আমি কে/ আদিবাসী বাঙালি’।
গ্রাফিতির এই চিন্তাকৌশলটি ওই কারণেই কাঁচা ও ত্রুটিপূর্ণ। হয়তো মার্জিনাল এরর, কিন্তু ভুল তো ভুলই। সেটা আমাদের বলতে পারতে হবে।
৪.
এ কাঁচা চিন্তাকেই ধার করতে মন চাইল অন্তবর্তী সরকারের। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলা ব্যাকারণ ও নির্মিতি’ বইয়ের শেষ প্রচ্ছদে এই গ্রাফিতিটিকে স্থান দিল। অভ্যুত্থানের পর, পাঠ্যপুস্তকে অভ্যুত্থানের স্মৃতি তুলে আনতে চাওয়া সততার লক্ষণই বটে! যদিও মেসেজটা রাজনৈতিক এবং শিশু-কিশোরদের পাঠ্যপুস্তকের প্রচ্ছদে রাজনৈতিকভাবে বিতর্কযোগ্য বিষয় কখনই থাকা উচিত নয়। এগুলো বিগত আওয়ামী সরকারের তৈরি করা সংস্কৃতি। কিন্তু, উদ্যোগ যাই হোক, সরকারের ‘শিশুতোষ’ মন তাদেরকে তাদের নিয়তে ঠিক থাকতে দেয় না। বিশেষত, শিক্ষাক্ষেত্রে। তারা একটা উদ্যোগ নেয়। বিরুদ্ধে গিয়ে কয়েকজন রক্ষণশীল মিলে আস্ফালন করে। ওই ভয়ে পরক্ষণেই উদ্যোগটা বাতিল হয়ে যায়!
কাঁচা চিন্তার 'ভুল' এই গ্রাফিতটা হয়তো না নিলেই ভালো হতো। এনসিটিবিতে এবং পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনের জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটিতে কি একজনও নেই, যিনি এই গ্রাফিতির দুর্বলতাটা ধরতে পারতেন? কিন্তু সেটা এখন ভিন্ন তর্ক। নেয়া যখন হয়েছে, তখন ধরে নিতে হবে এনসিটিবি বোধসম্পন্ন আগ্রহের জায়গা থেকেই সেটা করেছে। কিন্তু, নেয়ার পর সংবিধানের দোহাই দিয়ে ওই গ্রাফিতি বাদ দেয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে কি? সংবিধান যে আসলেই একটা দোহাই সেটা হঠাৎ জন্মানো ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ নামে একটি সংগঠনের 'চাপে পড়ে' করা তা পরে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা সংগঠনটির হামলায় স্পষ্ট হয়েছে।
একদল দাবি করছেন, বাংলাদেশে 'বাঙালিরাই আদিবাসী'। সরকার গ্রাফিতিটি বাতিলের পক্ষে ব্যাখ্যা দিল— ‘আদিবাসী’ শব্দটি সংবিধানসম্মত নয়, 'আদিবাসী' বলে কিছু নেই। চমৎকার! তারা আসলে কোন সংবিধানের কথা বলছেন? এটা তো সেই সংবিধান যার বিরুদ্ধে নানা সময়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে এবং যার ২০১১ সালে করা পঞ্চদশ সংশোধনীর অনেকগুলো বিধান নিয়ে জনমনে মারাত্মক ক্ষোভ আছে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে মোট ৫৪টি পরিবর্তন আনা হয়েছিল সংবিধানে। আদালত বাতিল করেছে মাত্র ৬টি বিধান।
উচ্চ আদালত পঞ্চদশ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার পক্ষে রায় দেয়ায় যদি এই সংবিধান সঠিক লাইনে চলে আসে, তাহলে বুঝতে হবে, এই রাষ্ট্রে শুধু একটা 'অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ' নির্বাচনের জন্যই অভ্যুত্থান হয়েছে। বাকি সংস্কার ও কালচারাল ইনক্লুসিভিটির আলাপচারিতা মোটামুটি আইওয়াশ! অথচ, এই পঞ্চদশ সংশোধনীটির অংশ হিসেবেই ধারা ২৩(ক)-তে ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ প্রপঞ্চগুলো লিখে সংবিধান সংশোধনের বিল পাস করেছিল বিগত সরকার। আদালতের বাতিলকৃত ৬টি বিধানের মধ্যে এটি নেই সত্য, কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীটির যে অনেকগুলো সাংঘর্ষিক সমস্যা রয়েছে, তা কি সরকার জানে না?
