আদিবাসী শব্দটি ‘সংবিধানবিরোধী’- এমন যুক্তিতে রোববার ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেনটি’ নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠন ওই গ্রাফিতি বাতিলের দাবি জানায়।
Published : 13 Jan 2025, 08:22 PM
শিক্ষার্থীদের একাংশের দাবির মুখে নতুন বছরের নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ব্যাকারণ ও নির্মিতি বইয়ের শেষে থাকা ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত একটি গ্রাফিতি বদল করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
এদিকে গ্রাফিতি বদলের প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ। আর এনসিটিবির কার্যালয় ‘পাঠ্যপুস্তক ভবন’ ঘেরাও ও গ্রাফিতি অংকনের কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন আদিবাসী শিক্ষার্থীরা।
সোমবার এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোববার শিক্ষার্থীদের একটি অংশ এনসিটিবি কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করে ওই গ্রাফিতিটি পরিবর্তনের দাবি জানায়। আমরা এনসিটিবির ওয়েবসাইটে বইয়ের পিডিএফ কপি থেকে তা বাদ দিয়ে নতুন একটি গ্রাফিতি যুক্ত করেছি।
“আমাদের বইগুলোতে কোনো বিতর্কিত বিষয় যাতে যুক্ত না হয় তা নিশ্চিত করতে আমরা সচেষ্ট ছিলাম। গ্রাফিতিগুলো দেওয়ালে শিক্ষার্থীরা যেভাবে এঁকেছে সেভাবেই বইয়ের পেছনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখন শিক্ষার্থীরাই সেটি বাতিল করার দাবি জানানোয় সেটি বদলে দেওয়া হয়েছে। যে বইগুলো এখনো ছাপানো হয়নি ওই বইগুলোতেও আমরা গ্রাফিতিটি বদলে দেব।”
রোববার ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেনটি’ নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে ওই গ্রাফিতি বাতিলের দাবি জানিয়ে পাঠ্যপুস্তক ভবন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করা হয়। সংগঠনটি বলছে, আদিবাসী শব্দটি ‘সংবিধানবিরোধী’।
ওই সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুহম্মদ মুহিউদ্দীন রাহাত বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা বিদেশি প্ররোচনায় ২০০৭ সাল থেকে নিজেদেরকে আদিবাসী দাবি করলেও তারা তা নয়। তারা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে আমাদের ভুখণ্ডে বাঙালিদের সঙ্গে সহাবস্থান করছে। আদিবাসী বলতে বোঝায় আদি বাসিন্দা। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের আদি নিবাস হচ্ছে পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার, ভারত, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ইত্যাদি রাষ্ট্রগুলোতে।
“২০০৭ সালে জাতিসংঘের ৬১তম অধিবেশনে আদিবাসী বিষয়ক একটি ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়, বিতর্কিত ওই ঘোষণাপত্রে এমন কিছু বিতর্কিত অনুচ্ছেদ রয়েছে যেগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে আদিবাসী অঞ্চলের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও অখণ্ডতা থাকে না। দেশে কোনো উপজাতীয় আদিবাসী না থাকায় বাংলাদেশ ওই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেনি। ওই ঘোষণাপত্রের একটি অনুচ্ছেদে আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও আরেকটি অনুচ্ছেদে স্বায়ত্তশাসন ও নিজস্ব সরকার গঠনের অধিকার দেওয়া হয়েছে। দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার জন্য হুমকি হওয়ায় আমরা সংবিধানবিরোধী ওই শব্দ বাতিলের দাবি জানিয়েছি।”
এদিকে নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ব্যাকারণ ও নির্মিতি বইয়ের শেষে থাকা ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত একটি গ্রাফিতি বদল করার প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের বৃহত্তর ঢাকা কমিটি।
কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিভূতী ভূষণ মাহাতো বলেন, “এনসিটিবির এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণের জন্য অসম্মানকর, অপমানজনক ও বৈষম্যমূলক আচরণ। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাঁওতাল, মুন্ডা, ওরাঁও, মাহালী, বেদিয়া, কুর্মি, গঞ্জু, তুরি, ঘাসিমালো, বড়াইক, কোল, লোহার, গারো, হাজং, বানাই, পাহাড়িয়া, ভূমিজ, কড়া, নুনিয়া, মুসহরসহ ৫০টির বেশি আদিবাসী জাতিসত্তার প্রায় ৪০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে।
“আদিবাসীরা দীর্ঘ সময় ধরেই আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু বরাবরই আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জনগণ বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছে।”
তিনি বলেন, “বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণে আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এতে আদিবাসীরা আশার আলো দেখেছিল। কিন্ত এনসিটিবি নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে আদিবাসী শব্দযুক্ত গ্রাফিতি সরিয়ে শুধু আদিবাসীদেরই নয় বরং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকেও অসম্মান ও অবমাননা করেছে। আমরা আদিবাসী শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বহাল রাখা এবং পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসীদের যথাযথ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত অধ্যায় যুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি।”
পাঠ্যপুস্তক থেকে জুলাই ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের ‘আদিবাসী’ লেখা গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্রজনতা’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে সোমবার রাত ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাফিতি অংকন ও বুধবার পাঠ্যপুস্তক ভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দিয়েছে।
সংগঠনের আলিক মৃ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোববার কিছু লোক এনসিটিবিতে গিয়ে আদিবাসী শব্দুযুক্ত গ্রাফিতি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে আর এনসিটিবি তা বাতিল করে দিয়েছে। আমরা এর প্রতিবাদ জানাই।
“এর প্রতিবাদে আমরা সোমবার রাত ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাফিতি অংকন কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। সোমবার অনলাইনে ক্যাম্পেইন চালাব। আর মঙ্গলবার রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে এনসিটিবি ভবন ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করেছি।”