সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নাসির উদ্দিন খান বলেন, “যে অপরাধ করবে সে অপরাধী। কোনো সংগঠনের কাজ নয় চিনির ব্যবসা করা।”
Published : 08 Jul 2024, 01:42 AM
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় চিনির চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে সিলেটের বিয়ানিবাজারে ছাত্রলীগের দুটি কমিটি বাতিল, নেতাদের গ্রেপ্তার এবং যুবলীগের নাম আসার প্রেক্ষাপটে ‘বিব্রতকর অবস্থায়’ পড়ার কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
কিশোরগঞ্জ জেলাতেও চিনি চোরাচালানের অভিযোগে এক ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলায় আসামি হয়েছেন আরও অন্তত দুজন। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদ বিষয়টি তদন্তে একটি কমিটি করেছে।
সিলেটের ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই স্থানীয়রা বলছেন, সবকিছু ‘ম্যানেজ’ করেই শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চিনি আসছে চোরাপথে।
সীমান্ত উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার দিয়ে সড়কপথে চিনি ঢুকছে সিলেট নগরীতে। দিন দিন এর পরিমাণ বাড়ছে বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।
সিলেট জেলা, সিলেট মহানগর ও ডিবি পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর চিনি চোরাচালানের ৬১টি মামলায় ১৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে ৮৪টি যানবাহন।
চোরাচালান বন্ধের দাবি জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে বাংলাদেশ চিনি আমদানিকারক অ্যাসোসিয়েশন।
সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, “চিনি বা যে কোনো অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। ছাত্রলীগের কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মী যদি কোনো অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকেন তাহলে সংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ছাত্রলীগ যে কোনো অপরাধের বিষয়ে কোনো ছাড় দেয় না।”
জড়িতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে সিলেট মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মুশফিক জায়গীরদার বলেন, “মহানগর যুবলীগের যেসব নেতাকর্মীদের নাম এসেছে, তাদের বিষয়ে যাছাই-বাছাই করা হচ্ছে। জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে দলের গঠনতন্ত্র অনুয়ায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
চিনি চোরাচালানের অর্থনীতি
সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, বাংলাদেশে খোলা বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয় ১৩২ থেকে ১৪০ টাকা দরে। কিন্তু ভারত থেকে চোরা পথে আসা চিনি ব্যবসায়ীরা কম দামে কিনতে পারেন, কারণ এতে কোনো শুল্ক দিতে হয় না। যদিও তাতে সরকার রাজস্ব হারায়।
এই চোরা কারবার সম্পর্কে ধারণা রাখেন, এমন একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীমান্তের ওপারে ৫০ কেজির চিনির বস্তা বিক্রি হয় বাংলাদেশি ৩ হাজার ৪০০ টাকায়। প্রতি বস্তা চিনি সীমান্তের এপারে আনতে শ্রমিক ও ‘অন্যান্য’ খরচ বাবদ আরো ২০০ টাকা যায়।
তারপর সেগুলো ট্রাকে বা পিকআপে করে সিলেট নগরীতে আসে। প্রতিটি ট্রাকের (২৫০ বস্তা) জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাইনম্যানকে দিতে হয় ২৫ হাজার টাকা; আর পিকআপের জন্য (৫০ বস্তা) পাঁচ হাজার টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ট্রাক বা পিকআপ ভাড়া। ভারতেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বস্তাপ্রতি টাকা দিতে হয়।
সব মিলিয়ে চোরা কারবারিদের প্রতি বস্তা চিনির দাম পড়ে চার হাজার টাকার মত। পরিস্থিতি অনুযায়ী সেটা কমবেশি হয়। সেই চিনি বস্তা প্রতি সিলেটের ব্যবসায়ীদের কাছে সাড়ে চার হাজার থেকে চার হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এভাবে চিনি কিনলে ব্যবসায়ীদের প্রতি কেজিতে দাম পড়ে ৯০ টাকার মত।
সিলেট নগরীর পাইকারি বাজার কালীঘাটের একজন ব্যবসায়ী বলেন, “বর্তমানে ভারতীয় ৫০ কেজি চিনির বস্তা চার হাজার ৭০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা কেনা যায়। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হয় সবোর্চ্চ ৫ হাজার ১৫০ টাকায়।”
