‘সভরেন্টি’ প্রসঙ্গে ছাত্রনেতাদের অভিযোগের আঙুল ‘মৌলবাদী’ গোষ্ঠীর দিকেও, যারা বিভিন্ন ব্যানারে ‘নামে-বেনামে’ বিভিন্ন সময় আবির্ভূত হয়েছে।
Published : 23 Jan 2025, 01:32 AM
প্রতিষ্ঠার মাত্র সাড়ে চার মাসের মাথায় সংবাদের শিরোনাম হয়েছে ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’। ‘আদিবাসী’ বিরোধী অবস্থানের কারণেও আলোচনায় এসেছে সংগঠনটির নাম।
পাঠ্যবইয়ে ‘আদিবাসী’ লেখা চিত্রকর্ম বাদ দেওয়া নিয়ে সম্প্রতি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদ কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত করার অভিযোগ মাথায় নিয়ে নিজেদের শক্তি জানান দেয় সংগঠনটি।
সংগঠনটির আন্দোলনের মুখেই নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ বইয়ের শেষ প্রচ্ছদে থাকা ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত চিত্রকর্ম সরিয়ে নেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এ খবরে হঠাৎ নজর কাড়ে সংগঠনটি।
গ্রাফিতি সরানোর প্রতিবাদে ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্রজনতা’ গত ১৫ জানুয়ারি মতিঝিলে এনসিটিবির কার্যালয় পাঠ্যপুস্তক ভবন ঘেরাও করতে যায়। সেখানে ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টির’ ‘পাল্টা কর্মসূচি’ থেকে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনাও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
এরপর থেকে হঠাৎ গড়ে ওঠা ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ নিয়ে জনমনে ব্যাপক কৌতূহল তৈরি হয়। সংগঠনটির কার্যক্রমই বা কী তা জানার আগ্রহ জন্মেছে।
সংগঠনটি নিজেদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বলে দাবি করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে তা ‘নাকচ’ করে দেওয়া হয়েছে।
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদ’ ও ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ’ নামের পার্বত্য বাঙালি ছাত্রদের দুটি সংগঠন সভরেন্টির কর্মসূচি প্রচারে ভূমিকা রাখায় এটিকে এ দুই সংগঠনের একই কাতারে রেখে এগুলোর ‘অ্যালাইন’ হিসেবে অভিহিত করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একাধিক ছাত্রসংগঠনের নেতারা।
পাহাড়ের ছাত্র সংগঠন দুটির বেশিরভাগ বিভিন্ন সময়ে সরকারি ‘সেটেলমেন্ট’র মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় বসত গড়া বাঙালিদের উত্তরপ্রজন্মের সদস্য।
‘সভরেন্টি’ প্রসঙ্গে ছাত্রনেতাদের অভিযোগের আঙুল ‘মৌলবাদী’ গোষ্ঠীর দিকেও, যারা বিভিন্ন ব্যানারে ‘নামে-বেনামে’ বিভিন্ন সময় আবির্ভূত হয়েছে।
‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’র আহ্বায়ক মো. জিয়াউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে দাবি করেছেন, দেশের ‘সার্বভৌমত্ব’ রক্ষাই তাদের ‘একমাত্র’ উদ্দেশ্য। প্রতিবাদের বিষয় ‘এক’ হওয়ায় অন্যান্য সংগঠনের সদস্যরা ‘সংহতি’ জানালেও অন্য কোনো সংগঠনের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নেই।
এদিকে নামে ছাত্রদের সংগঠন হলেও সভরেন্টির মূল নেতা জিয়াউল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন গত ১৫ জানুয়ারির কর্মসূচিতে তাদের ‘সমর্থন’ দিতে আসা সমমনা অনেকেই ছিলেন ‘অছাত্র’।
‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্রজনতা’র ওপর হামলার ঘটনা আত্মরক্ষার্থে ঘটেছে বলে দাবি করেছেন জিয়াউল। যদিও হামলার পর সভরেন্টির যে কয়েকজনকে মাথায় ব্যান্ডেজ করা দেখা গেছে, এমন দুজনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানিয়েছে, তাদের মাথায় কোনো আঘাত ছিল না।
বুধবারের হামলায় আহত জগদীশ চাকমার করা একটি মামলার পর গ্রেপ্তার আরিফ আল খবির (৩৮) ও আব্বাসকে (২৪) শুক্রবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
মতিঝিল থানার ওসি মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ১৬ জনের নাম দিয়ে এবং অজ্ঞাত আরও ২০০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে জড়িত অন্যদেরকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
