“কোন খাতে বেশি বরাদ্দ দেওয়া উচিত, সেভাবে অ্যাসেসমেন্ট করে দেওয়া হলে অর্থের অপচয় অনেকটা কমত,” বলেন আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ জাকির।
Published : 31 May 2024, 09:28 AM
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার প্রতিফলন সরকারের প্রথম বাজেটেই দেখতে চাইছেন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী।
তিনি আশা করছেন, নির্বাচনের পর আগামী ৬ জুন যে বাজেট উপস্থাপন করা হচ্ছে- তাতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বাড়বে।
আর বরাদ্দ অনুযায়ী ব্যয় করে মন্ত্রণালয়েরও সক্ষমতার পরিচয় দেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় সাবের হোসেন বলেছেন, “অতীতে হয়ত এই মন্ত্রণালয়কে অতটা গুরুত্ব দেওয়া হত না, এখন বাড়ছে। আমাদেরকেও খরচ করে বা ব্যয় করে প্রমাণ করতে হবে- আমাদেরও সক্ষমতা আছে।
“তবে আমরা দেখব- মিনিস্ট্রির পাশাপাশি এই খাতের জন্য কী হচ্ছে; জলবায়ু পরিবর্তন, অভিযোজন খাতে কী ধরনের বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আমার মনে হয় সেখানে গতবারের তুলনায় এবার বরাদ্দ বেশিই থাকবে।”
নতুন অর্থবছরের (২০২৪-২৫) জন্য দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন করেছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ। সেখানে পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ মিলেছে ১১ হাজার ৮৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, যা মোট এডিপির ৪.১৮ শতাংশ।
পরিবেশ অধিদপ্তর, বন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেনিয়াম, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ও বাংলাদেশ রাবার বোর্ড রয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতায়।
এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী সরকারের আগের মেয়াদে এ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। ২০২৩ সালের জুন মাসে তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশেষ দূতও করা হয়েছিল। সাবের হোসেন চৌধুরীর রয়েছে বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় বাংলাদেশ ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা।
বাজেট নিয়ে প্রত্যাশার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “এবারের বাজেট আমি দুইভাবে দেখব, যে অর্থ সরাসরি আমাদের বরাদ্দ হচ্ছে, আরেকটা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য দেওয়া বরাদ্দ। ২৫টি লাইন মিনিস্ট্রিকে এই দায়িত্ব দেওয়া আছে। এ খাতে বাজেটের পরিমাণ গতবার ছিল প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকার মত। এবার আমরা সেটাও দেখব।
“আর এবারের বাজেটে আরেকটা জিনিস যোগ হবে, সেটা হচ্ছে প্ল্যানিং কমিশন নতুন একটি গ্রিন অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ডেভলপমেন্টের অধীনে যে সমস্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে, যেগুলো আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ছিল, এবারের বাজেটেও হয়তো তার কিছুটা রিফ্লেকশন আসবে। সার্বিকভাবে বাজেট বাড়বে। খাতওয়ারি তো বাড়বেই। তবে মিনিস্ট্রির জন্য কী হবে, সেটা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না।”
এক প্রশ্নের জবাবে সাবের হোসেন বলেন, “মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের বিষয়ে এখনো কোনো তথ্য জানানো হয়নি আমাদের। বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয় সাধারণত আগের বছর কতটুকু খরচ করতে পারলেন, আপনার সক্ষমতা কতটুকু, সেটা বিবেচনায় রেখে।”
এই মন্ত্রণালয়ের গত কয়েক বছরের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা, যেখানে আগের বছরে এই পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫০১ কোটি টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেট ছিল ১ হাজার ২২১ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৫ কোটি টাকা কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয় বাজেট বরাদ্দ পেয়েছিল ১ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা।
অথচ চার বছর আগেই এর চাইতে প্রায় ৬০০ কোটি বেশি বরাদ্দ পেয়েছিল মন্ত্রণালয়টি।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে ৭৩১ কোটি টাকা কমিয়ে করা হয় ১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৫০ কোটি টাকা বাড়িয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা।
তবে বাজেট বৃদ্ধির চাইতে কোন খাতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে সেটিকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিবেশ ও জলবায়ু সুরক্ষার জন্য মন্ত্রণালয়ে বৈদেশিক সহায়তা বা অর্থায়ন হয়, সেই খাতে অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ প্রতিবছরই বাড়ছে। তবে ক্লাইমেট বাজেটের কথা যদি বলি, সেখানে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বাইরে অন্যান্য মন্ত্রণালয় যেমন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাজেট গত তিন বছর ধরে কমছে। সে হিসাবে ক্লাইমেট রিলেটেড এক্সপেনডিচার কমছে।
