“তোমাগো সরকাররে কও, আমার পোলাডার পোড়া লাশটা দিতে না পারুক, হাড্ডিডা দিতো,” বলছিলেন নিখোঁজ আমান উল্লাহর মা।
Published : 20 Oct 2024, 01:28 AM
আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রীর গাজী টায়ারস কারখানায় হামলা, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অন্তত ১৮২ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
২৫ অগাস্ট রাতে অগ্নিসংযোগের পর সকাল থেকেই আশপাশের এলাকার নিখোঁজদের স্বজনরা কারখানার ফটকে জড়ো হয়েছিলেন। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে প্রশাসন স্বজনদের কাছ থেকে নিখোঁজদের ছবি ও তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র রেখে নাম নিবন্ধন শুরু করে।
টানা পাঁচ দিন ধরে জ্বলা আগুনে ভবনটি ভেতরে থাকা কেউ যে আর রক্ত-মাংসে আস্ত থাকবেন না; সেটা ধরে নিয়েই স্বজনরা নিখোঁজদের অন্তত লাশটুকু চেয়েছিলেন; কিন্তু সেটাও তাদের ভাগ্যে জোটেনি। কারণ আগুনে পোড়া ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে সেখানে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
১২ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসনের দাখিল করা প্রতিবেদনে ‘দুর্ঘটনায় আহত, ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহতদের বিবরণ’ শিরোনামে বলা হয়েছে- তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গেলে ফ্যাক্টরির বাইরে বেশ কিছু ব্যক্তি তাদের নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধান করতে থাকেন। নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকার জন্য কমিটি ১ সেপ্টেম্বর গণশুনানির আয়োজন করে। সেখানে ৮০ জন নিখোঁজ ব্যক্তির তথ্য দেন স্বজনরা।
“তাছাড়া উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ ও শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন তালিকা তৈরি করে। তালিকাগুলো একত্রিত করে মোট ১৮২ জন ব্যক্তির নিখোঁজ থাকার তথ্য প্রাথমিকভাবে পাওয়া যায়। তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা প্রয়োজন।”
কমিটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় শনাক্ত করে স্বজনদের হাড়গোড় বুঝিয়ে দেওয়ারও সুপারিশ করেছে।
কমিটি এই কাজটি করার জন্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করলেও জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেছেন, নিখোঁজদের তালিকা যাচাই-বাছাই করার ব্যাপারে কোনো চিঠি তিনি পাননি।
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক পর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ব্যাপক সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনার মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। তখন আওয়ামী লীগের অনেক পালিয়ে ও আত্মগোপনে চলে যান।
কারখানাটির মালিক আওয়ামী লীগ সরকারের প্রাক্তন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এবং নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের চারবারের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী। তাকে ২৫ সেপ্টেম্বর ভোরে রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওইদিন রাতে রূপগঞ্জের রূপসী এলাকায় দেশের বৃহৎ টায়ার প্রস্তুতকারী কারখানাটিতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। টানা পাঁচদিন পর ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আগুন নেভাতে সক্ষম হন।
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক আগুনের সূত্রপাত ও দায়ীদের চিহ্নিত করতে ২৭ অগাস্ট তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। গত ১২ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে ৩২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি দাখিল করেন কমিটির প্রধান।