গ্রেপ্তার দুইজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হামলার কারণ সম্পর্কে কিছু বলেছেন কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা তাদেরকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করব। তখন বিস্তারিত জানা যাবে।”
মামলার এজাহারে ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’র নামে জড়ো হওয়া ‘মৌলবাদী গোষ্ঠী ও জঙ্গী সংগঠনের’ নেতাকর্মীদের ‘সন্ত্রাসী কায়দায়’ চালানো হামলার অভিযোগ করেছেন বাদী জগদীশ। হামলায় তিনিসহ ১৫ জন গুরুতর আহত হওয়ার দাবি করা হয়েছে।
হামলায় আহত রূপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যাও ‘উগ্র ও মৌলবাদী’ গোষ্ঠীকেই দায়ী করেছেন।
হামলা জড়িত আরমানউল্লা ও সাজ্জাদ জামান সেতু নামের দুজনকে শনাক্ত করতে পারার কথা তুলে ধরে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রূপাইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কর্মসূচির আগের দিনই তারা থ্রেট দিয়েছিল। পাহাড়েও তারা একই কাজ করে। আমাদের একজনের হাতেও লাঠি ছিল না। আমরা কাউকে মারি নাই।”
টার্গেট করে এই হামলা চালানো হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “ওরা আমাকে মেরেই ফেলত। ইনটেনশনালি হামলা করা হইছে। ওরা চায় আমরা ভয় পেয়ে যাই। মেরে ফেলার জন্যই মারতেছিল। ওরা মাথায় মারতেছিল।”
‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’র যত কর্মসূচি
‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ নামের সংগঠনটি সামনে আসে গত বছরের ২৮ অগাস্ট; অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহারের প্রতিবাদ করে তারা। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ করেছিল সংগঠনটি। সেদিন আদিবাসী সম্প্রদায়কে ‘উপজাতি’ ও ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলার দাবি তোলা হয়।
এর কিছুদিন পর ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকটি সমাবেশ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা ক্যাম্পের সংখ্যা বাড়ানো এবং পার্বত্য শান্তিচুক্তির ‘অসাংবিধানিক ধারা’ অপসারণসহ বেশ কিছু দাবি জানায় তারা।
চার দিন পর অন্য একটি বিক্ষোভে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আদিবাসী শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ ‘উপজাতি কোটা’ অপসারণের দাবি জানায় সংগঠনটি।
গত ২ জানুয়ারি ‘লিভ টুগেদারের’ পক্ষে কথা বলায় অভিনেত্রী জিনাত সানু স্বাগতাকে লিগ্যাল নোটিস পাঠানো হয় সংগঠনটির আহ্বায়ক মুহম্মদ জিয়াউল হকের তরফে।
এর আগে ‘লিভ টুগেদার’ নিয়ে মন্তব্য করায় স্বাগতাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়ে লিগ্যাল নোটিস পাঠান আরিফ আল খবির নামে একজন, যিনি আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি এবং তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ।
‘সেন্ট মার্টিন’ দ্বীপের নাম ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ রাখা এবং সেখানে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয় সভরেন্টির পক্ষে। তাদের ভাষ্য, মিয়ানমার একাধিকবার দ্বীপটিকে নিজেদের বলে দাবি করায় সেখানে নাগরিকদের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত করতে হবে।
এরপর ১২ জানুয়ারি সংগঠনটির নেতৃত্বে পাঠ্যপুস্তক ভবনের সামনে বিক্ষোভ ও ঘেরাও কর্মসূচি পালনের পর নবম ও দশম শ্রেণির একটি বইয়ের মলাট থেকে রাতারাতি ‘আদিবাসী’ শব্দ সংবলিত একটি গ্রাফিতি সরিয়ে নেয় এনসিটিবি।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দীপায়ন খীসা বলেন, “এটি শিক্ষার্থী নামধারী কিছু উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সংগঠন। যাদের কাজ হচ্ছে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানো। এরা খুবই উগ্র এবং সাম্প্রদায়িক। আমরা যেটা দেখেছি এদের কাজ পার্বত্য অঞ্চলে বিদ্বেষ ও জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানো একটা সংগঠন। এ সংগঠনগুলো বিপজ্জনক, এদের কাছ থেকে সবাইকে সতর্ক থাকা দরকার।”
‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’র পেছনে কারা?
