“বাতাসের গতিবেগ কম হলেও ৩৬ ঘণ্টার বেশি উপকূলে স্থায়ী ছিল রেমাল। ভাটার সময় সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার এমন ঘটনা স্থানীয়রা চার দশকে দেখেনি।”
Published : 01 Jun 2024, 01:37 AM
এপ্রিল জুড়ে অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ, প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল আর বঙ্গোপসাগরে আগেভাগে মৌসুমি বায়ু বা বর্ষা চলে আসার ‘ত্রিযোগ’ এবার দুর্যোগের নতুন মাত্রা দিয়েছে।
রেমালে বাতাসের গতিবেগ মাঝারি থাকলেও এর বিস্তার আর স্থায়িত্বের কারণে ক্ষয়ক্ষতি বেড়েছে। উপকূলীয় দুর্গত জেলায় অন্তত ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। সম্পদের ক্ষতি আরও বেশি।
আবহাওয়াবিদ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই দুর্যোগ কিছু ‘শিক্ষা’ দিয়ে গেছে। ভবিষ্যতে করণীয় কী, সেটাও জানিয়ে দিয়ে গেছে।
এ বছর প্রাক-মৌসুমে এপ্রিল-মে মাসে রেকর্ড সংখ্যক দিন দাবদাহ (সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে) বয়ে গেছে দেশজুড়ে। এরপর মে মাসের শেষ সপ্তাহে এল রেমাল। বর্ষার আগে আগে প্রচুর জলীয় বাষ্প থাকায় দীর্ঘ সময় উপকূলে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে জোয়ারের তোড় যোগ হয়ে অতি ভারি বৃষ্টি হয়েছে।
ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (এনএওএমআই) নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার দাশের ভাষায়, এবারের ঘূর্ণিঝড় ছিল ‘ব্যতিক্রমী’।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাতাসের গতিবেগ আগের রেকর্ডগুলোর চেয়েও কম হলেও ৩৬ ঘণ্টার বেশি সময় এ ঝড় উপকূলে স্থায়ী ছিল। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিটা হয়েছে জলোচ্ছ্বাসের কারণে। ভাটার সময় সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার এমন ঘটনা স্থানীয়রা গত চার দশকে দেখেনি।”
এ বিশেষজ্ঞ জানান, গত কয়েক দশকে মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ের রেকর্ড বেশি রয়েছে। তবে ২০১৫ সালে জুলাইয়ে বর্ষার সময়ে ঘূর্ণিঝড় কোমেন ছিল ব্যতিক্রম।
২০০৬ সালের নভেম্বরের সিডর ও ২০০৯ সালের মে মাসে আইলা ঘূর্ণিঝড়ের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি দেড় দশকেও পূরণ করা যায়নি। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের পাশাপাশি টেকসই বাঁধ নির্মাণ ও কৃষি খাত, সুন্দরবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়ার পর টেকসই উন্নয়নের জন্য সমন্বিত গবেষণার প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
|
এপ্রিল |
মে |
জুলাই |
অক্টোবর |
নভেম্বর |
২০০৭ |
|
আকাশ |
|
|
সিডর |
২০০৮ |
|
|
|
রেশমি |
|
২০০৯ |
বিজলী |
আইলা |
|
|
|
২০১৩ |
|
ভিয়ারু |
|
|
|
২০১৫ |
|
|
কোমেন |
|
|
২০১৬ |
|
রোয়ানু |
|
|
|
২০১৭ |
|
মোরা |
|
|
|
২০১৯ |
ফণি |
|
|
|
বুলবুল |
২০২০ |
|
আম্ফান |
|
|
|
২০২১ |
|
ইয়াস |
|
|
|
২০২২ |
|
|
|
চিত্রাং |
|
২০২৩ |
|
মোচা |
|
হামুন |
মিধিলি |
২০২৪ |
|
রেমাল |
|
|
|
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, সাধারণত এপ্রিল ও মে মাসে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। এর একটি কারণ হল, এই সময় সাগর উত্তপ্ত থাকে, বৃষ্টি না হওয়ার কারণে সাগরের পানির তাপমাত্রা বেড়ে যায়। সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা যদি গড়ে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকে, তখনই এ ধরনের ঘূর্ণিঝড় হয়।
