“রান্না করে খাওয়ার মত অবস্থা নাই, আরেকজনের বাড়িতে খাচ্ছি। বেড়িবাঁধটা শক্ত থাকলে আমাদের এমন হইতো না,” বলেন উপকূলের এক বাসিন্দা।
Published : 02 Jun 2024, 01:32 AM
চাঁদপাই ইউনিয়নের দক্ষিণ কাইনমারীর ফ্রান্সিস সরদারের বাড়ি থেকে দেখা যায় পশুর নদীর ঢেউ। অথচ ঘূর্ণিঝড় রেমাল যেদিন আঘাত হানে, তখনও চোখের সামনে ছিল মাটির উঁচু বাঁধ।
প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের তিন দিন পর বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, নদীর পাড়ে এবড়ো থেবড়ো হয়ে আছে বেড়িবাঁধের মাটি; রেমালের ক্ষত চিহ্ন।
এলাকার বাসিন্দারা বলেন, বছর দুই আগেই বাঁধটি অনেক উঁচু করে সংস্কার করা হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাসের ঢেউ সেটি ভেঙ্গে পুরো গ্রাম প্লাবিত করেছে।
পানির স্রোত আসার সঙ্গে সঙ্গেই কাছের এক পাকা বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন ফ্রান্সিস। যাওয়ার আগে ঘরের মালামাল সব উঁচুতে রেখে যান। ঝড় শেষে ফিরে দেখেন, নতুন করে করা ঘরের মাটির উঁচু দেয়াল ভেঙে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে পানির স্রোত।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “রান্না করে খাওয়ার মত অবস্থা নাই, আরেকজনের বাড়িতে খাচ্ছি। বেড়িবাঁধটা শক্ত থাকলে আমাদের এমন হইতো না।”
গত রোববার বিকালে রেমালের প্রভাবে ভারি বৃষ্টিপাত ও জোয়ারে প্লাবিত হতে শুরু করে উপকূলীয় জেলাগুলো, যার মধ্যে ছিল বাগেরহাট। কাইনমারীর ৯ নম্বর ওয়ার্ডে পশুর নদীর তীরে ১০৫টি বাড়ি রয়েছে, যার সবই নদীর পানিতে প্লবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাসিন্দারা বলছেন, বহু বছরের পুরনো এ বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর ঠিক করা হয়; কিন্তু সেটি ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর মতো উপযোগী নয়। তাদের দাবি টেকসই বাঁধের।
দক্ষিণ কাইনমারীর রত্না এমিলিয়া শেখ বলেন, “এত বড় ঝড়ে মাটির বেড়িবাঁধ টিকতে পারে না। আমরা ত্রাণ এসব কিছু চাই না। আমাদের জন্য যদি বেড়িবাঁধটা টেকসই করে দেয় তাইলে আর কিছু লাগবে না। একদিন খাটলে খাবারের ব্যবস্থা করা যাবে।”
মোংলা উপজেলা চেয়ারম্যান আবু তাহের হাওলাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যখন নদীর ঢেউ আসতে থাকে ভাঙতে থাকে বেড়িবাঁধ।
“বাঁধগুলো রক্ষা করার জন্য এখানে প্যারাসাইটিক দেওয়া দরকার, স্ল্যাব দেওয়া দরকার। সেগুলোর ব্যবস্থা আমাদের নাই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে আমরা অনেকবার বলেছি।”
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশে ষাটের দশকে বেড়িবাঁধগুলো করা হয়েছে। গত ২০/২৫ বছরে বাঁধের উঁচু হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
“এখন আর সে হাইটও নেই। যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সে পরিমাণে রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। সে কারণে যেটুকু প্রটেকশন দেওয়ার কথা সেটা দিচ্ছে না।”
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলামও টেকসই বাঁধ নির্মাণের কথা বলেছেন।
“কোস্টাল এরিয়ার বাঁধগুলো নিচু হয়ে গেছে। বিভিন্ন সাইক্লোনের প্রভাব পড়েছে। টেকসই আধুনিক ডিজাইনের মাধ্যমে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও জলোচ্ছ্বাসের বিষয়টি মাথায় রেখে এগুলো করতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক মোকাদ্দেম হুসাইন জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালে ২০০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার এলাকার কোন কোন জায়গায় পুরোপুরি, কোথাও আংশিকভাবে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে।