ওই ঘটনাকে প্রতিবেদনে নিছক দুর্ঘটনা নয়, ‘অগ্নিসংযোগ’ হিসেবে বর্ণনা করা হলেও কারা ওই কাজ করেছে সুনির্দিষ্টভাবে তাদের চিহ্নিত করা হয়নি।
‘লুটপাটকারীরা অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায়’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় পর্যায়ে গাজীর গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে ওইদিন লোকজন আনন্দ মিছিল বের করে। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে খাদুন এলাকার খাঁ পাড়া জামে মসজিদ থেকে মাইকে কয়েকজন ব্যক্তি ‘কারখানার ভেতরে যাদের জমি জোর করে দখল করা হয়েছে তাদের বিকাল ৩টার দিকে রূপসী বাসস্টেশনে জড়ো হওয়ার’ ঘোষণা দেন।
বেলা ১২টার দিকে লুটপাট করার উদ্দেশ্যে ‘দুষ্কৃতকারীরা’ কারখানায় প্রবেশ করে। তারা কারখানার ভেতরে থাকা শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বের করে দিয়ে লুটতরাজ শুরু করে। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে আরেকদল ‘দুষ্কৃতকারী’ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে কারখানায় প্রবেশ করে। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে লুটপাটকারীদের একাধিক দলের মধ্যে কারখানার বাইরে ও ভেতরে বাকবিতণ্ডা ও সংঘর্ষ হয়।
পরে খাঁ পাড়া মসজিদ থেকে পুনরায় ‘গাজীর কারখানায় ডাকাত ঢুকেছে’ ঘোষণা দিয়ে এলাকাবাসীকে তাদের প্রতিহত করার আহ্বান জানানো হয়। তাতে লুটপাট আরও বেড়ে যায়। লুটপাটকারীরা তখন কারখানা ছয়তলা ভবনটির বিভিন্ন তলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং লুটপাট চালিয়ে যেতে থাকে।
আগুন দেওয়ার ঘটনার পর কারখানার এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, দুপুর থেকে রাতে আগুন দেওয়ার আগ পর্যন্ত টানা লুটপাট চলে। এই পুরো সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য সেখানে যাননি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে লুটপাটকারীদের একটি দল ভবনের নিচতলায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেটের শাটারে তালা ঝুলিয়ে চলে যান। ওই সময় অনেকে ভবনটির উপরের অংশে লুটপাটে ব্যস্ত ছিলেন। ভবনটিতে দাহ্য পদার্থ থাকায় দ্রুত প্রতিটি তলায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিটের টানা ২২ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন পুরোপুরি নেভে পাঁচ দিন পর। দীর্ঘ সময় ধরে জ্বলতে থাকা আগুনে ভবনটি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হওয়ায় সেখানে উদ্ধার অভিযান চালানো যায়নি।
তবে, পরবর্তীতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা ভবনটি থেকে ১৫ খণ্ড হাড় উদ্ধার করেন। তা পুলিশের কাছে জমা রাখা হয়।
তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে বলছে, ৫ অগাস্ট প্রথমবার এই কারখানায় লুটপাট চালানো হয়। ওই সময়ও কারখানাটির বেশকিছু স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়। তখন লুটপাট চলে ৮ অগাস্ট পর্যন্ত। তারপর থেকে কারখানার ওই ভবনের বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ ছিল।
ভবন অপসারণের পর লাশের খোঁজ
প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনে ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে। প্রথম সুপারিশে বলা হয়েছে- আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভবনটি অপসারণের মাধ্যমে উদ্ধার কাজ সম্পন্ন করা যায়। ভবনটি মালিকপক্ষকেই অপসারণ করতে হবে।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, “ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সেটি বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। ভবনটি ভাঙা হলে ভেতরে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো যেতে পারে। তবে ভবনটি ভাঙার কাজ করবে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে আমাদের কোনো সহযোগিতা লাগলে করব। কিন্তু ভবনটি তারা কবে ভাঙবেন এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কোনো সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি।”
অপসারণের আগ পর্যন্ত ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে চারপাশে ব্যানার টানানোর সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গাজী টায়ারসের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা প্রশাসনে ও বুয়েটে চিঠি দিয়েছিলাম ভবনটি নিয়ে কিছু করা যাবে কিনা জানতে৷ তাদের সম্মতি পাইনি৷
“এ ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনিকভাবে যে সিদ্ধান্ত হবে, পরবর্তীতে সেইভাবে কাজ করব৷ এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি৷”
হাড়গোড় সিআইডির ফরেনসিক বিভাগে
হাড়গুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় শনাক্ত করা এবং নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা অধিকতর যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করতে গোয়েন্দা সংস্থাকে নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, “ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সেখানে পুরোপুরিভাবে উদ্ধার অভিযান চালানো যায়নি। তবে যে ১৮২টি পরিবার তাদের স্বজনদের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে দাবি করছেন, তাদের ব্যাপারে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য জেলা পুলিশকে চিঠি দেওয়া হবে।
“এ ছাড়া উদ্ধার হওয়া হাড়গুলো সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মাধ্যমে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।”
জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, “নিখোঁজ ব্যক্তিদের তথ্য ভেরিফাই করার বিষয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো চিঠি আসেনি। ফলে এ নিয়ে পুলিশ এ মুহূর্তে কোনো কাজ করছে না।
“তবে যে হাড়গোড় পাওয়া গেছে তা সিআইডির ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এসব হাড়গোড় মানুষের নাকি অন্য কোনো প্রাণীর সে বিষয়টি জানার জন্য। তবে সিআইডি থেকে এখন পর্যন্ত কোনো রিপোর্ট আসেনি।”
‘আমি তো মা, কইলজাটা জ্বলতেছে’
প্রতিবেদনের তালিকা অনুযায়ী, দৈবচয়নের মাধ্যমে গত এক সপ্তাহে অন্তত ৩০ জন নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। নিখোঁজ সদস্যদের কোনো সন্ধান এখনও তারা পাননি বলে জানিয়েছেন। ঘটনার দুই মাস হতে চলেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিবারগুলোর সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেননি।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনেকে তাদের প্রিয়জনকে জীবিত পাবার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে আপনজনকে হারিয়ে নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে নিজ গ্রামের বাড়িতেও চলে গেছেন।
২০ বছর বয়সী ছেলে আমান উল্লাহর কোনো খোঁজ না পেয়ে দিশেহারা বৃদ্ধা রাশিদা বেগম। মোবাইলে অপর প্রান্ত থেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “বাবা গো, খালি তো ফোন দিয়া জিগাও। পোলাডার খোঁজ তো দিতে পারলা না। সব হাসপাতালে খুঁজছি, সবহানে খুঁজছি। কোনো খবর পাই না। তোমাগো সরকাররে কও, আমার পোলাডার পোড়া লাশটা দিতে না পারুক, হাড্ডিডা দিতো।”
রাশিদা বেগমের মতো একই হাল আমেনা বেগমের। একমাত্র সন্তান অপু মিয়ার (২৬) খোঁজে এখনও গাজী কারখানার সামনে গিয়ে দাঁড়ান তিনি। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারেন না।
“দেড় মাস গেলো গা। গাজীর মিলে যাই আর আহি। কেউ ভিতরে ঢুকতে দেয় না। কয়, চুরি করতে গিয়া মরছে, এইটার খবর নাকি কেউ দিবো। এহোন আমার তো পোলা। ওইখানে খাড়াইয়া থাকি ভাল্লাগে। লাশ তো দূরের কথা কাপড়-চোপড়ও পাইলাম না। আমার তো আর চাইর-পাঁচটা পোলাপান নাই, একটাই পোলা আছিল আমার। আমি তো মা, আমার কইলজাটা জ্বলতেছে।”
ডুকরে কেঁদে ওঠেন আমেনা। কাঁদতে কাঁদতে তার ‘পোড়া কপালের’ বৃত্তান্ত শোনান।
স্থানীয় একটি সোয়েটার কারখানায় কাজ করতেন অপু। ঘটনার দিন বেতন তুলেছিলেন তিনি। বেতন নিয়ে ফেরার পথে ভিড় দেখে কারখানার ভেতর ঢোকেন।
আমেনা বলেন, “এলাকার কয়েকজনরে পাইয়া ভিতরে গেছিল আপু। তারে পাই না দেইখা গাজীর মিলে খুঁজতে পাঠাইছিলাম ছোট ভাইরে (নজরুল)। ভাইগ্নারে খুঁজতে গিয়া আমার ভাইটাও নিখোঁজ। যে আগুন লাগাইলো। হের কপালে যেন আগুনটা লাগে।”
আমান রূপগঞ্জের স্থানীয় একটি ব্যাটারি প্রস্তুতকারী কারখানায় কাজ করতেন। তার পরিবারের ভাষ্য, আগুনের ঘটনার রাতে গাজী টায়ারসের কারখানায় আটকা পড়ে ১০টার দিকে বাড়িতে ফোন দিয়েছিলেন আমান। আটকা পড়ার কথা বলতে বলতেই কল কেটে যায়। এরপর তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেনি পরিবার। পরে তার ফোন বন্ধ হয়ে যায়।
আমানের খোঁজে কারখানার সামনে ধরনা দেওয়ার পাশাপাশি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি হাসপাতালে গেছেন স্বজনরা। প্রশাসন, শিক্ষার্থী, ফায়ার সার্ভিস; যে যখন নিখোঁজদের তালিকা করেছেন, সবার কাছেই নিজের ছেলের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। সরকারি কোনো সংস্থাই আমানকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে পারেনি।
সর্বশেষ ৬ অক্টোবর রূপগঞ্জ থানায় নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন আমানের বাবা আব্দুল বাতেন।
‘প্রশাসন-সরকার চাইতেছে ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে’
রাজমিস্ত্রি আলী হোসেন (২৪) অগ্নিসংযোগের রাত থেকেই নিখোঁজ। পরিবার এখন তাকে জীবিত পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছে।
আলী হোসেনের ছোটভাই মো. শাকিল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “প্রশাসনের কাছে যাইয়া কোনো লাভ নাই। তারা কিছু করতেছে না। এইটা তো সাধারণ কোনো ঘটনা না। নিখোঁজের সংখ্যা তো অনেক। প্রশাসন আর সরকার চাইতেছে এই ব্যাপারটাতে ধামাচাপা দিতে। নাইলে এতদিন হয়ে গেল, তারা কোনো খোঁজ দিবো না?”
বরিশালের আব্দুস সালাম রূপগঞ্জের একটি টেক্সটাইল কারখানায় চাকরি করতেন। স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন ভাড়া বাসায়। আগুনের ঘটনায় নিখোঁজের তালিকায় রয়েছে সালামের নাম। তার খোঁজে গ্রাম থেকে ছুটে এসেছিলেন ছোটভাই মো. শামীম। দুইদিন রূপগঞ্জে থাকার পরও যখন কোনো খোঁজ পেলেন না তখন আবার গ্রামে ফিরে যান।
“এলাকার পরিচিত একজনের সঙ্গে ওই কারখানায় ঢুকছিল। কারখানা, আশপাশের এলাকা, হাসপাতাল; সব জায়গায় খুঁজছি। কোনো সন্ধান পাই নাই। মনে সান্ত্বনা দেই এই বইলা যে, হয়তো সে অন্য কোনো ঝামেলায় পড়ছে। হয়তো সুস্থ শরীরে একদিন বাড়িতে আসবো”, বলেন শামীম।
তবে মনে আশা নেই জাকির হোসেনের। তার ছোটভাই মনির হোসেন (২৮) মারা গেছেন ধরে নিয়ে সুনামগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে গায়েবানা জানাজাও হয়েছে বলে জানালেন। গ্রামে ফেরার আগে ভবনটিতে ঢুকে মনিরের জুতা জোড়া খুঁজে পেয়েছিলেন জাকির। ওই জুতা আর ভবন থেকে একমুঠো ছাই নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি।
অনিশ্চয়তার সঙ্গে দিন পার করছেন তরুণ আজাদ হোসেন (২১), মোহাম্মদ আলী (৩৭), টেক্সটাইল কারখানা শ্রমিক মো. আরিফ (২৮), স্থানীয় একটি ওয়ার্কশপের শ্রমিক আলী আসাদ ভূঁইয়া (৪৩), গাড়িচালক আবু সাইদ ভূঁইয়া (৪৮), মাছ বিক্রেতা আব্দুল জলিল মিয়া (৩৮), চাকরিজীবী জহিরুল ইসলাম (৪২) এবং ১৩ বছরের কিশোর নিরবের পরিবার।
‘দায়সারা তদন্ত’
গাজী টায়ারসে আগুনের ঘটনায় ‘প্রশাসন একটি দায়সারা তদন্ত করেছে’ বলে মন্তব্য করেছেন নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি রফিউর রাব্বি।
তিনি বলেন, “যে সময়ে ঘটনাটা ঘটল সে সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল, যা এখনও আছে। কিন্তু গাজী টায়ারের ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। এতগুলো পরিবার স্বজন হারানোর পরে একটি দায় এড়ানোর মতো তদন্ত করেছে প্রশাসন।
“নিখোঁজ ব্যক্তিদের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত একটা সুষ্ঠু রিপোর্ট প্রকাশ না হওয়া অবশ্যই এই সরকারের ব্যর্থতা। এই দায় তারা এড়াতে পারে না। এই ব্যাপারে আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল।”
গাজী টায়ারসে ৫ থেকে ৮ অগাস্ট হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তিনটি এবং পরে ২৫ অগাস্ট হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আরও দুটি মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রূপগঞ্জ থানার ওসি লিয়াকত আলী।
তিনি বলেন, “মামলাগুলো কারখানা কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে দায়ের করেছেন। কারা এই হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িত ছিলেন তাদের চিহ্নিত করতে পুলিশ কাজ করছে।”
আরো যত সুপারিশ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে–
• ঘটনার পরিকল্পনাকারী ও দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিত করার জন্য রাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে অধিকতর তদন্ত করা যেতে পারে।
• নিখোঁজ ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত সচল মোবাইল নম্বরগুলো উদ্ধার ও চিহ্নিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
• প্রতিটি ভবনে বাধ্যতামূলকভাবে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণসহ ভবন থেকে বের হওয়ার একাধিক সিঁড়ি অথবা লিফট রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
• সরকারি জেলা হাসপাতালসমূহে প্রশিক্ষিত ডাক্তার ও জনবলসহ পৃথকভাবে বার্ন ইউনিট স্থাপন করা যেতে পারে।
• ভবিষ্যতে ফ্যাক্টরিতে যে কোনো ধরনের নাশকতা/দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা যেতে পারে।
• উদ্ধারকাজে নিয়োজিত প্রতিটি সংস্থার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ আয়োজনের মাধ্যমে দক্ষ জনবল হিসেবে তৈরি করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন:
গাজী টায়ারসে আগুন: নিখোঁজরা ঘরে ফেরেনি
গাজী টায়ারস: ভবনের বেজমেন্টে আগুন পৌঁছায়নি, সেখানে কোনো ‘ভিক্টিম’ নেই
গাজী টায়ারস: ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে ঢুকে উদ্ধার অভিযান চালানো ‘খুবই বিপজ্জনক’
গাজী টায়ারসে উদ্ধার অভিযান নিয়ে সিদ্ধান্ত বৃহস্পতিবার
গাজী টায়ারসে আগুন-লুটপাট: জেলা প্রশাসনের ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি
গাজী টায়ারস: ৪ দিনেও শুরু হয়নি উদ্ধার অভিযান
গাজী টায়ারসে আগুন-লুটপাট: জেলা প্রশাসনের ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি
গাজী টায়ারসে আগুন: এবার নিখোঁজদের তালিকা করছে প্রশাসন ও শিক্ষার্থ
'আমার ভাইয়ের লাশটাও পাইতেছি না গো'
গাজী টায়ারস: ৩২ ঘণ্টা পর নিভেছে আগুন, ভবন ধসের শঙ্কা
গাজী টায়ারস: মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো, তারপর লুটপাট-আগুন
গাজী টায়ার: ২২ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে, তবে পুরোপুরি নেভেনি
গাজী টায়ারস: ২১ ঘণ্টায়ও নেভেনি আগুন, লুটপাট চলছেই
লুটপাট-নাশকতা: ১৪ ঘণ্টায়ও নিয়ন্ত্রণে আসেনি গাজী টায়ার কারখানা