সভরেন্টির আহ্বায়ক জিয়াউল হকের দাবি, তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। নিজে কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন দাবি করে তিনি বলেন, “আমি এবং আমার পরিবারের কেউ কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই। না ছাত্রলীগ, না ছাত্রদল, না শিবির- কারও সঙ্গেই আমি নেই।”
সংগঠনটির মূল কমিটিতে মাত্র ৬-৭ জন রয়েছেন, যারা কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন বলেও দাবি তার।
তিনি বলেন, “আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও কেন্দ্রীয়ভাবে একটি কমিটি দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছি, যেখানে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও থাকবেন। এর মধ্যেই আমাদের কমিটি ঘোষণা করার কথা ছিল, এই ঝামেলার (চিত্রকর্ম নিয়ে) কারণে এটি পিছিয়ে গেল।”
বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সংগঠন নয় এবং এর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।”
বিষয়টি স্বীকার জিয়াউল বলেন, “আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার্ড সংগঠন নই। তবে আমরা ভবিষ্যতে আবেদন করব।”
পাহাড়ি বাঙালিদের দুই ছাত্র সংগঠনও আলোচনায়
বুধবারের হামলার ঘটনার পর ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদ’ ও ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ’ নামে দুটি সংগঠনও আলোচনায় এসেছে। সংগঠন দুটির ফেইসবুক পাতা থেকে সভরেন্টির বুধবারের কর্মসূচির সমর্থন জানিয়ে পোস্ট দেওয়া হয়। তবে সেদিনের হামলার পর পোস্টগুলো সরিয়ে ফেলা হয়।
‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’র আহ্বায়ক জিয়াউল বলেন, “এই ইস্যুতে যারা এক, তাদের অনেকেই আমাদের সঙ্গে সংহতি জানাতে আসেন। কিন্তু সেসব সংগঠনের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা নেই।”
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্যে আসা ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদ্য সাবেক সভাপতি সাদিক কায়েম ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদের’ সভাপতি ছিলেন। গত রোববার শিবিরের নবগঠিত ৪৬ সদস্যের কার্যকরী পরিষদে কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি।
শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নবনির্বাচিত সভাপতি এস এম ফরহাদও ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদের’ সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন। তাদের প্রথমজন খাগড়াছড়ির এবং দ্বিতীয়জন রাঙামাটির বাসিন্দা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদের সঙ্গে যুক্ত থাকা এবং সভরেন্টির পেছনে শিবিরের অবস্থান রয়েছে কি না জানতে চাইলে সাদিক কায়েম বলেন, “আমি ২০২২ সালে ওইটার সভাপতি ছিলাম, এরপরে আর কোনটার সাথে কানেকশান নাই আমার। আর স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টির যে বা যারা হামলা করছে, এখানে ছবি পাওয়া যাচ্ছে প্রত্যেকের, তাদেরকে অ্যারেস্ট কেন করা হচ্ছে না?