“এগুলোকে টেকসই করার জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার। আগামভাবে বাঁধগুলো পুনঃনির্মাণ করতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে শুধু টাকা দিলে হবে না, এখানে প্রচুর অনিয়ম হয়- তদারকি করতে হবে। প্রতিবছর মেইনটেইন করতে হবে। গাছপালার মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী করতে হবে এসব এলাকায়।”
এ বিষয়ে জানতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মুহাম্মদ আমিরুল হক ভূঞার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, “সরকারের এই পরিকল্পনা আছে। শক্ত বাঁধ করতে টাকা লাগে, তাও করার কথা আছে। রাতারাতি করা যাবে না, আমাদের নলেজে আছে।”
মোংলার পথে-ঘাটে এখনো রেমালের ক্ষতচিহ্ন
বুধ ও বৃহস্পতিবার দুদিন বাগেরহাটের মোংলা উপজেলায় ঘুরে পথে-ঘাটে রেমাল ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে।
ছয়টি ইউনিয়ন আর একটি পৌরসভা নিয়ে মোংলা উপজেলা। প্রতিটি উপজেলাতেই দেখা যায়, এলোপাতাড়িভাবে ভেঙে পড়ে আছে ঘর বাড়ি, রাস্তা, মাছের ঘের এবং বাড়িঘরের উপর পড়ে আছে ছোট-বড় গাছ। তলিয়ে গেছে সব মাছের ঘের। কিছু বাড়ি অর্ধেক ডুবে আছে, কোনোটার সামনে পানি জমে আছে। ঘরের ভেতরেও কাদামাটি রয়েছে। ঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাসে রাস্তাগুলোও ডুবে গিয়েছিল।
এই এলাকায় উঁচু করে বাঁধা হয় ঘর, যাতে ভেতরে পানি না ঢুকে। সেগুলোতে হাঁটু পর্যন্ত পানি উঠেছিল বলে জানিয়েছেন বাসিন্দারা।
সোনাইলতলা ইউনিয়নের জয়খাঁ গ্রামে একদল নারী জানালেন, গত রোববার রাত সাড়ে তিনটার দিকে এলাকায় ঢুকে পড়ে নদীর পানি, রাস্তা ভেঙে ঘরেও চলে আসে। তখন আর তারা ঘরে থাকতে না পেরে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যান।
উঁচু ঘর যাদের, তারা প্রথমে আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি। পানি যখন তাদের ঘরেও ঢুকতে থাকে তখন তারাও ছুটতে থাকেন আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে। পরে বাড়ি ফিরে তাদের বেশির ভাগই বাড়ি-ঘর অক্ষত পাননি। বাতাসের চেয়ে পানির স্রোত বেশি ক্ষতি করেছে বলে জানান তারা।
পুষ্প মৃধা বলেন, “দেখি শো শো শব্দ করে পানি আইতাছে। পরে সাঁতরে চলে আসছি, আসতে আসতে হাত-পা ছিলে গেছে। ফিরে গিয়ে আর বাড়ি-ঘর ঠিক পাইনি। দেখতেছিলাম আমার জিনিসপত্র সব ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু নিতে পারিনি।”
দক্ষিণ কাইনমারীতে রত্না এমিলিয়া শেখের বাড়িতেও পানি দেখা গেছে। তার ঘর হেলে গেছে, চালের টিন উড়ে গেছে কয়েক জায়গা থেকে।
তিনি বলেন, বাতাসে যখন টিনের চাল উড়ে যাচ্ছিল তখন সেটিকে রক্ষা করতে তার স্বামীকে টিনের চালে তুলে দেন। দুজন মিলে সেটিকে ধরে রাখার চেষ্টা করেন। বাতাসের সঙ্গে টিকতে না পেরে ছেড়ে দেন চাল।
“বাতাস এমন বাড়ি দিছে, ঘর দুইদিক দিয়ে হেলে গেছে। সব পুটলি বেঁধে খাটের উপর রেখে বের হইছিলাম, এসে দেখি ভেসে গেছে। আমাদের কিছুই থাকল না, আমার ১৪ বছরের সংসার ভেসে গেল, এর আগে আমার শাশুড়ি করেছে ৫০ বছর। আমার যতটা কষ্ট ঠেকতেছে, তার চেয়ে তো তার আরও বেশি কষ্ট ঠেকতেছে।”
এমিলিয়া শেখ প্রশ্ন তুলেন, একের পর এক ঘূর্ণিঝড় যেভাবে ক্ষতি করে যায় উপকূলজুড়ে সে ক্ষতি পূরণ করবে কে?
“চাল ডালে তো আর জীবন চলে না। আমার যে ঘর ভেঙে গেছে সেটা ঠিক করতে সর্বনিম্ন ২ লাখ টাকা খরচ হবে সেটা তো সরকার দেবে না। যদি দুর্যোগের ক্ষতি কমানোর ব্যবস্থা করা যেত তাহলে তো আমাদের এই জরিমানাটা পড়ত না।”
একই গ্রামের শিমুল সরদারের বাড়িও নড়বড়ে করে দিয়েছে ঘূর্ণিঝড়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ফসলি জমি। মাসখানেক আগে বাড়ির পাশেই তিনি সবজি চাষ শুরু করেছিলেন, লোনা পানিতে গাছগুলো মরে গেছে, ভেসে গেছে শাক।
তিনি বলেন, “শাকগুলো বিক্রি করার মতো হইছিল। এখন ধারকর্জ করে চলতে হবে। এভাবে যতদিন চলে। আবার আয় করব কিছু ঋণ দেব, এভাবেই চলতে হবে।”
মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যায় না কেন?
সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রগুলো দুর্যোগ কবলিত এলাকা থেকে দূরে, থাকার অনুপযোগী আর জিনিসপত্র চুরির ভয়ে সেখানে যেতে চান না বলে জানান মোংলার বাসিন্দারা।
মোংলা উপজেলায় ১১৯টি সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো নদী এলাকা থেকে দুই-তিন কিলোমিটার দূরে।
দক্ষিণ কাইনমারীর রত্না এমিলিয়া শেখ বলেন, এলাকাটিতে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নাই। দুর্যোগের সময় তারা গির্জা আর মিশনারি স্কুলে আশ্রয় নেন।
“আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে দেড় ঘণ্টা সময় লাগবে। সেখানে যেতে যেতেই রাস্তায় মরে যাব, খালের পাশ দিয়ে যেতে হয়।”
চিলা উপজেলার সাকিনাথ বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রের দেয়াল ফেটে গেছে; তাই তারাও সেখানে না গিয়ে বয়স্ক ও বাচ্চাদের গির্জায় পাঠিয়ে দেন।
“অনেক দূরে সেটাও অনেক আগে করছে, মেরামত করে না। ওই দেয়াল উপরে পড়লে তো মরে যাব। ঘরে থাকা এর চেয়ে ভালো, উপরে গাছ পড়লে ঠেলেঠুলে তো বাঁচব।”
সাকিনাথ বলেন, “ঝড় আসার পর বয়স্ক, বাচ্চাদের পাঠাই দেই। কিন্তু একদল আছে মানুষের ঘর থেকে চুরি করে। সব তো নিয়ে যাওয়া সম্ভব না, একারণে আমরা রিস্ক নিয়ে থাকি।”
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস নিয়েও আস্থার সঙ্কট রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষদের।
সাকিনাথ বলেন, “যখন ৯ নম্বর সিগন্যাল দিছে তখনও গুরুত্ব দেইনি, কারণ যেভাবে বলে সেভাবে কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হই না। কিন্তু এবার যা ঝড় দেখলাম, পানি যখন উঠা শুরু করছে তখন সবাইকে গির্জায় পাঠানো শুরু করি।”
অধ্যাপক মোকাদ্দেম বলেন, “দুর্যোগ বন্ধ করা যাবে না, ঝুঁকি হ্রাস করতে হবে। তাদেরকে আশ্রয়কেন্দ্রে দ্রুত নিয়ে আসার জন্য ব্যবস্থাপনা রাখতে হবে। খাবার, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে। আর যে বাড়িগুলো নষ্ট হয়েছে সেগুলো নির্মাণ করার সময় দুর্যোগ সহনীয়ভাবে নির্মাণ করতে হবে।”
মোংলা উপজেলা চেয়ারম্যান আবু তাহের হাওলাদারও বলছেন, আশ্রয়কেন্দ্রগুলো দূরে দূরে; তবে জরাজীর্ণতার বিষয়টি স্বীকার করছেন না তিনি।
“নতুন করে যেগুলো করা হয়েছে সেগুলো ভালো। পুরনোগুলোর পাশে আবার আশ্রয়কেন্দ্র হইছে। পুরনোগুলো নিয়ে আর ভাবছি না।”
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আশ্রয়কেন্দ্র আরও করার পরিকল্পনা সরকারের আছে; তবে জায়গার সঙ্কট রয়েছে।
“উপযুক্ত জায়গা না পেলে তো করা যাচ্ছে না। তারপরও সরকারের আরও পরিকল্পনা রয়েছে। তারা যদি আগেভাগেই আশ্রয়কেন্দ্রে আসত তাহলে এত মৃত্যুর ঘটনা ঘটত না। আর লুটপাটের কোনো ঘটনা কিন্তু নেই।”
আরও পড়ুন
রেমালের ধাক্কা: চিংড়ির ঘের নয়, যেন বহমান নদী
'ত্রিযোগে' ভয়ঙ্কর রেমাল কী শিক্ষা দিয়ে গেল?
ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত নদীর তীর ও বাঁধ দ্রুত সংস্কারের নির্দেশ
জলবায়ু বাজেট আরও গুরুত্ব পাবে,আশায় মন্ত্রী
ঘূর্ণিঝড় রেমাল:আবারও সামনে সুন্দরবন