বাংলাদেশে প্রাণঘাতী যত ঘূর্ণিঝড়

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে নানা সময়ে, বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন ঊপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 May 2019, 03:54 PM
Updated : 20 May 2020, 06:04 PM

বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝড়ে প্রাণক্ষয় কমেছে।

অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পান যখন উপকূলে আঘাত হেনে লোকালয়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে, সেই সময় গত দেড়শ বছরে বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী ঝড়গুলোতে প্রাণহানির চিত্র দেখে নেওয়া যাক।

# ১৫৮৪ সালে পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী ঘূর্ণিঝড়ে পটুয়াখালী ও বরিশাল জেলার উপকূলের দুই লাখ মানুষ প্রাণ হারান।

# ১৭৬৭ সালে বরিশালের বাকেরগঞ্জে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারান ৩০ হাজার মানুষ।

# ১৮২২ সালের জুন মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল, হাতিয়া ও নোয়াখালীতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের প্রাণ যায়।

# ১৮৩১ সালে বালেশ্বর-উড়িষ্যা উপকূল ঘেঁষে চলে যাওয়া তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল উপকূলের ২২ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে।

# ১৮৭৬ সালের ২৯ অক্টোবর বরিশালের বাকেরগঞ্জে মেঘনা নদীর মোহনার কাছ দিয়ে তীব্র ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার। ঝড়ের প্রভাবে ১২ মিটারের বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় ঊপকূলীয় এলাকা। চট্টগ্রাম, বরিশাল ও নোয়াখালীর উপকূলে তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়া ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় দুই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।

# ১৮৯৭ সালের ২৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম অঞ্চলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়, যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কুতুবদিয়া দ্বীপ। ঝড়ে প্রাণ যায় পৌনে দুই লাখ মানুষের।

# ১৯০৯ সালের ১৬ অক্টোবর খুলনা অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যু হয় ৬৯৮ জনের।

# ১৯৪৮ সালে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারান চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে ১২০০ অধিবাসী।

# ১৯৫৮ সালে বরিশাল ও নোয়াখালীতে ঝড়ে মারা যান ৮৭০ জন।

# ১৯৬০ সালে অক্টোবরে ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার গতির বাতাস নিয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, পটুয়াখালী ও পূর্ব মেঘনা মোহনায়। ঝড়ের প্রভাবে ৪.৫ থেকে ৬.১ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। মারা পড়েন ঊপকূলের প্রায় ১০ হাজার বাসিন্দা।

# ১৯৬১ সালের ৯ মে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার। প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষ মারা যান সেই ঝড়ে।

# ১৯৬২ সালে ২৬ অক্টোবর ফেনীতে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় হাজারখানেক মানুষের মৃত্যু হয়।

# ১৯৬৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার এবং সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া ও মহেশখালী উপকূলীয় অঞ্চল। সেই ঝড়ে প্রাণ হারান ১১ হাজার ৫২০ জন।

# ১৯৬৫ সালে মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বারিশাল ও বাকেরগঞ্জে প্রাণ যায় ১৯ হাজার ২৭৯ জনের। সে বছর ডিসেম্বরে আরেক ঝড়ে কক্সবাজারে মৃত্যু হয় ৮৭৩ জনের।

# ১৯৬৬ সালের অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে সন্দ্বীপ, বাকেরগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লায়; ৮৫০ জনের মৃত্যু হয় সেই ঝড়ে।

# ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার উপর দিয়ে বয়ে যায় প্রলয়ঙ্করী ‘গ্রেট ভোলা সাইক্লোন’। ওই ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২২২ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, ভোলার চর বোরহানুদ্দিনের উত্তর পাশ ও চর তজুমুদ্দিন এবং নোয়াখালীর মাইজদি ও হরিণঘাটার দক্ষিণপাশ সেই ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাণ হারায় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ। চার লাখের মতো বসতভিটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

# ১৯৮৩ সালে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে দুটি ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও নোয়াখালী জেলার উপকূলীয় এলাকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রাণ যায় অনেকের।

# ১৯৮৫ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয় সন্দ্বীপ, হাতিয়া ও উড়িরচর এলাকা; সেই ঝড়ে প্রাণ হারান ঊপকূলের ১১ হাজার ৬৯ জন বাসিন্দা।

# ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায় যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায়। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার। সেই ঘূর্ণিঝড়ে ৫ হাজার ৭০৮ জনের মৃত্যু হয়।

# ১৯৯১ সালের ৩০ এপ্রিল বয়ে যায় আরেক প্রলয়ঙ্করী ঝড়। ভারত মহাসাগরে উৎপত্তি ছিল সেই ঝড়ের, পরে তা ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার গতির ঘূর্ণিবায়ু নিয়ে আছড়ে পড়ে চট্টগ্রাম ও বরিশালের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে। প্রায় দেড় লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে ওই ঝড়ে।

# ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে বিধ্বস্ত হয় দেশের দক্ষিণ উপকূল। উত্তর ভারত মহাসাগরে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে সৃষ্ট এ ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ থেকে ৩০৫ কিলোমিটার। এতে তিন হাজরের বেশি মানুষ মারা যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩২টি জেলার ২০ লাখ মানুষ। উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৬ লাখ টন ধান নষ্ট হয়ে যায়। সুন্দরবনের প্রাণীদের পাশাপাশি ব্যাপক গবাদিপশু প্রাণ হারায়।

# ২০০৮ সালের অক্টোবরে ঘণ্টায় ৮৫ কিলোমিটার বেগের বাতাস নিয়ে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় রেশমিতেও প্রাণহানি ঘটে।

# ২০০৯ সালের ২১ মে ভারত মহাসাগরে সৃষ্টি হয় ঘূর্ণিঝড় আইলা, যার অবস্থান ছিল কলকাতা থেকে ৯৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে। চার দিনের মাথায় ২৫ মে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে আঘাত হানে এই ঝড়। সেই ঘূর্ণিঝড় ভারতের ১৪৯ জন ও বাংলাদেশের ১৯৩ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে উপকূলে প্রায় ৩ লাখ মানুষ বাস্তুভিটা হারায়।

# ২০১৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’-এ প্রাণ হারান ১৭ জন।

# ২০১৪ সালের ৬ অক্টোবর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় হুদহুদ। ঘণ্টায় ১৮০ কিলোমিটার গতির বাতাসের সেই ঝড়ে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ ও ওড়িশার ব্যাপক ক্ষতি হয়, মৃত্যু হয় শতাধিক মানুষের। তবে বাংলাদেশে ক্ষতির পরিমাণ ছিল তুলনামূলকভাবে কম।

# ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই ঘূর্ণিঝড় কোমেনে দেশের চার জেলায় অন্তত চারজন মারা যান। ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার বেগের ঝড়ো হাওয়া নিয়ে সন্দ্বীপের কাছ দিয়ে চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করে সেই ঝড়।

# ২০১৬ সালের ২১ মে পূর্ণিমায় ভরা জোয়ারে আঘাত হানে রোয়ানু। সেই ঝড়ে লাখখানেক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, চট্টগ্রামে মৃত্যু হয় ২৪ জনের।

# ২০১৭ সালের ৩০ মে ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার বেগের বাতাশের শক্তি নিয়ে কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় মোরা।

# ২০১৯ সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ফণী ভারতের ওড়িশা উপকূলে আঘাত হানার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করে, কেড়ে নেয় অন্তত ৯ জনের প্রাণ। তবে ফসলের ক্ষতি ছিল অনেক বেশি।

# একই বছর ৯ নভেম্বর অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আঘাত হানার পর প্রবেশ করে বাংলাদেশে। সেই ঝড়ে মৃত্যু হয় অন্তত আটজনের, ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনেরও৷