প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা হিসেবে ল্যান্ডফোন পুনরায় সচল করতে মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনাও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
Published : 28 May 2024, 09:38 PM
ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত নদীর পাড় ও বেড়িবাঁধ দ্রুত সংস্কারের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশনা দেন বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী আব্দুস সালাম।
রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে মঙ্গলবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এনইসি সম্মেলন কক্ষে একনেক সভায় প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করা হয়।
একনেক সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা মন্ত্রী আব্দুস সালাম বলেন, “রেমালের কারণে দুর্ভোগে পড়া মানুষের খোঁজ খবর রাখতে প্রধানমন্ত্রী রাত দুইটা পর্যন্ত জেগে ছিলেন। তিনি সরকারি সব দপ্তরকে সক্রিয় রাখতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।
“একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে সরকার পাশে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সামনে বর্ষা মৌসুম আসছে। তার আগেই দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত নদীর পাড় ও বেড়িবাঁধ সংস্কার করতে হবে। পানিবাহিত রোগ যাতে ছড়াতে না পারে, সেজন্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নিরাপদ পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।”
একশ কিলোমিটারের বেশি বাতাসের বেগ নিয়ে আঘাত হানান ঘূর্ণিঝড় রেমালের সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস আর ৫ থেকে ৭ ফুট উঁচু বানের তোড়ে ধসে পড়েছে উপকূলীয় এলাকার অনেকের ঘর; গাছপালা ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘর, নিচু এলাকার বাড়ি ডুবেছে পানিতে আর ভেসে গেছে মাছের ঘের। উপকূলজুড়ে ভেসে উঠতে শুরু করেছে ঝড়ের রেখে যাওয়া ক্ষত।
‘রেমাল’ এর তাণ্ডবে উপকূলের জেলাগুলো ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ জেলার শতাধিক উপজেলা।
প্রধানমন্ত্রী আগামী বৃহস্পতিবার সরেজমিন পরিদর্শন করতে যাবেন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা।
ল্যান্ডফোনের কথা মনে করিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী
পরিকল্পনা সচিব সত্যজিৎ কর্মকার বলেন, “এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে ল্যান্ডফোনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, এ ধরনের দুর্যোগকালে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের পাশাপাশি ল্যান্ডফোন চালু রাখতে।”
রেমালের তাণ্ডবে উপকূলীয় জেলাগুলোতে মোবাইল নেটওয়ার্ক বিভ্রাট দেখা দেয়। দুর্ঘটনা এড়াতে বন্ধ রাখা হয় বিদ্যুৎ। এতে দীর্ঘ সময় যোগযোগ বিচ্ছিন্ন হয় অনেকেই।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা হিসেবে ল্যান্ডফোন পুনরায় সচল করতে মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনাও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
আট নতুন প্রকল্প
একনেক সভায় ১১টি প্রকল্পের জন্য ১৪ হাজার ৩৩৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয় অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন থাকবে ছয় হাজার ৫৪১ কোটি ৫২ লাখ টাকা বা ৪৫ দশমিক ৬২ শতাংশ ও বৈদেশিক ঋণ থেকে আসবে ৫৫ শতাংশ বা সাত হাজার ৮৭৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
পুরনো তিনটির মেয়াদ বাড়িয়ে সভায় নতুন ৮টি প্রকল্প অনুমোদন হয় সভায়।
রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ
মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফ ও ভাসান চড়ে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য চার হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক।
মোট আট হাজার ৪৮২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয়ে রোহিঙ্গা জনবসতি ও স্থানীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে দুটি গুচ্ছ প্রকল্প নিয়েছে সরকার।
যোগাযোগে সড়ক নির্মাণ ও উন্নয়ন, রেলপথ বসানো, নষ্ট হওয়া বন ও পাহাড় উন্নয়ন, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, শিক্ষা ও স্বাস্থসহ কয়েকটি খাতে এ অর্থ ব্যয় হবে। প্রতি গুচ্ছ প্রকল্পে স্বাস্থ, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, স্থানীয় সরকারসহ আরো কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা হবে।
পরিকল্পনা সচিব সত্যজিত কর্মকার বলেন, দুই গুচ্ছ প্রকল্পেই রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো রয়েছে।
‘হোস্ট অ্যান্ড ফোরসিবলি ডিসপ্লেসড মিয়ানমার ন্যশানালস(এফডিএমএন)/ ডিসপ্লেসড রোহিঙ্গা পপুলেশন(ডিআরপি) এনহান্সমেন্ট অব লাইভস থ্রো ও মাল্টি-সেক্টরাল এপ্রোচ প্রজেক্ট(এইচইএলপি); ইনফ্রাস্টাকচার রিলেটেড প্রজেক্ট’ নামের গুচ্ছ প্রকল্পটির বরাদ্দ অনুমোদন করা হয় চার হাজার ৮১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
এর মধ্যে ৫৭ দশমিক ০৭ শতাংশ বা দুই হাজার ৩২৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দিবে বিশ্ব ব্যাংক। আর সংস্থাটি অনুদান দিবে এক হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা বা ৩৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ, সরকারের খরচ হবে ২৬১ কোটি ৪২ লাখ টাকা, বাস্তবায়নকারী সরকারি সাত সংস্থা যোগান দিবে পাঁচ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।
আগামী জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জানুয়ারি মেয়াদের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।
আর ‘ইনক্লুসিভ সার্ভিসেস অ্যান্ড অপরচুনিটিজ (আইএসও) ফর হোস্ট কমিউনিটিজ অ্যান্ড এফডিএমএন পপুলেশনস প্রজেক্ট’ প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় চার হাজার ৪০১ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