তবে চিনি ভেজা হলে দাম কমে যায় জানিয়ে তিনি বলেন, “বন্যার কারণে অনেকে ভেজা চিনি বিক্রি করেন। আর বর্ডারের সবদিকে চিনি নামার কারণে আগের থেকে লাভ কম হয়। আগে চিনির ব্যবসায় লাভ বেশি ছিল।”
ব্যবসায়ীদের হিসাবে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ২০ থেকে ২২ লাখ টন, যার প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হয়। বর্তমানে কেজিপ্রতি অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে মোট করভার ৪০ থেকে ৪১ টাকা।
চোরা পথের হদিশ
সীমান্তের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট জেলার অন্তত ছয়টি উপজেলা দিয়ে চিনি চোরাচালান হয়।
এর মধ্যে কানাইঘাট সীমান্তের সুরাইঘাট, সনাতন পুঞ্জি, বড়বন্দের সিঙ্গারি পাট, খাইবাড়ি, বেলেরতল, লোভাচড়া চা বাগানের মঙ্গলপুর, লোভা নদী, মুলাগুল বড়গ্রামসহ সীমান্ত এলাকা দিয়ে চিনি নামে।
গোয়াইনঘাটের জাফলং, বিছনাকান্দিসহ পুরো সীমান্ত এলাকা দিয়েই চিনি আসছে।
জৈন্তাপুরের মোকামবাড়ী, মোকামপুঞ্জি, কেন্দ্রী, ডিবির হাওর, ঘিলাতৈল, ফুলবাড়ী, টিপরাখলা, কমলাবাড়ী, গোয়াবাড়ী, বাইরাখেল, বাঘছড়া, তুমইর, রাবারবাগান, বালীদাঁড়া এলাকা দিয়ে চিনি আনেন চোরা কারবারিরা।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নারাইনপুর ছনবাড়ী, বরমসিদ্দিপুর ও মাঝেরগাঁও সীমান্ত এলাকা এবং কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ সীমান্তের কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে চিনি আসে।
বিয়ানীবাজার উপজেলার দুবাগ ইউনিয়নের গজুকাটা ও মুড়িয়া ইউনিয়নের সারোপাড় সীমান্ত দিয়ে চিনি নামে।
এসব চিনির একটি বড় অংশই আসে সিলেট নগরীর কালীঘাট পাইকারি বাজারে। সেখান থেকে ট্রাকে ট্রাকে চিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়।
সম্প্রতি গোয়াইনঘাটের পিয়াইন নদীতে গিয়েও ট্রলারভর্তি ভারতীয় চোরাচালানের চিনি দেখা গেছে।
যেভাবে আসে ছাত্রলীগের নাম
২০২৩ সালের অগাস্টে সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের নেতাদের চিনি চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে ফেইসবুকে পোস্ট দেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য ও সিলেটের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর-এপিপি) প্রবাল চৌধুরী পূজন। এরপর ১১ অগাস্ট তার ওপর সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে।
ওই ঘটনায় প্রবাল চৌধুরী পূজন সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক, সিলেট সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি, সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শাখার সভাপতি, জকিগঞ্জ উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদকসহ ছাত্রলীগের ৫৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আসামি করে মামলা করেন।
মামলায় সব আসামি চিনি চোরাচালানে জড়িত বলেও অভিযোগ করেন বাদী প্রবাল চৌধুরী পূজন। এরপর হামলার ঘটনাটি তদন্তে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে।
সেই মামলার ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রবাল চৌধুরী পূজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার দায়ের করা মামলাটি বর্তমানে সিআইডি তদন্ত করছেন। একজন আসামি ধরাও হয়েছিল; পরে সে জামিনে মুক্ত হয়েছে। তবে ছাত্রলীগের তদন্ত কমিটির সদস্যরা আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি।”
সম্প্রতি প্রায় দেড় টন চিনি লুটের ঘটনায় ছাত্রলীগের দুই নেতার ফোনালাপ ফাঁস হলে আলোচনা-সমালোচনার মুখে ১৪ জুন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বিয়ানীবাজার উপজেলা ও পৌর শাখা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
ওই ঘটনায় চিনির মালিক বদরুল ইসলাম বিয়ানীবাজার থানায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরো সাত থেকে আটজনকে আসামি করে মামলা করেন। ওই মামলায় উপজেলা ছাত্রলীগের সদ্যসাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হক তাহমিদ ও পৌর ছাত্রলীগের সদ্যসাবেক সভাপতি আশরাফুল আলম শাকেলসহ মোট চার আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া ৮০ বস্তা চিনি উদ্ধার ও একটি পিকআপ জব্দ করা হয়।
এরপর ৬ জুন পাচারের সময় নগরীর কোম্পানীগঞ্জ-জালালাবাদ সড়কের উমাইরগাঁও এলাকার থেকে ১৪ ট্রাক চোরাই চিনি জব্দ করে সিলেট মহনগর পুলিশ। এ ঘটনার পর উঠে আসে যুবলীগ নেতাদের নাম। একই দিন শায়েন্তাগঞ্জে আরও পাঁচ ট্রাক চিনি জব্দ করা হয়। এর পর থেকেই সিলেটে প্রায়ই জব্দ হচ্ছে ভারতীয় চিনি।
১৩ জুন রাতে চোরাই চিনি ছিনতাইকালে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে নগর পুলিশ। একইদিন জকিগঞ্জ উপজেলার কালীগঞ্জ এলাকায় চোরাই চিনি ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের নয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। পরে বিষয়টি নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়।
১৫ জুন জৈন্তাপুরে ৮৫৫ বস্তা ভারতীয় চোরাই চিনিসহ ১১টি পিকঅ্যাপ ও একটি মিনি ট্রাক আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি। ২৩ জুন সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের তামাবিল সোনা টিলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২৫৪ বস্তা ভারতীয় চিনি জব্দ করে উপজেলা প্রশাসন।
চলতি মাসে কয়েকবার পাথর বোঝাই ট্রাকে করেও চিনি পাচারকালে নগর পুলিশ আটক করেছে।
পুলিশের হাতে কত চিনি
সিলেট মহানগর পুলিশের ছয়টি থানায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত চিনি চোরাচালানের ১৯টি মামলায় ৪০ জনকে গ্রেপ্তার এবং পরিবহনে জড়িত ৩৮টি যানবাহন আটক করেছে। এ সময় তিন লাখ ৪১ হাজার ৭৯৮ কেজি ভারতীয় চিনি জব্দ করা হয়েছে: যার বাজারমূল্য চার কোটি ৩৬ লাখ ১১ হাজার ৯৬০ টাকা।
আর মহানগর ডিবি পুলিশ ১৮টি মামলায় ৫৭ জনকে গ্রেপ্তার এবং ২৮টি যানবাহন আটক করেছে। এ সময় তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬৩৪ কেজি চিনি জব্দ করা হয়েছে; যার বাজারমূল্য চার কোটি ৪১ লাখ ৫৭ হাজার ১৮০ টাকা।
সিলেট জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ মাসে চিনি চোরাচালানের ১১টি মামলায় ২২ আসামির মধ্যে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আটক চিনির পরিমাণ ২০ হাজার ৫১২ কেজি; যার আনুমানিক মূল্য ২১ লাখ ৯৬ হাজার ২০০ টাকা। আর আটক যানবাহনের সংখ্যা ১০টি।
এপ্রিল মাসে দুটি মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আটক চিনির পারিমাণ এক হাজার ৯০২ কেজি; যার আনুমানিক মূল্য ২ লাখ ৪২ হাজার ৫১০ টাকা। যানবাহনের সংখ্যা একটি।
মে মাসে আটটি মামলায় ১৬ আসামির মধ্যে ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আটক চিনির পরিমাণ ২৮ হাজার ১৬৮ কেজি; যার বাজারমূল্য ২৭ লাখ পাঁচ হাজার ৪৪০ টাকা। যানবাহনের সংখ্যা দুটি।
জুন মাসে চিনি চোরাচালানের তিনটি মামলায় ১০ আসামির মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আটক করা হয় ১৫ হাজার ৩৫০ কেজি চিনি; যার বাজারমূল্য ১৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। আটক হওয়া যানবাহন পাঁচটি।
কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে আলোচনা
২৪ জুন সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি দেখতে এবং ত্রাণ বিতরণ কাজে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। পরে রাতে সার্কিট হাউসে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের উপস্থিতিতে মতবিনিময় সভা হয়।
সেখানে উপস্থিত থাকা একাধিক নেতা জানান, সভায় সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ সভায় ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন।
তিনি বলেন, “ছাত্রলীগ, তোমাদের নিয়ে অনেক কথা শুনি। কিন্তু তোমাদের বলার সাহস আমাদের নেই। ইজ্জত থাকবে না আমাদের। অনেক কথা সিলেট শহরে শুনি। সিলেট শহরে হাঁটতে পারি না।”
সভায় ওই বক্তব্যের বিষয়ে প্রশ্ন করলে ২৬ জুন মাসুক উদ্দিন আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা চাই, আমাদের সংগঠনের কার্যক্রমে মানুষ ভালো কথা বলুক। আমি ১৯৬৭ সালে ছাত্র রাজনীতি করে এসেছি আর এই বয়সে যদি রাস্তায় বের হয়ে দল নিয়ে মানুষের বিভিন্ন কথা শুনতে হয় তাহলে খারাপ লাগে। এজন্য আমি ইন জেনারেল সবকিছু বলেছি।
“এরা তো আমার ছোট ভাই, তারা ভুল করলে সংশোধন করে দেওয়ার প্রয়োজন আছে। তবে বর্তমানে এটা বলার সৎসাহস সবার নাই।”
সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন সিলেট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. নাসির উদ্দিন খান।