পঞ্চদশ সংশোধনীর ধারা ৭ক ও ৭খ বাতিল হওয়ায় রক্ষা হয়েছে। নইলে ওই দুই ধারা অনুযায়ী খোদ এ সরকার অবৈধ ও রাষ্ট্রদ্রোহী। ফরহাদ মজহার বহুবার বলেছেন কথাটা৷ আবার, ওই সংবিধানেরই রেফারেন্স দিয়ে আদিবাসীদের অধিকার রাষ্ট্রীয়ভাবে হনন করতে চান আপনারা, এটা তো নৈতিকভাবেই লজ্জাজনক ও পরাভূত হবার মতো বিষয়। একবার ভেবেছেন আপনাদের সকল কাজকর্ম স্থিত সংবিধানের অনুকূলে বৈধ কি না? বাংলাদেশের সবাই আমরা ‘একটা পরিবার’— প্রধান উপদেষ্টার এই বাণী এখন কি নিভৃতে কাঁদছে না?
এই সরকারের সংবিধান সংস্কার কমিশন মূলনীতির যে তিনটি বাদ দেয়ার প্রস্তাব করেছে, তার একটি হলো ‘জাতীয়তাবাদ’, যে জাতীয়তাবাদের আধার হলো ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এবং বাহাত্তরে সেভাবেই লেখা হয়েছিল। এই সংবিধানেরই ধারা ৬(২)-এ অত্যন্ত আপত্তিজনকভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি’, যা সংস্কার কমিশন বাতিলের প্রস্তাব করেছে। কমিশন যখন এসব বলছে, তখন কেন সরকার বিপ্রতীপ অবস্থান নিল? বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আধিপত্যের প্রতি আপনাদের এত দরদ কেন?
আপনারা না বলেছিলেন ‘মুজিববাদী’ ও ফ্যাসিবাদী সংবিধান ‘ছুঁড়ে ফেলে’ দেবেন! শেখ মুজিবকে তাহলে কোনো অর্থেই, বহু চেষ্টাতেও টপকে যাওয়া যাচ্ছে না এই বাংলাদেশে! কী কাকতালীয় বলুন, ১৯৭২ সালেই আদিবাসীদের নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে মহান এ জাতীয়তাবাদী নেতা ‘বাঙালি’ হয়ে যেতে বলেছিলেন! আমাদের বাঙালিত্বের কী অহম! আমাদের সংখ্যাগুরু মনের কী আধিপত্যবাদী চেহারা!
আদতে কালচারাল ইনক্লুসিভিটি হবার ক্ষেত্রই প্রস্তুত না এই দেশে। নইলে, 'আদিবাসী' শব্দ সংবিধানে নেই— এমন মশকরা মার্কা কথা একটা বৈষম্যবিরোধী অভ্যুত্থানোত্তর সরকার কীভাবে বলতে পারে! সরকারে যারাই থাকুক, একটা রাষ্ট্র তথা সামগ্রিক সমাজব্যবস্থা ও তার সংখ্যাগুরুর অহমিকা কতটা দানবীয় হলে, সে দেশে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আদিবাসী সত্তাকে লোপাট করে দিতে চায়, ভাবুন!
৫.
আমাদের বিদ্বান মনের দৌড় আজকাল ফেইসবুক পর্যন্ত। তাই আমরা ‘আদিবাসী’ (ইনডিজেনাস) শব্দটিকে ‘আদি বাসিন্দা’ (আরলিয়েস্ট মাইগ্রেন্টস) হিসেবে পাঠ করতে ও কাউন্টার দিতে শিখেছি। প্রপাগান্ডা মেশিন বোধহয় এভাবেই কাজ করে। ‘আদিবাসী’ মোটেও আদি বাসিন্দা অর্থে ব্যবহৃত হয় না। মোটাদাগে স্বতন্ত্র সংস্কৃতির ধারক-বাহক আবার সাংস্কৃতিকভাবে ‘সংখ্যালুঘ’ হিসেবেই তারা আদিবাসী, যেগুলোর ব্যাপারে শতসহস্র রেফারেন্স ঘাঁটাঘাটি করলেই যে কেউ পাবেন, কিন্তু গায়ের জোরে কথা বলতে চাওয়া যাদের অভ্যাস, তারা যুক্তিবাদী হওয়ার জন্য পড়তে যাবেন কেন!
