সবার ধারণা, মানুষ বিদেশে গেলে নাকি দেশ বা দেশের সংস্কৃতিকে ভুলে যায়। এমনকি পরবর্তী প্রজন্মকেও তারা বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি থেকে দূরে রাখে।
Published : 24 Sep 2017, 11:33 AM
ঠিক এরকম একটি ধারণা আমারও ছিলো যখন আমি বাংলাদেশে ছিলাম। কিন্তু এইদেশে এসে ধারণাটি পুরোপুরি পাল্টে গেলো। যুক্তরাজ্যে সকল প্রবাসী বাঙালি যেভাবে বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে বহন ও পালন করছে, তা দেখে একেবারেই মুগ্ধ হয়ে গেছি আমি।
এখনও আমাদের দেশে অনেক ছেলেমেয়েরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে না। এমনকি কোন তারিখ কিসের জন্য স্মরণীয়, তাও ঠিক মতো বলতে পারে না বা এর পেছনে যে কী ইতিহাস, তাও জানে না। হয়তো এই কারণে আমরা দোষারোপ করতে পারি পরিবারের শিক্ষা বা স্কুলের শিক্ষাকে।
বেশ কিছুদিন আগে ছোট বোনের সাথে গিয়েছিলাম পার্কে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে। তখনই আরও ভালোভাবে অবগত হলাম, শুধু যে বাংলাদেশে তা নয়, এমনকি প্রবাসেও শ্রদ্ধার সাথে ইতিহাসকে স্মরণ করা হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে।
হয়তো অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে পার্কে কেন? কারণ, এই পার্ক হচ্ছে একটি ঐতিহাসিক পার্ক। এখানে বাংলা ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিস্মারক শহীদ মিনার রয়েছে, এর নাম হচ্ছে ‘আলতাব আলী পার্ক’।
এই আলতাব আলী পার্কের সাথে প্রথম পরিচিত হয়েছি ২০১৩ সালে। যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রবাসী বাঙালিরা জেগে উঠেছিলো। কিন্তু কেন, কী কারণে এই পার্কের নাম ‘আলতাব আলী’ নামকরণ করা হয়েছে, এর ইতিহাস আমার জানা ছিলো না। এমনকি পূর্বে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার কাছ থেকে শুনেছিলাম, আমাদের শহীদ মিনারের মতো নাকি আরেকটি শহীদ মিনার আছে লন্ডনে, যেখানে ফেব্রুয়ারি মাসে শহীদদের স্মরণে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এই আলতাব আলী পার্ক মূলত এডলার স্ট্রিট, হোয়াইট চার্চ লেন এবং হোয়াইট চ্যাপেল হাই স্ট্রিটে অবস্থিত একটি ছোট পার্ক, যার পূর্ব নাম ছিলো ‘সেন্ট মেরিস পার্ক’। এটি ১৪ শতকের পুরনো হোয়াইট চ্যাপেল, সেন্ট মেরি মার্টফেলেনের অংশ, যেখান থেকে হোয়াইট চ্যাপেল এলাকার নামকরণ করা হয়।
এই পার্কের নামকরণ করা হয় যে মহান ব্যক্তিটির নামে, তিনি ছিলেন ব্রিটেনের অভিবাসী বাংলাদেশি ফ্যাক্টরি শ্রমিক। তিনি ১৯৭৮ সালের ৪ মে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে পূর্ব লন্ডনের এডলার স্ট্রিটে বর্ণবাদীদের হাতে খুন হন। সেই সাথে বিলেতের মাটিতে সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাস। তাঁর বাড়ি ছিলো বাংলাদেশের সিলেট জেলায়। তিনি পেশায় একজন বস্ত্র শ্রমিক ছিলেন।
তাঁর মৃত্যুর পর লন্ডনের বাঙালি সম্প্রদায় বর্ণবাদবিরোধী প্রতিবাদে নেমেছিলেন। একটা সময়ে এই আন্দোলন প্রকট আকার ধারণ করেছিলো। এরপর আলতাব আলীর তিন হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারের পর ১৯৭৯ সালে এদের একজনকে ছুরিকাঘাতের জন্য সাত বছরের জেল আর বাকি দুইজনকে সাহায্য করার জন্য তিন বছরের জেল দেওয়া হয়।
এর আগেও অস্থায়ী শহীদ মিনার ছিলো, যেটি কিনা পূর্ব লন্ডনের হ্যানবেরি স্ট্রিটের একটি হলে ছিলো। এরপর দীর্ঘ কয়েক বছর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ‘শহীদ আলতাব আলী’ নামে নামকরণ করে পূর্ব লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল রোডের পার্কে ১৯৯৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে প্রথম অস্থায়ীভাবে একটি শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়।
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সঙ্গে এ বিষয়ে দেন-দরবারের এক পর্যায়ে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণে কাউন্সিল-সম্প্রদায়ের ঐকমত্যে পৌঁছতে সক্ষমের পর এই আলতাব আলী পার্কেই স্থায়ীভাবে নির্মিত হয় এই শহীদ মিনার। এই আলতাব আলী পার্কের শহীদ মিনার হচ্ছে প্রবাসী বাঙালিদের অনুপ্রেরণা ও আত্মপরিচয়ের প্রতীক।
শুধু উল্লেখযোগ্য দিনেই নয়, অন্যান্য সময়েও এখানকার বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা প্রায় সময় এই পার্কে সমাবেত হয় তাদের মতামত প্রকাশের জন্য। এক কথায়, এই পার্ক হচ্ছে এখানকার প্রবাসী বাঙালিদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের স্থান।
ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই দেশের প্রবাসী বাঙালিদের, যাদের কারণে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এখনো বেঁচে আছে এই প্রজন্মের মাঝে।
লেখক:
প্রবাসী শিক্ষার্থী ও সাবেক গণমাধ্যমকর্মী
ই-মেইল: [email protected]
লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |