সোমবার দিনভর কারখানার সামনে নিখোঁজদের খোঁজে আহাজারি করেছেন স্বজনরা; রাতে অনেকে সেখানে ছিলেন।
Published : 27 Aug 2024, 01:51 AM
সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর পরই স্থানীয় কিছু মানুষ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের একটি মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোকজন জড়ো করে; পরে তারা গাজী টায়ারসের কারখানায় দিনভর লুটপাট চালিয়ে রাতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
সেই ভয়াবহ আগুন ২৪ ঘণ্টা ধরে জ্বলতে দেখা গেছে। রোববার রাতে লুটপাটের সময় কারখানায় আসা আশপাশের অন্তত পৌনে ২০০ মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন বলে স্বজনরা দাবি করেছেন।
তারা সোমবার দিনভর কারখানার সামনে নিখোঁজদের খোঁজে আহাজারি করেছেন। নিখোঁজের নাম সেখানে দায়িত্বরত ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সদস্যদের কাছে দিয়েছেন স্বজনরা। রাতেও তাদের সেখানে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, “সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে৷ তবে, এখনও পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়নি৷ আগুন নেভাতে কার্যক্রম এখনও চলমান রয়েছে।”
রাত ১১টার দিকেও ভবনটিতে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে৷
এর আগে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এক দফায় গাজীর রূপসী ও কর্ণগোপের দুটি কারখানায় হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল। সেদিনও বড় ধরনের লুটপাটের হয় বলে কারখানা কর্তৃপক্ষ জানায়।
রোব ও সোমবার রূপসীর কারখানাটিতে দ্বিতীয় দফায় লুটপাট চালানো হয়।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পূর্বপাশে তারাবো পৌরসভার রূপসী এলাকায় বিশাল জায়গাজুড়ে বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী গাজী গ্রুপের গাড়ির টায়ার প্রস্তুতকারী কারখানা ‘গাজী টায়ারস’ এর অবস্থান৷
কারখানাটির মালিক আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী৷ রোববার ভোররাতে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবপ্রাপ্ত এ মুক্তিযোদ্ধাকে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গ্রেপ্তারের খবরটি তার নির্বাচনি এলাকা রূপগঞ্জ উপজেলায় ছড়িয়ে পড়লে সকাল থেকেই সেখানে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়৷ দুপুরের দিকে টায়ার প্রস্তুতকারী কারখানাটির অদূরে একটি মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করেন একদল ব্যক্তি৷
এ ঘোষণার পর কয়েকশ লোক জড়ো হন কারখানাটির সামনে, শুরু হয় লুটপাট৷ দিনভর লুটপাটের পর রাত ৯টার দিকে কারখানাটির ভেতরের একটি ছয়তলা ভবনে আগুন দেয় লুটপাটকারীদের একটি দল৷
সোমবার দিনভর প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় বাসিন্দা, কারখানা কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে৷
তবে, নিখোঁজদের কেউ কারখানাটির কর্মী নন। সবাই আশেপাশের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা৷ তারা লুটপাটের সময় ভবনটির ভেতরে ছিলেন। কিন্তু আগুন লাগার পর বের হতে পারেননি বলে দাবি স্বজনদের৷
‘জমির মালিকদের’ জড়ো হওয়ার ঘোষণা
গোলাম দস্তগীর গাজী রূপগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে টানা চারবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য৷ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও তিনি৷ ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন৷ রূপগঞ্জে তার একাধিক ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান রয়েছে৷
কারখানাটির আশপাশের অন্তত ১৫ জনের সঙ্গে সোমবার দিনভর কথা হয়। তাদের ভাষ্যমতে, ৫০ একরেরও বেশি জায়গাজুড়ে ‘গাজী টায়ারস’ কারখানাটি অবস্থিত। কারখানার কিছু জমি নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে মালিকপক্ষের দ্বন্দ্ব রয়েছে৷
গাজীর গ্রেপ্তারের পর রোববার দুপুরে ‘জমি ফেরত পেতে’ মালিকরা একত্র হয়ে প্রতিবাদ-সমাবেশের প্রস্তুতি নেন৷ তারা মসজিদের মাইক থেকেও লোকজনকে জড়ো হওয়ার ঘোষণা দেন। তারপরই শতশত লোক সেখানে জড়ো হন।
খাদুন উত্তরপাড়া (খাঁ পাড়া) জামে মসজিদের ইমাম লুৎফর রহমান বলেন, “জোহরের নামাজের আগে মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দিয়ে একদল লোক গাজী গ্রুপের দখলে থাকা ‘জমির মালিকদের’ জড়ো হতে আহ্বান জানান৷ তাদের সবাইকে রূপসী মোড়ে জড়ো হতে বলা হয়৷
“মাইকে তখন বলা হয়, তারা গাজী গ্রুপের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করবেন কিন্তু কেউ যেন আগের মতো (৫ আগস্টের ঘটনা) লুটপাট না করেন, সেই অনুরোধও জানানো হয় মাইকে৷”
স্থানীয় এক চা দোকানি বলেন, “মসজিদের মাইকে এ ঘোষণার পর কারখানাটির সামনে কয়েকশ লোক জড়ো হলে তারা কারখানাটির ভেতরে ঢুকে লুটপাট শুরু করে৷ সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লুটপাটকারীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে৷
“যে যা পারছে লুট করছে৷ কেউ মাথায় করে, কেউ গাড়ি করে নিয়ে গেছে৷ কারও হাতে টিন দেখছি, কারও হাতে এসি-ভাঙা (শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের অংশ) দেখছি৷ সরকার যেদিন পড়ছে হেইদিনের মতোই পুরা৷ সারাদিন কোনো পুলিশ দেখি নাই৷ পুলিশ থাকলে কী এইসব হয়নি!”
লুটপাটের সময় কারখানাটির ভেতরে ছিলেন এবং লুটপাটে অংশ নিয়েছেন এমন কয়েকজনও কথা বলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে তারা নাম প্রকাশ করতে চাননি।
তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, আশপাশের বিভিন্ন এলাকার হাজারো মানুষ লুটপাটে অংশ নিয়েছে৷ বিকালের দিকে একদল যুবক ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা হাতে কারখানার ভেতর ঢোকেন৷ তারা কারখানাটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেন৷
এ নিয়ে লুটপাটে লিপ্ত থাকা আরেকটি দলের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক হয়, যা পরে হাতাহাতিতেও রূপ নেয়। পরে অস্ত্রধারী দলটি পিছু হটতে বাধ্য হয়।
এ ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর রাত ৯টার দিকে কারখানাটির ছয়তলা একটি ভবনের নিচতলায় আগুন ধরিয়ে দেয় লুটপাটকারীদের একটি দল৷ ভবনটিতে তৈরি টায়ার, টায়ার তৈরির কাঁচামাল ছিল৷ এসব কাঁচামাল সহজে দাহ্য হওয়ায় মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনজুড়ে৷
নিচে আগুন, উপরে মানুষ
আগুন দেওয়ার আগে সন্ধ্যায় কারখানাটিতে যখন লুটপাট চলছিল তখন চার বন্ধুর সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলেন তৈরি পোশাক কারখানার কর্মী ৩০ বছর বয়সী জনি মিয়া৷ জনি ও তার তিন বন্ধু এখন নিখোঁজের তালিকায়৷
সোমবার রাত ১০টার দিকে জনির খোঁজ করতে আসা স্বজনদের সঙ্গে গাজী টায়ারসের কারখানার সামনের রাস্তায় কথা হয়। তারা পাঁচ বন্ধু আগুন দেওয়ার সময় ভবনটির ভেতরে ছিলেন৷ একজন ছিলেন কারখানার নিচের অংশে৷ তিনি বেঁচে আছেন। উপরে থাকা বন্ধুরা তখনও জানতেন না ভবনটিতে আগুন দেওয়া হয়েছে৷
জনির ছোট বোন মনি আক্তার জনির বেঁচে ফেরা বন্ধুর বরাতে বলেন, “কারখানার ভেতরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ ভাইয়ারা চার বন্ধু ছিলেন উপরে৷ নিচে আগুন দিলে এক বন্ধু তাদের মোবাইলে ফোন করে আগুনের কথা জানিয়ে বেরিয়ে আসতে বলে। কিন্তু আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে তারা আর বের হতে পারেননি৷ কিছুক্ষণ পরই ভাইয়ার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়৷”
“কাল (রোববার) সারারাত আমরা ভাইয়ার খোঁজ করেছি, পাইনি৷ বাকি তিন বন্ধুও নিখোঁজ৷ তারা বুঝতেই পারেননি আগুন এত ভয়াবহ৷ আমরা ভাইয়ার লাশটা পাবো কিনা তাও এখন সন্দেহ।”
সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ
কারখানায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের খবর প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনকে জানানো হলেও সঠিক সময়ে সহায়তা পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেছেন গাজী টায়ারস কারখানার সহকারী মহাব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম।
সোমবার সকালে তিনি বলেন, “দুটি গ্রুপে কয়েকশ লোক রূপসীর কারখানায় ঢুকে পড়ে৷ আমাদের কর্মীদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের বাধা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না৷ দিনভর লুটপাটের পর রাত ৯টার দিকে কারখানাটির একাধিক ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়৷ আগুন দেওয়ার পর ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিট এলেও তারা আগুন নেভাতে পারেননি৷”
হামলার ঘটনার পর পুলিশে ফোন দিয়েও সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ করেন সাইফুল। তিনি বলেন, “আগুন দেওয়ার পর ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসে৷”
“ছয়তলা একটি ভবনের নিচে যখন আগুন দেওয়া হয় তখন লুটপাটকারীদের কয়েকজন ভবনটির উপরে ছিলেন৷ কয়েকজন দাবি করছেন, তাদের স্বজনরা ভবনে আটকা পড়েছেন।”
তবে পুলিশের পক্ষ থেকে এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ-আড়াইহাজার সার্কেলের (‘সি’ সার্কেল) সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “পুলিশ কোনো অবহেলা করেনি। আমরা কারখানার নিরাপত্তা দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।”
রাতভর স্বজনদের অপেক্ষা
সোমবার সকাল থেকে ওই এলাকার নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের ছোটাছুটি করতে দেখা যায়৷ অনেকের হাতে নিখোঁজ ব্যক্তির ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্রও ছিল৷ দিনভর নিখোঁজ সদস্যদের খবর না পেয়ে রাতেও অপেক্ষা শেষ হয়নি তাদের৷
রাত ১০টার দিকে কারখানাটির ফটকের সামনে বসে ছিলেন মধ্যবয়সী আয়েশা বেগম৷ তার ছেলের স্ত্রী রোমানা রোববার রাতে কারখানাটিতে এসেছিলেন৷ তখন থেকে তার কোনো খোঁজ মিলছে না৷
স্বামী ও সন্তান নিয়ে রূপসীর মীরবাড়ি এলাকায় থাকতেন রোমানা৷
আয়েশা বেগম বলেন, “এলাকার সবাই যাইতেছে, তা দেইখা রাতে গাজীর ফ্যাক্টরিতে আইছিল রোমানা৷ আগুন লাগার পর থেইকা খোঁজ নাই৷ কাইল (রোববার) নাতিডারে লইয়া সারারাত এইখানে বইসা ছিলাম৷”
রোমানার দুটি শিশু সন্তান রয়েছে, একজনের বয়স আট মাস জানিয়ে তার শাশুড়ি বলেন, ‘আইজ সারাদিনই এইহানে৷ জীবিত পাওনের আশা নাই৷ তারপরও আল্লার কাছে কই, শিশু বাচ্চাটার লাইগাও তার মারে যেন বাচাইয়া রাখে৷”
আরও পড়ুন:
কারখানার শ্রমিককে খুঁজতে এসে নিখোঁজ সজীব ভূঁইয়া
গাজী টায়ারস: ২১ ঘণ্টায়ও নেভেনি আগুন, লুটপাট চলছেই
গাজী টায়ার কারখানা লুটের পর আগুন: ফায়ার সার্ভিসের তালিকায় নিখোঁজ
লুটপাট-অগ্নিসংযোগ: ১৪ ঘণ্টায়ও নিয়ন্ত্রণে আসেনি গাজী টায়ার কারখানার আগুন