কুমিল্লা সিটির সাবেক মেয়র আরফানুল হক রিফাতের প্রতিশ্রুতি ছিল, নির্বাচিত হলে তিনি এক বছরের মধ্যে নগরবাসীকে যানজট ও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেবেন।
Published : 01 Mar 2024, 09:34 PM
ভোট এলেই নগরীর যানজট ও জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রতিশ্রুতি দেন মেয়র পদপ্রার্থীরা; কিন্তু বাস্তবে এর কোনো সমাধান হয় না বলে অভিযোগ করেছেন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ভোটাররা। ফলে যে এই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করবেন এবার তাকে মেয়র হিসেবে বেছে নেওয়ার কথা বলছেন তারা।
ভোটারদের ভাষ্য, নগরীর এখন প্রধান সমস্যা যানজট। বলতে গেলে, যানজট নাগরিকদের জন্য ‘বিষফোঁড়া’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর একটু বৃষ্টি হলেই নগরীতে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার। এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় গোটা নগরী।
ফলে প্রার্থীরা যখন ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ভোট প্রার্থনা ও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন; তখন ভোটাররা প্রার্থীদের কানে বারবার যানজট আর জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির কথাই বলছেন।
৯ মার্চ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএমে) মাধ্যমে কুমিল্লা সিটিতে মেয়র পদে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এবারের নির্বাচনে সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেনি। এখানে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের দুইজন নেতা এবং বিএনপির সাবেক দুইজন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন।
তারা হলেন- মনিরুল হক সাক্কু, তাহসিন বাহার সূচনা, নিজাম উদ্দিন কায়সার ও নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ২০১১ সালে। প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনে প্রার্থীদের ইশতেহারে প্রাধান্য ছিলো জলাবদ্ধতা আর যানজট মুক্ত কুমিল্লা গড়ার। সবশেষ ২০২২ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত তৃতীয় নির্বাচনে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত। রিফাতের প্রতিশ্রুতি ছিলো- নির্বাচিত হলে এক বছরের মধ্যে নগরবাসীকে যানজট ও জলাবদ্ধতা থেকে তিনি মুক্তি দেবেন।
গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে মারা যান রিফাত। তার মৃত্যুতে ১৮ ডিসেম্বর মেয়রের পদ শূন্য হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২২ জানুয়ারি এ সিটিরি মেয়র পদের উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।
যানজট ও জলাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে নগরীর শিক্ষাবোর্ড এলাকার বাসিন্দা জোনায়েদ হোসেন বলেন, “কুমিল্লা নগরীতে যানজটের কারণে মানুষ এখন দিশেহারা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তার মধ্যে নষ্ট হচ্ছে। ৫ মিনিটের জায়গা যেতে লাগে এক ঘণ্টা। আমরা আর প্রতিশ্রুতি নয়; সমস্যার সমাধান চাই।”
নজরুল অ্যাভিনিউ এলাকার বাসিন্দা মনিরুজ্জামান মজুমদার বলেন, “মানুষ এখন কাগজের ইশতেহার আর প্রতিশ্রুতি দেখতে চায় না। দ্রুত সমস্যার সমাধান চায়। সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা যে রাখতে পারবে, এমন ব্যক্তিকেই এবার নির্বাচিত করবে ভোটাররা।”
দুই সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে টেবিল ঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী কুমিল্লা সিটির সাবেক দুইবারের মেয়র ও বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু বলেন, “২০১৭ সালের নির্বাচনে আমার অঙ্গীকার ছিল জলাবদ্ধতা ও যানজট সমস্যার সমাধান। জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে আমি অনেক কাজ করেছি। আমার উন্নয়ন কাজের কারণে গত দু’বছর নগরীতে আগের মতো জলাবদ্ধতা নেই।
“যানজটের সমস্যা সমাধানের জন্য রাস্তা বড় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু গত নির্বাচনে আমাকে ষড়যন্ত্র করে হারিয়ে দেওয়ায় সেটা করতে পারিনি। এবার মেয়র হলে আমার প্রথম কাজ হবে যানজটের সমস্যা সমাধান করা। কুমিল্লাকে একটি আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তুলব আমি।”
বাস প্রতীকের প্রার্থী কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাহসিন বাহার সূচনা বলেন, “যানজট কুমিল্লা নগরীর একটি বড় সমস্যা। এটির সমাধান করা প্রয়োজন। আমি বিজয়ী হলে এই সমস্যা সমাধানে নগরবাসীর সঙ্গে বসব; প্রশাসনের সঙ্গে বসব। যানজটের কারণ খুঁজে বের করব এবং নগরবাসীর সমস্যা যেভাবে সমাধান হয়- সেভাবেই কাজ করব।
“দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে কুমিল্লা শহর অনেক পিছিয়ে গেছে। আমি নির্বাচিত হলে প্রধান কাজ হবে ন্যায় এবং সততার সঙ্গে কাজ করে কুমিল্লাকে এগিয়ে নেওয়া।”
ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার বলেন, “কুমিল্লার তরুণ প্রজন্ম আমার সঙ্গে আছে। আমি সুশীল নাগরিকসহ সর্বমহলে কথা বলেই মাঠে নেমেছি। বিগত সময়ে কাজ হয়নি, লুটপাট হয়েছে।
“নগরীর সড়ক বেহাল। নগরীর ছোট-বড় সব সড়ক শৃঙ্খলার মধ্যে আনলে যানজট থাকবে না। আমি নির্বাচিত হলে পরিকল্পিত নগরী গড়ে তুলব। দ্রুত সময়ের মধ্যে যানজট ও জলাবদ্ধতা দূর করব।”
হাতি প্রতীকের প্রার্থী কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি নুর উর রহমান মাহমুদ তানিম বলেন, “কুমিল্লা এখন কুমিল্লার মানুষের হাতে নাই। আমি মেয়র হলে নগরবাসীর শহর তাদের হাতে তুলে দেব। যানজট, জলাবদ্ধতা সমাধান অবশ্যই করব। সর্বপ্রথম সড়কে চাঁদাবাজি ও টোকেন বাণিজ্য বন্ধ করব।
“কুমিল্লা দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্বে সংকট রয়েছে। আগামীর কুমিল্লাকে সাজাতে নতুন নেতৃত্ব প্রয়োজন। আমি কুমিল্লার মানুষকে বলব- আমাকে একটিবার সুযোগ দিন। আমি স্বপ্নবাজ মানুষ; আপনাদের নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন আছে। আমি সেই স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে চাই।”
কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, “কুমিল্লা নগরীর জলাবদ্ধতা ও যানজট সমস্যার সমাধানের জন্য মানুষ একজন প্রকৃত নগর সেবক চায়। যিনি কুমিল্লা ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষায় ভূমিকা রাখবেন।
“এ ছাড়া এই সমস্যাগুলো সমাধানের মাধ্যমে নগরীকে আগামী ১০০ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে আধুনিক সিটিতে রূপান্তরিত করবেন। যিনি তরুণ প্রজন্মকে জাগিয়ে তুলে কুমিল্লাকে এগিয়ে নেবেন। তবে আগামীতে জলাবদ্ধতা ও যানজট মুক্ত একটি সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন নগরীকে গড়তে পারবেন- সেই সিদ্ধান্ত ভোটারদেরই নিতে হবে”, বলেন আহসানুল কবীর।
আরও পড়ুন:
কুমিল্লা সিটি উপনির্বাচন: সূচনা ছাড়া সবারই অভিযোগ
কুমিল্লা সিটি উপনির্বাচন: সূচনার বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তানিমের