তিনি জানান, দেশে যতগুলো ঘূর্ণিঝড় হয়েছে, তার বেশিরভাগই আঘাত হেনেছে মে মাসে। আইলা হয়েছে ২৫ মে, ইয়াসও হয়েছে ২৫ মে, এবার ২৬ মে আঘাত করেছে রেমাল।
“রেমালের গতি সিডরের তুলনায় অর্ধেকেরও কম ছিল। সিডরের গতি ছিল সর্বোচ্চ ২৬০ কিলোমিটার, যখন সুন্দরবনের বাধা অতিক্রম করে লোকালয়ে আঘাত করে সেটা ছিল ২২৩ থেকে ২৩৭ কিলোমিটারের ভেতরে। রেমাল এসেছে ৯০ থেকে ১১০ কিলোমিটার বেগের বাতাস নিয়ে, কিন্তু মনে হচ্ছে ক্ষয়ক্ষতি অনেক।”
এ শিক্ষক জানান, সিডরের ঘূর্ণায়নের ব্যাস ছিল কম জায়গা নিয়ে। আইলাও কম জায়গায় ক্ষতি করেছিল। কিন্তু রেমালের ব্যাস ছিল অনেক বেশি, সে কারণে বেশি জায়গায় আঘাত করেছে। সিডর ও আইলা কম সময় ধরে তাণ্ডব চালিয়েছিল, কিন্তু রেমাল অন্তত ৩০ ঘণ্টা ধরে ঘূর্ণায়ন ছিল।
আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, “ঘূর্ণিঝড়ের ঘূর্ণনের সময় তিনবার জোয়ার হয়েছিল। জোয়ারের সঙ্গে যখন ঘূর্ণন হয়েছে, জলোচ্ছ্বাসের মাত্রাটা বেশি হয়েছে। এর ফলে ক্ষয়-ক্ষতিটা বেশি হয়েছে।”
ক্ষয়ক্ষত্রির প্রাথমিক চিত্র
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (এনডিআরসিসি) মোহাম্মদ নাজমুল আবেদীন বলেন, রেমালে এখন পর্যন্ত ১৬ জনের নাম, ঠিকানা ও মৃত্যুর কারণসহ মৃত ব্যক্তির তথ্য পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে পিরোজপুরে, ৩ জন করে মারা গেছে বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলায়। চট্টগ্রাম, খুলনা, সাতক্ষীরায় প্রাণ হারিয়েছে একজন করে।
ঝড়ে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৫২৮টি বাড়িঘর আংশিক ও ৪০ হাজার ৩৩৮ টি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়েছে।
>> দুর্গত মানুষের সংখ্যা ৪৫ লাখ ৯৯ হাজার ৪৬৪ জন। ঝড়ের সময় নয় হাজারের বেশি আশ্রয়কেন্দ্রে ৮ লাখ ৮ হাজার ৫১০ জন আশ্রয় নেয়। সাড়ে চার হাজারেও বেশি গবাদি পশুও আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়।
>> ঘূর্ণিঝড় ও অতিবৃষ্টিতে ১ লাখ ৭১ হাজার ১০৯ হেক্টর ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে। উচ্চ জোয়ারে লোনা পানি ঢুকেছে কৃষি জমিতে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম প্রাথমিক প্রতিবেদনে জানান, কৃষিতে রেমালের প্রভাব পড়েছে ৪৮টি জেলায়। বেশি ক্ষতি হয়েছে বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা নড়াইল, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারে।
>> বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মাছের ঘের ভেসে গেছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন পৌনে তিন কোটি গ্রাহক, মোবাইল নেটওয়ার্ক বিঘ্নিত হয় বিস্তীর্ণ জনপদে।
>> সুন্দরবনের বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১০০ প্রাণীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ঝড়ের সময় জোয়ারের উচ্চতা ছিল ১০ থেকে ১২ ফুটের মত।
তবে এটি ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়। ক্ষয়ক্ষতি ও আর্থিক ক্ষতি নিরূপণে আরও সময় লাগবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
করণীয় কী
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, “উপকূলীয় এলাকায় শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণ করা উচিত। যে বাঁধগুলো আছে, সেগুলো অনেক জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
“বাঁধগুলো নিচু হয়ে গেছে। বিভিন্ন সাইক্লোনের প্রভাব পড়েছে। অনেক জায়গায় নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে। শুধু বাঁধ নয়, যেসব জায়গায় ভাঙন আছে সেখানে ব্যাঙ্ক প্রটেকশন দিতে হবে।”