চিনি চোরাচালানের বিষয়টি আলোচনার আসার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা প্রশাসন ও দলের দায়িত্বশীল নেতাদের বলেছি, যাদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত এবং দলের সাংগঠনিক বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা চাই, প্রকৃতই যদি কেউ জড়িত থাকে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হোক; যে অপরাধ করবে সে অপরাধী। কোনো সংগঠনের কাজ নয় চিনির ব্যবসা করা।”
তবে আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড থেকে শুরু করে মহানগর কমিটির কোনো নেতা চিনি চোরাচালানে জড়িত নয় দাবি করে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, “সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী যদি এসব বিষয়ের সঙ্গে জড়িত থাকেন তাহলে সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুয়ায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ কোনো অপকর্মকে সমর্থন করে না।”
আর সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, “মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সভায় সামগ্রিক বিষয়ে কথা বলেছেন। বিভিন্ন মানুষ এটাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করছে। তিনি উপদেশ দিয়েছেন ভালো হয়ে চলতে।”
সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম আহমদ বলেন, “মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সভায় কেন ছাত্রলীগের বিষয়ে এমন কথা বলেছেন তা আমি জানি না। তিনি সবসময় ছাত্রলীগকে ভালো বলেন। জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে তিনি কিছুটা হতাশায় রয়েছেন।”
‘মাসুক উদ্দিন সত্য স্বীকার করেছেন’
চিনি চোরাচালানের সঙ্গে যেভাবে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাদের নাম আসছে সেটি উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক সমাজের নেতারা।
সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন সিলেটের সমন্বয়ক আবদুল করিম চৌধুরী কিম বলেন, “চিনি চোরাচালান বিষয়ে ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতার সংবাদ যেভাবে গণমাধ্যমে এসেছে তা দেখে অবাক না হলেও সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির বক্তব্যে অবাক হয়েছি। অবাক হয়েছি এ কারণে যে, দলের দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে প্রকৃত সত্য স্বীকার করা হয় না। মাসুক উদ্দিন আহমদ সত্য স্বীকার করেছেন।
“দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রীর সামনে ছাত্রলীগ সম্পর্কে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তাই প্রকৃত সত্য। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পান। এ অবস্থায় সাধারণ নাগরিকদের পক্ষ থেকে কিছু বলা কতটা কঠিন তা অনুমেয়।”
কিম বলেন, “চিনি চোরাচালানে শুধু ছাত্রলীগ নয়, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে।”
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “ভালো কাজ করলে মানুষ গ্রহণ করবে, আর বাজে কাজ করলে আয়না দেখানো হবে। তবে যদি সরকারি দলের সবাই এক হয়ে চিনি চোরাচালান রোধ করতে পারেন তাহলে সেটি ভালো কাজ হবে; মানুষ প্রশংসা করবে।
“যাদের ওপর অভিযোগ আছে তাদের অভিভাবক সংগঠন দেখার কথা। তারা যেন সরকারকে কোনো প্রশ্নবিদ্ধ না করেন।”
তদন্তে প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা: যুবলীগ
চিনি চোরাচালানে জড়িত নেতা-কর্মীদের নাম আসার বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট জেলা যুবলীগের সভাপতি ও ওসমানীনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শামীম আহমদ বলেন, তার দলের কেউ এটাতে জড়িত নয়।
“তবে কয়েকজনের নাম আসায় জেলা যুবলীগ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আমিও ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ-খবর নিচ্ছি। জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে”, বলেন জেলা যুবলীগের সভাপতি।
সিলেট মহানগর যুবলীগের সভাপতি আলম খান মুক্তি বলেন, “মহানগর যুবলীগের নাম আমরা পেপার-পত্রিকার দেখেছি। যে জড়িত হোক আইনে তার শান্তি হবে। প্রশাসন তদন্ত করছে; প্রমাণ পেলে আইন অনুযায়ী শাস্তি হবে। যদি প্রমাণিত হয় তাহলে কমিটি বসে দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সীমান্তে ‘নজর’
চিনি চোরাচালানের ব্যাপারে জানতে চাইলে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, “মহানগর এলাকায় কোনো বর্ডার নেই। বর্ডার এলাকা পেরিয়ে নগরে প্রবেশ করলে মহানগর পুলিশ তা ধরছে।”
অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে মহানগর পুলিশের কার্যক্রম চলবে বলে সাইফুল ইসলামের ভাষ্য।
সিলেট জেলা পুলিশের মিডিয়া ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা মো. সম্রাট তালুকদার বলেন, “চোরাচালান প্রতিরোধে জেলা পুলিশ সবসময় সর্তক অবস্থানে রয়েছে, নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে।
সিলেটের সীমান্তবর্তী থানা এলাকাগুলোতেও নজর রাখা হচ্ছে জানিয়ে জেলা পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, “পুলিশের ভূমিকা নিয়ে কোনো লিখিত অভিযোগ থাকলে তদন্ত করা হয়।”
তবে এ ব্যাপারে চেষ্টা করেও বিজিবির কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
কিশোরগঞ্জে মামলা, গ্রেপ্তার, তদন্ত কমিটি
১৪ জুন ভারতীয় অবৈধ চিনিসহ একটি ট্রাক আটক করে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার পুলিশ। এ ঘটনায় চারজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করা হয়।
মামলায় আসামি হিসেবে আছেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি নাজমুল হোসেন হীরা, সাবেক সহসভাপতি আল জুবায়েদ খান নিয়াজ এবং হীরার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মো. জনি।
এর মধ্যে সম্প্রতি হীরাকে পর্নোগ্রাফির একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে চিনি চোরাচালানের মামলাতেও গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।
ঘটনা তদন্তে ২৬ জুন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ দুই সদস্যের একটি কমিটি করে। কমিটির সদস্যরা হলেন- সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. হুসাইন আহমেদ সোহান ও কাজল দাস।
কমিটিকে ১০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের কথা থাকলেও এক সপ্তাহ পরেও সেই কমিটি কাজ শুরু করেনি বলে জানান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এম এ আফজাল।
২ জুলাই তিনি জানান, এখনও কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্যরা কিশোরগঞ্জে আসেননি এবং কাজ শুরু করেনি। তদন্ত কমিটিই আনীত অভিযোগ খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) কিশোরগঞ্জ জেলা সভাপতি ম ম জুয়েল বলেন, “আজ যারা ছাত্র রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আগামীতে তারাই দেশ পরিচালনা করবেন। তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠা খুব দুঃখজনক। এসব অভিযোগ সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।”
‘সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে’
চিনির চোরাচালন বন্ধে এরই মধ্যে সরকারকে স্মারকলিপি দিয়েছে আমদানিকারকরা। এতে তারা চিনি চোরাচালান বন্ধে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব গোলাম রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত ১০ মাস ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত হয়ে অবৈধ উপায়ে ভারতীয় চিনি বাংলাদেশে আসছে। এতে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
“আমরা বারবার বিষয়টি নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কিন্তু চিনি আসা থামছে না। মাঝে মধ্যে দেখি দু-চার বস্তা চিনি জব্দ করা হচ্ছে। কিন্তু এটা চোরাচালানের তুলনায় খুবই অপ্রতুল”, বলেন মহাসচিব।
[এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা দিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ফয়সাল আতিক ও কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি মারুফ আহমেদ]
আরও পড়ুন:
সিলেটে আইনজীবীর ওপর হামলায় আসামি ছাত্রলীগ নেতারা
সিলেটে আইনজীবীর উপর হামলার অভিযোগ, গুলি ও হাতবোমা বিস্ফোরণ
সিলেটে চিনি লুটের মামলায় আরেক ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার
সিলেটে ফের ট্রাকে পাথরের নিচে মিলল ২৭৫ বস্তা চিনি, চালক গ্রেপ্তার
সিলেটে চিনি 'লুট': উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা গ্রেপ্তার
সিলেটে ট্রাকে পাথরের নিচে ছিল ২০০ বস্তা চিনি, আটক ২
চিনি লুট: সিলেটে ছাত্রলীগের দুই কমিটি বিলুপ্ত
সিলেটে দেড় টন চিনি লুটের ঘটনায় মামলা, উদ্ধার ৮০ বস্তা
সিলেটে ট্রাক চালককে জিম্মি করে দেড় টন চিনি লুট
সিলেটে ১৪ ট্রাক ভারতীয় চিনি জব্দের ঘটনায় মামলা, আসামি অজ্ঞাত
সিলেটে ভারতীয় চিনি বোঝাই ১৪ ট্রাক জব্দ
সিলেটে পর্যটন কেন্দ্রের পাথর চুরি: ছাত্রলীগের সাবেক নেতাসহ আসামি ১৭