এর মধ্যে বিশ্ব ব্যাংক ঋণ দিবে দুই হাজার ১৪৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বা ৪৯ শতাংশ, অনুদান দিবে এক হাজার ৭৫৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বা ৪০ শতাংশ, সরকারি অর্থায়ন থাকবে ৪৯৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকার।
সরকারি ছয় সংস্থার মাধ্যমে প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয়েছে আগামী জুলাই থেকে ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত।
রোহিঙ্গাদের জন্য স্থানীয় পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের জন্য বাংলাদেশকে ঋণ নিতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুস সালাম বলেন, “মানবিক দৃষ্টিতে দেখে তাদেরকে (রোহিঙ্গাদের) আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এখনতো তাদের জোড় করে ফেরাতে পারিনা। দাতাসংস্থাগুলো অর্থায়ন করবে বলেছিল, পুরোটা না করায় আমাদের অর্থায়ন করতে হচ্ছে। কাজটা তো করতে হবে।
“সরকার চেষ্টা করেছে, দেন-দরবার করেছে তাদের সঙ্গে (বিশ্ব ব্যাংক)। শুরুতে তারা বলেছিল, শুধু রোহিঙ্গাদের জন্য প্রকল্প। আমরা বলেছি, স্থানীয়দেরও অন্তর্ভুক্ত করতে, এরপরই প্রকল্প হয়েছে।”
দুটি প্রকল্প গ্রহণ, যাচাই-বাছাই ও চূড়ান্ত অনুমোদন প্রক্রিয়াটি প্রথমবারের মতো সফটওয়্যারের মাধ্যমে হয়েছে। কাগজের ব্যবহার কমানো, প্রকল্প পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন অগ্রগতির পুরোটাই দেখা যাবে ‘প্রজেক্ট প্রসেসিং, অ্যাপ্রাইজাল অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বা পিপিএস’ এর মাধ্যমে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা পিপিএস সফটওয়ারের মাধ্যমে সব তথ্য জানতে পারবেন।
প্রধানমন্ত্রী একনেক সভায় ‘পিপিএস’ পদ্ধতির উদ্বোধন করেন বলে জানান পরিকল্পনা সচিব সত্যজিত কর্মকার।
আরও যেসব প্রকল্প
অনুমোদিত চট্টগ্রামের ‘বোয়ালখালী উপজেলাধীন কর্ণফুলী নদী এবং সংযুক্ত খালসমূহের বিভিন্ন স্থানে ভাঙ্গন রোধকল্পে তীর সংরক্ষণ কাজ’ শীর্ষক নতুন প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৪ কোটি টাকা, যার পুরোটাই সরকারি অর্থায়ন।
‘দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলায় টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা (১ম পর্যায়)’ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৮৭৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
‘নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলায় ৪৮০০০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন চালের আধুনিক স্টিল সাইলো নির্মাণ’ প্রকল্পে খরচ হবে ৩৬৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
গ্রামীণ অবকাঠামো খাতে ‘রাজশাহী, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অধীনে ‘টেকনিক্যাল অ্যাসিসটেন্স ফর রিপারপোজিং অব এগ্রিকালচারাল সাপোর্ট টুওয়ার্ডস আ সাসটেইনাবল ফুড সিস্টেম ট্রান্সফরমেশন ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পে ভ্যয় হবে ১৮০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৫৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দিবে বিশ্ব ব্যাংক।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘বিআইডব্লিউটিসির জন্য ৩৫টি বাণিজ্যিক ও ৮টি সহায়ক জলযান সংগ্রহ এবং দুটি নতুন স্লিপওয়ে নির্মাণ’ প্রকল্পে ব্যয় বাড়ানো হয় ৫১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
২০১৮ সালে প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৩১৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। প্রথমবার এক হাজার ৩১৮ কোটি ২০ লাখ ও দ্বিতীবার ব্যয় বেড়েছিল এক হাজার ৮৩৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। গত ২০২২ সালের জুন মাসে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হলেও বাস্তবায়ন হয়নি।
‘কুমিল্লা-লালমাই-চাঁদপুর-লক্ষ্মীপুর-বেগমগঞ্জ (আর-১৪০) (লক্ষ্মীপুর আন্তঃ জেলা বাসস্ট্যান্ড হতে বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা) এবং বেগমগঞ্জ-সোনাইমুড়ী-রামগঞ্জ (আর-১৪২) (সোনাইমুড়ী হতে রামগঞ্জ) আঞ্চলিক মহাসড়ক ৪-লেন সড়ক উন্নয়ন’ প্রকল্পে ব্যয় হবে এক হাজার ৬৭৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
চতুর্থবারের মতো সংশোধন করে ‘কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন (১ম পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের খরচ কমানো হয় ১২৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
এতে মোট খরচ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮৮৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। সবশেষ তৃতীয়বারে ব্যয় সংশোধন করার পর খরচ ধরা হয়েছিল দুই হাজার ১৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
আগামী ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো প্রকল্পটি গত ২০০৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০১২ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
দ্বিতীবার সংশোধনে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে পানি শোধনাগার ও গভীর নলকূপ স্থাপন’ প্রকল্পে খরচ বেড়েছে ১২৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শহীদুজ্জামান সরকার, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন, ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান, আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সচিব রেহানা পারভীন, শিল্প ও শক্তি বিভাগের সচিব মোস্তাফিজুর রহমান, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সচিব কাউসার আহাম্মদ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব শাহনাজ আরেফিন উপস্থিত ছিলেন।