উপকূলে ৫ হাজার ৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ১৩৯টি বাঁধ আছে। এর মধ্যে ১০টা উঁচু করা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও জলোচ্ছ্বাসের বিষয়টি মাথায় রেখে বাকিগুলোও শক্তিশালী করা জরুরি বলেও মত দিয়েছেন সাইফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “পাশাপাশি বাঁধের সামনে গাছ লাগাতে পারলে ভালো। যেখানে লোকালয় ও জনবসতি আছে, সেখানে গাছ লাগাতে হবে। গাছ আসলে প্রোটেকশন দেয়।”
ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো, দোতলা পাকা বাড়ি তৈরিতে সহজ শর্তে ঋণ দিতে দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ তো জলবায়ু পরিবর্তনের ভুক্তভোগী। বহু মিলিয়ন ডলারের তহবিল হচ্ছে, বাংলাদেশের তো সেখান থেকে অর্থ পাওয়া উচিত।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন ফাতিমা আকতার বলেন, যখনই পৃথিবী উত্তপ্ত হয়, অস্থিতিশীলতা বেড়ে যায় বাতাসে, তখন নানা রকমের ক্ষয়ক্ষতি হবে।
“এ কারণে অনেক বেশি বৃষ্টি- বন্যা হবে, আবার খরাও হবে। একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কিত। এই পরিস্থিটা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণেই হচ্ছে। আমাদেরকে এজন্য বিভিন্ন সচেতনতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।”
প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে আগাম সতর্কতা খুব দরকার মন্তব্য করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, “তবে সেই সতর্কতায় জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস থাকতে হবে। শুধু বিপদ সংকেতই নয়, এর প্রভাব কী, কোন সংকেতের সময় কী করতে হবে, সে বিষয়টিও মনযোগে নিতে হবে।
“যেমন, যদি জানি যে এত উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে, এত এলাকা পর্যন্ত এটা ছড়াতে পারে, তাহলে যারা লবণ চাষি, মাছ চাষি বা ধান চাষি তারা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে।”
এর সঙ্গে প্রচুর বৃক্ষ রোপণ, জলাশয়গুলো বন্ধ না করা, পর্যাপ্ত সবুজ ও খোলা জায়গা রাখাতেও মনোযোগী হতে বলেছেন আবহাওয়া বিজ্ঞানের এই শিক্ষক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, “এবার রেমাল ঘূর্ণিঝড়ের ভিন্নরূপ দেখলাম, লম্বা সময় ধরে বৃষ্টি ছিল। এটির মূল কারণ বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থা। এটা জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে হয়েছে।”
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘূর্ণিঝড়, ডেঙ্গু, ‘আরবান হিট আইল্যান্ডের’ পরিমাণ বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এটা সরাসরি উৎপাদনে প্রভাব পড়ে। তাপমাত্রা বাড়লে মানুষের শক্তি কমে, মনোযোগ বিঘ্ন ঘটে। ফলে শিল্পের উৎপাদন কমে যায়।”
পুরনো খবর
ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত নদীর তীর ও বাঁধ দ্রুত সংস্কারের নির্দেশ
জলবায়ু বাজেট আরও গুরুত্ব পাবে, আশায় মন্ত্রী
যশোরে পারদ উঠেছে ৪৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে
দিল্লিতে পারদ উঠেছে ৫২.৩ ডিগ্রিতে, ভারতের ইতিহাসে সর্বোচ্চ
ঘূর্ণিঝড় রেমাল: আবারও সামনে সুন্দরবন
বাংলাদেশে প্রাণঘাতী যত ঘূর্ণিঝড়
উপকূলজুড়ে ক্ষত রেখে গেল রেমাল
ঘূর্ণিঝড় রেমাল: সুন্দরবনে আরও ৪৪ বন্যপ্রাণীর মৃতদেহ উদ্ধার
রেমাল: বরিশাল বিভাগের কৃষিতে ক্ষতি ৫০০ কোটি টাকার বেশি
রেমাল: পশ্চিমবঙ্গে দিনভর প্রবল বৃষ্টি, ৬ মৃত্যু
রেমাল: বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা আর গাছ পড়ে ঢাকাও দুর্ভোগের নগরী