“২৫ মন্ত্রণালয়ের ক্লাইমেট রিলেটেড যে বাজেট, সেখানে দেখা যাচ্ছে যুবদের বাজেট, নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ কম। তবে বাজেটে বরাদ্দের চেয়ে আমাদের জন্য জরুরি হল বাজেট অ্যাসেসমেন্ট করা। এবছর কোন খাতে বেশি বরাদ্দ দেওয়া উচিত, সেভাবে অ্যাসেসমেন্ট করে দেওয়া হলে অর্থের অপচয় অনেকটা কমত।”
আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ জাকির বলেন, সরকারের জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত ‘বিশাল গ্যাপ’ আছে তিনটি ক্ষেত্রে। সেগুলো হল মেইনস্ট্রিমিং, পার্টিসিপেশন অ্যান্ড ইনক্লুশন মনিটরিং এবং ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন অ্যান্ড মিটিগেশন।
“ক্লাইমেট বাজেটে টাকা বরাদ্দ দেওয়া যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিটির ল্যাক খুঁজে বের করা; পার্লামেন্টে অ্যাসেসমেন্ট করে সে অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যান করা, তারপর সম্পদের উৎস খুঁজে বের করা।
“দীর্ঘমেয়াদি অর্থের উৎস হিসেবে সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিখাত অনুদান- এগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো প্রকল্পে যে পরিমাণ বাজেট প্রয়োজন, সেরকম বরাদ্দ দেওয়া হয় না। ফলে বরাদ্দের পুরোটাই নষ্ট হয়। এভাবে টাকা নষ্ট করার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।”
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজেটে দেওয়া বরাদ্দ খরচ করতে না পারার কারণে বরাদ্দ কম বেশি করা হয়ে থাকে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাস্তবায়নের হার বেশ কম। এজন্য বাজেটে বরাদ্দও কম পেয়ে থাকে এই মন্ত্রণালয়।
কোন খাতে বরাদ্দ বেশি দেওয়া উচিত বলে মনে করেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী বলেন, “অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বনায়নে, বিশেষ করে আরবানে সবুজ গ্রিনারি তৈরিকে ১ নম্বর প্রায়োরিটি দেওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত গ্রিনারি ইনিটগ্রেটেড পণ্ড তৈরি করা; এটাতে বরাদ্দ দেওয়া উচিত যাতে করে ঢাকা শহর যে হিট আইল্যান্ডে পরিণত হচ্ছে, এটা থেকে উত্তরণ সম্ভব হয়।
“তৃতীয় জায়গাটি হলো নদী উদ্ধার করা। নদীর দূষণ নিয়ন্ত্রণ করে, নদীর তীরভূমি উদ্ধার করে সংরক্ষণ করা, সেগুলোকে কমিউনিটি ম্যানেজমেন্টে নিয়ে যাওয়া উচিত। তাহলে নদী দখল দূষণ বন্ধ হবে। অ্যাকসেস টু ওয়াটার যে ক্রাইসিস রয়েছে, সেটা থেকে কিছুটা উত্তরণ হবে।”
জাকির হোসেন বলেন, “এয়ার পলিউশনের ক্ষেত্রে রিসার্চ এবং মনিটরিংয়ে বরাদ্দ কম; এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কোন জায়গায় কী ধরনের পলিউশন হচ্ছে- এটা বুঝতে হবে, রিয়েল টাইমে বুঝতে হবে। এজন্য ব্যাপক গবেষণা করা দরকার, হেলথ ইমপ্যাক্ট কী হচ্ছে, সেটা জানতে পারছি না।
“বিশ্ব ব্যাংক একটা রিপোর্ট দিচ্ছে, সেটার উপর নির্ভর করছি। নিজস্ব পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে সরকার এই জায়গাগুলোতে কাজ করতে পারে। পরিবেশ অধিদপ্তরের সামনে- প্রায়োরিটি দেওয়া উচিত কনজারভেশন এবং সোর্স পলিউশনকে সিল করে দেওয়ায়। এজন্য কার্বন ট্যাক্স এবং পলিউশন ট্যাক্স বসানো যেতে পারে বাজেটে।”
তিনি বলেন, “আমাদের অর্থ কম, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে টাকা নষ্ট করা যাবে না। এক্ষেত্রে দূষণের উৎস বন্ধ করার চেষ্টা করতে হবে। সেখানে কীভাবে করা যায়, সে বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা দরকার।
“বায়ুদূষণ রোধে কত টাকা ব্যয় করা সম্ভব, এর চেয়ে উৎস বন্ধ করার বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া তুলনামূলক সহজ। যেমন ফসিল ফুয়েল ব্যবহারে কর বৃদ্ধি; যারা পুরোনো গাড়ি ব্যবহার করছেন, সেগুলো মার্কেট থেকে আউট করা দরকার এবং কার্বন ট্যাক্সিং করা উচিত।”
পরিবেশ ও জলবায়ু খাতে ব্যয়ের জন্য বিকল্প অর্থ উৎসে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন এই পরিবেশ কর্মী।
তিনি বলেন, “জাকাত একটি ভালো উৎস হতে পারে। সিএসআর হিসেবে পল্যুশন ট্যাক্স ধরা যেতে পারে। স্থানীয় পর্যায়ে হোল্ডিং ট্যাক্স বা কার্বন ট্যাক্স হতে পারে। এগুলো চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।”
সরকারের রাজস্ব আয়ের বর্তমান যে অবস্থা তাতে জলবায়ু খাতে খুব বেশি বরাদ্দ পাওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনই এ খাতে বিদেশি অর্থ পাওয়াও যে সহজ নয়, তা মনে করিয়ে দেন জাকির হোসেন।
তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিকভাবে অর্থ পাওয়ার জন্য যে ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ, তা খুব বেশি ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয় না। ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট পার্টনারশিপের আওতায় অর্থায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু সেটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। এখানে অর্থ পাওয়ার যে প্রক্রিয়া, কমপ্লায়েন্সসহ সবকিছু মিলিয়ে বিশেষ করে মন্ত্রণালয়গুলোকে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে, অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে- তাহলেই অর্থায়ন মিলবে।”