“কেন একজন আরেকজনের ওপর দায় চাপাচ্ছে? এটা তো একটা দায়মুক্তি দেওয়ার প্রসেস। এখানে ছবি আছে, সবকিছু দেখা যাচ্ছে। হামলায় যারা জড়িত ছিল, তাদেরকে রাজারবাগ দরবার শরীফ থেকে অ্যারেস্ট করা হইছে। সভরেন্টির যারা আছে এদেরকে ধরে তদন্ত করতে বলেন, আমাকে কেন করতেছেন? এটার ধারে কাছেও আমি নাই, জানিও না এটা কারা চালায়, কী করে না করে।”
ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বর্তমান সভাপতি এসএম ফারহাদের বক্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে মোবাইল ফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কথা হয়েছে ফরহাদের বাবা ফোরকান আহমদের সঙ্গে।
তিনি বলেন, তার জন্মস্থান চট্টগ্রামের লোহাগাড়া এলাকায়। তার সন্তানদের জন্মও সেখানে। ১৯৯৩ সালে তিনি রাঙামাটির লংগদু এলাকায় গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
এদিকে ১৫ জানুয়ারির হামলায় ছাত্রশিবিরের সংশ্লেষ থাকতেও পারে বলে মনে করছেন ছাত্রনেতারা।
শরীফ নূরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি গৌতম শীল বলেন, “গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের পেটোয়া ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ বিভিন্ন সময়ে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের কর্মসূচিতে যেভাবে হামলা চালিয়েছে, মুখ বন্ধ করে রাখতে চেয়েছে, তারই ধারাবাহিকতা আমরা লক্ষ্য করছি বর্তমান সময়েও।
“সাম্প্রতিকালে একটি গুপ্ত এবং সন্ত্রাসী সংগঠন বিভিন্ন ব্যানারে, নামে-বেনামে, ছদ্মবেশ ধারণ করে এদেশের গণতন্ত্রকামী, মুক্তিকামী অসাম্প্রদায়িক চেতনার সাধারণ ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় হামলা করা হয়েছে সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার ওপর।”
তিনি বলেন, বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে হামলাকারীদের প্রকৃত ইন্ধনদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে এবং জাতির কাছে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। দেশের মুক্তিকামী সব ছাত্র-জনতাকে আদিবাসীদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
ছাত্র ফেডারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আরমানুল হক বলেন, “স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টির নামে মনে হয় এটা স্টুডেন্টদের প্ল্যাটফর্ম, কিন্তু হামলার দিন আমরা দেখেছি সেখানে অনেক বয়সীরাও ছিলেন, তারা তো স্টুডেন্ট না। সে হিসেবে প্রশ্ন জাগে তারা কারা?”
তিনি বলেন, “‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদের’ সাথে ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ যেহেতু অ্যালাইন, আমি অ্যালাইন বলতে বোঝাতে চাচ্ছি তাদের একে অপরের প্রোগ্রাম ঘোষণা করতে দেখেছি। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদের নেতৃত্বে ছিলেন শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বর্তমান ও সাবেক সভাপতি। সে হিসেবে হামলায় তাদের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও থাকতে পারে।”
ফরাজী সাকিবকে নাগরিক কমিটি থেকে বহিষ্কার
জাতীয় নাগরিক কমিটির ধানমন্ডি শাখার সদ্য ‘বহিষ্কৃত’ নেতা শাহাদাৎ ফরাজী সাকিব পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তার বাড়িও রাঙামাটির লংগদু উপজেলায়।
গত মঙ্গলবার তিনি তার ফেইসবুকে স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টির এনসিটিবি ঘেরাও কর্মসূচি নিয়ে পোস্ট দিয়ে সবাইকে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ওইদিনের হামলায় আহত অনেকে জানিয়েছেন, হামলার সময় সাকিব ঘটনাস্থলে ছিলেন।
আদিবাসী অধিকার কর্মী ও বুধবারের ঘটনায় আহত অনন্ত ধামাই বলেন, “ঘটনার দিন সাকিব উপস্থিত ছিলেন। ঘটনার দিন সাকিব ফেইসবুকে পোস্ট করে ‘উপজাতি সন্ত্রাসী এবং বামপন্থীদের আক্রমণে’ তাদের ১৪ জন সাধারণ শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর দেন।”
সাকিবের ফোন বন্ধ থাকায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। বুধবারের হামলার ঘটনায় করা মামলায় ৬ নম্বর আসামি তিনি।
বুধবারের ঘটনায় সাকিবের সম্পৃক্ততা সামনে আসার পর তাকে জাতীয় নাগরিক কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির নির্বাহী কমিটির সদস্য মনিরা শারমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফরাজী সাকিবকে সংগঠনের আচরণবিধি পরিপন্থি কার্যক্রমে লিপ্ত হয়েছে জানা গেলে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়। সেখানে তিনি গ্রহণযোগ্য কারণ দেখাতে পারেননি বলে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সেদিন আক্রমণের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন বলে জানা গেছে।”