এই ভূমি যদি বাঙাল বা বাঙালির হয়, তাহলে স্বীকার করতে হবে, যে বাঙালির কথা বলা হচ্ছে, তার সিংহভাগের উত্তরসূরিই আজ আর এদেশে নেই। কিন্তু, তর্কটা ‘আদি বাসিন্দা’ নিয়ে নয়, ‘আদিবাসী’ নিয়ে বলে এসব যুক্তি শেষ পর্যন্ত কুযুক্তিই। আদিবাসীদের চিহ্নায়ণের ব্যাপারে জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রটি বরং অধিক প্রযোজ্য।
২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ইউনাইটেড নেশন্স ডিক্ল্যারেশন অন দ্য রাইটস অব ইনডিজেনাস পিপলস’ শিরোনামের ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। ওই ঘোষণাপত্র অনুযায়ী আদিবাসীদের নানা রকম অধিকার প্রদানের কথা বলা হয়েছে রাষ্ট্রকে। ১৪৪টি দেশ পক্ষে ভোট দিয়েছিল, ৪টি বিপক্ষে আর যে ১১টি দেশ ভোট প্রদান থেকে বিরত ছিল, তাদের একটি হলো বাংলাদেশ। তখন ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল সেটি। তারা পর্যন্ত আদিবাসীদের পক্ষে দাঁড়ায়নি, ভাবা যায়!
পরিতাপের বিষয়, যেদিন সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে ‘বহুত্ববাদ’ সংযুক্ত করে সংস্কার-প্রস্তাব পেশ করেছে, সেদিন ও তার পরের দিন, ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি, আদিবাসীদের ওপর হামলা হয়েছে। হামলা করেছে উগ্র বাঙালি জাতিবাদী আধিপত্যবাদী সন্ত্রাসীরা ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী পুলিশ। ঠিক এ জায়গায় এসে, আপনার বহুত্ববাদ, বৈষম্যহীনতাসহ সামগ্রিক অর্থে সমস্ত নীতির ‘ক্লাউড’ গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?
স্বীকার করে নেয়া ভালো, আদিবাসী প্রশ্নটিকে আমরা মোকাবিলা করতে পারিনি আমাদের সংবিধানে এবং সংকীর্ণ মূলনীতি ‘জাতীয়তাবাদ’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ দিয়ে সেটি মোকাবিলা সম্ভবও নয়। সংবিধানের জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা যে অর্থে সমস্যাজনক, ঠিক ওই অর্থেই সমস্যাজনক গ্রাফিতির সেই গাছটি। ওই সমস্যা গ্রাফিতিটির চিত্রশিল্পীও বোঝেননি। আর এনসিটিবি বুঝলে তো কথাই ছিল না। কিন্তু, সমস্যাটা কখনই এনসিটিবি কী করল কী করল না, সেখানে সীমাবদ্ধ ছিল না, থাকবেও না। সমস্যাটা দীর্ঘকালের লড়াইয়ের এবং আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া না দেয়ার। বহুত্ববাদ থাকলে, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকবে না কেন?
আরও পড়ুন
‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ কারা, আদিবাসী বিরোধিতায় সোচ্চার কেন?
পাঠ্যবইয়ে গ্রাফিতি বদল, প্রতিবাদে এনসিটিবি ঘেরাও কর্মসূচি আদিবাসী
বইয়ে 'আদিবাসী চিত্রকর্ম': পক্ষের লোকজনকে পেটাল বিরোধীরা
বইয়ে 'আদিবাসী চিত্রকর্ম': হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার ২
'আদিবাসী চিত্রকর্ম': হামলার প্রতিবাদে মিছিল 'ছত্রভঙ্গ' করল পুলিশ
'আদিবাসীদের' সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি ১৮৩ নাগরিকের
পাঠ্যবইয়ে 'আদিবাসী' চিত্রকর্ম ফেরানোসহ ৬ দাবি বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের
'স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি' ঢাবির সংগঠন নয়: প্রক্টরের দপ্তর
'সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা'র ওপর হামলা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়