শাহাদাৎ ফরাজি সাকিবের বাবা আলম ফরাজী রাঙামাটি জেলা বিএনপির উপদেষ্টা কমিটির ১৪ নম্বর সদস্য। পেশায় কাঠ ব্যবসায়ী আলম ফরাজী ১৯৮১ সালে বরগুনা থেকে রাঙামাটিতে পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এসে বসবাস শুরু করেন।
কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা পূর্বপূরুষ থেকেই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে কোনো হিংসার রাজনীতি আমরা করি না।”
বুধবার মতিঝিলের হামলার ঘটনায় সাকিবের সংশ্লিষ্টতার ছবি থাকলেও তার বাবা ছেলের সম্পৃক্ততার কথা ‘অস্বীকার’ করে বলেন, “ঘটনার দিন সাকিব আগারগাঁওয়ের বাসায় ছিল। সে সেখানে যায়নি, সে কোনো গ্যাঞ্জামে যাইতে পারে না। কিছু লোক শত্রুতা করে তাকে ফাঁসাচ্ছে।”
পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালিদের উত্তরপ্রজন্মের সংগঠন বলে পরিচিত ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’র পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো কমিটি বা কার্যক্রম দেখা যায়নি। সংগঠনটির কোনো কর্মীর তৎপরতার বিষয়েও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
আদিবাসী বিষয়ক গবেষক ও কবি হাফিজ রশিদ খানের পর্যবেক্ষণ, “পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের যেসব সংগঠন রয়েছে, সেগুলোর মূল কাজ হল আদিবাসীরা তাদের নিজস্ব দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামলে এর বিরোধিতা করা। এই সংগঠনগুলোর নিজস্ব কোনো কর্মসূচি নেই, একমাত্র কর্মসূচি হচ্ছে আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা এবং দেশের মানুষের মনে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পার্বত্য আদিবাসীদের নিয়ে একটা নেতিবাচক বিতর্ক বজায় রাখা।
“এসব সংগঠনের সূত্রপাত হয় নব্বইয়ের দশকের আগে আগে। সমঅধিকার নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এখন অন্তত তিনটি ভিন্ন ভিন্ন নামে তারা সক্রিয় রয়েছে।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাহাড়ে সেটেলার বাঙালিদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের অনেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। তারাই ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’সহ বিভিন্ন নাম দিয়ে সংগঠন চালু করে আদিবাসীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালাচ্ছে।”
হামলা: পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
আদিবাসী অধিকারকর্মী অনন্ত ধামাই ঘটনার দিন সর্বপ্রথম হামলার শিকার হয়েছিলেন।
ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, ১২ জানুয়ারি আদিবাসী গ্রাফিতিটি বাতিল করা হলে সেদিন বিকেলেই কয়েকটি সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে ১৫ তারিখের ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
”কিন্তু আমাদের কর্মসূচির আগের দিন ১৪ জানুয়ারি রাত ১১টায় সভরেন্টি ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করে। আমি গত ১৭ বছর ধরে ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছি। বিএনপির সময়ও করেছি, আওয়ামী লীগের সময়ও করেছি। কিন্তু কোনোদিন কেউ এমন মারমুখী আচরণ করেনি। সেখানে যারা ছিল তাদের কাউকে চিনি না। হামলাকারীদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী নন। বিনা কারণে হামলার শিকার হয়েছি আমরা।”
তবে বিনা কারণে হামলা চালানোর বিষয়টি অস্বীকার করে ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’র আহ্বায়ক জিয়াউল বলেন, “হামলা করা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। যদি হামলা চালানোর উদ্দেশ্য হত আমরা টিএসসিতে কর্মসূচি দিতাম। এনসিটিবি ভবনে তারা আসার আগেই আমরা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে কর্মসূচি শেষ করে চলে যেতে চেয়েছিলাম। তারাই আমাদের ওপর প্রথমে হামলা করেছে।”
সেদিন কর্মসূচিতে থাকা সবাই শিক্ষার্থী কি না বা ‘সভরেন্টি’র সদস্য কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “না সেখানে সবাই শিক্ষার্থী না, সদস্যও না। আমাদের কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করতে সমসমনা অনেকেই সেদিন উপস্থিত ছিলেন।”
গ্রেপ্তার দুজনের বিষয়ে জানতে চাইলে জিয়াউল বলেন, “আমি আরিফ আল খবিরকে চিনি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। তবে আব্বাসকে চিনতে পারছি না।”
'আদিবাসীদের' সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি ১৮৩ নাগরিকের
পাঠ্যবইয়ে 'আদিবাসী' চিত্রকর্ম ফেরানোসহ ৬ দাবি বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের
'স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি' ঢাবির সংগঠন নয়: প্রক্টরের দপ্তর
বইয়ে 'আদিবাসী চিত্রকর্ম': হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার ২
'আদিবাসী চিত্রকর্ম': হামলার প্রতিবাদে মিছিল 'ছত্রভঙ্গ' করল পুলিশ