রেমালের ধাক্কা কাটিয়ে জয়খাঁ গ্রামে কবে সত্যিকারের ‘জয়’ আসবে, তা জানা নেই এ প্রান্তিক জনপদের কারও।
Published : 30 May 2024, 12:52 AM
প্রবল শক্তিতে ঝড়-বৃষ্টির দাপট দেখিয়ে ঘূর্ণিঝড় রেমাল তিন দিন আগে বাগেরহাট পেরুনোর পথে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছে; হতাশা ছড়িয়েছে উপকূলজুড়ে, যেখানে চিংড়ির ঘেরগুলো থই থই পানিতে একাকার হয়ে বহমান এক বিশাল নদীর রূপ নিয়েছে।
জেলার উপকূল ঘেঁষা উপজেলা মোংলার অধিকাংশ মানুষের জীবিকা মাছ চাষ বিশেষ করে চিংড়ি উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত। ছয়টি ইউনিয়ন আর একটি পৌরসভা নিয়ে গড়ে ওঠা এ উপজেলায় রেমালের তাণ্ডবে তারাই বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ঝড়ের আগে-পরে আসা জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে তাদের জীবিকার সম্বল।
বুধবার দিনভর মোংলা পৌরসভা ও পশুর নদীর এপার-ওপারে একের পর এক ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, চিংড়ি চাষিদের জন্য ‘বিভীষণ’ হয়ে বয়ে গেছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল। সেখানে এখন ঘরে ও ঘেরে শুধুই হতাশা, চাষিদের মলিন মুখ।
চিংড়ি দেশের রপ্তানি আয়ের ‘সাদা সোনা’ হিসেবে পরিচিত। জোয়ারে আসা লোনা পানি আটকে রেখে মোংলাজুড়ে বাগদা চিংড়ি চাষের বিশাল কর্মযজ্ঞ হয় সারা বছর।
বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেল, সব ঘেরের পাড় পানির নিচে। কার কোন ঘের, কোথায় কার সীমানা; চেনার উপায় নেই। ভেসে গেছে মাছ। কীভাবে সামনের দিন কাটবে, সেই চিন্তার ভাঁজ চিংড়ি চাষিদের চোখে-মুখে।
সুন্দরবন আর চিলা ইউনিয়নের মাঝে বয়ে গেছে পশুর নদী, যেটি রেমালের প্রভাবে জোয়ার ও বৃষ্টিতে ফুলে-দুলে কূল উপচে বিল-ঘেরের সীমানা একপ্রকার নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে। এ ইউনিয়নে গিয়ে দেখা গেল, রেমালের ক্ষত চিহ্ন প্রতিটি ঘরে ও ঘেরে।
পশুর নদীর পাড়ে চিলাবাজার, সেখানে পাওয়া গেল সাকিনাথ নামে স্থানীয় এক বাসিন্দাকে। মা, স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে তার সংসার৷
মধ্যবয়সী সাকিনাথের একটি চিংড়ির ঘের আছে, যেটি চিলাবাজার থেকে একটু দূরে। তিনি জানালেন, পুরোপুরি তলিয়ে গেছে তার ঘের, ভেসে গেছে মাছ।
বছরের শুরুতে সাকিনাথ প্রায় এক লাখ টাকা খরচ করেছিলেন ঘেরে নতুন করে চিংড়ি ছাড়ার উপযোগী করতে। উঁচু করে বেঁধেছিলেন পাড়। রাস্তা উপচে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে সব, এখন আর পাড় দেখা যাচ্ছে না, চেনারও উপায় নেই ঘেরের সীমানা।
একরাশ হতাশা নিয়ে সাকিনাথ বলছিলেন, এই ঘেরে ৫০ হাজার টাকার চিংড়ি রেণু ছেড়েছিলেন, যা এখন বড় হয়েছে, কিছু দিনের মধ্যে বিক্রির উপযোগীও হত। সবই ভেসে গেছে, নদীতে চলে গেছে।
তিন দিন আগে রোববার বিকালে রেমালের প্রভাবে ভারি বৃষ্টিপাত ও জোয়ারে প্লাবিত হতে শুরু করে উপকূলীয় জেলাগুলো, যার মধ্যে একটি বাগেরহাট।
মোংলা সুন্দরবন সংলগ্ন হওয়ায় ওই রাতে যখন ঘূর্ণিঝড় স্থলভাগে আঘাত করে, তখন থেকেই নদী ফুলে লোকালয়, মাঠ পানিতে ভরে উঠতে থাকে। সোমবার মোংলার বিল-ঘের থই থই হয়ে যায়।
সাকিনাথের মত মোংলার আরও কয়েকজন চাষির সঙ্গে কথা হয়। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে তারা বললেন, ঘের থেকে মাছ তোলার পূর্ণ মৌসুমে তাদের জীবিকায় বড় ধরনের আঘাত দিয়ে গেল রেমাল, যা সারা বছরের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াল।
ঘের প্রস্তুত থেকে চিংড়ির পোনা ছাড়া এবং সেগুলো বড় করে তোলা পর্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় চাষিদের।
মোংলার চাষিরা জানাচ্ছেন, বৃষ্টির মৌসুমে পশুর নদীর পানিতে লবণের পরিমাণ কম থাকে, বাকি সময়ে লবণাক্ততা থাকে বেশি৷ তাই বৃষ্টির সময় সে পানি ঘেরে জমিয়ে রাখেন। পরে ঘেরে এমনভাবে পাড় দেওয়া হয়, যাতে সেখানে লবণ পানি ঢুকতে না পারে৷ কারণ অতিরিক্ত লবণ-পানিতে মাছ হয় না।
ঘেরে তৈরি করা হয় সাধারণত জানুয়ারি মাসে৷ সেখান থেকে পরিণত চিংড়ি তোলা যায় রেণু ছাড়ার ৪ মাস পর৷ অর্থাৎ মে-জুন মাসে বিক্রির উপযোগী চিংড়ি তোলা যায়। তবে ৪ মাসের মধ্যে দুই-তিনবার রেণু ছাড়তে হয়; কখনও কখনও রেণু থেকে মাছ কম হলে বা নষ্ট হলে কয়েকবার রেণু দিতে হয় ঘেরে।
কঠিন এ প্রক্রিয়া শেষে মে-জুনে চিংড়ি ধরা শুরু হলে প্রতিটি ঘের থেকে ১৫ দিন অন্তর তা তোলা যায়। অর্থাৎ চিংড়ি চাষিদের সুখের মৌসুম হল মে-জুন। এবার তা ‘দীর্ঘশ্বাস’ এর মৌসুম হয়ে গেল তাদের জন্য।
চিলার বাসিন্দা সাকিনাথ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখানকার ঘেরগুলো এর আগে বুলবুল, আইলা, সিডরের মত আরও ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছে; তবে এবারের মত ক্ষতি আর কখনও হয়নি৷
“আইলার সময় মাছের মৌসুম ছিল না৷ রেমালের সময় এবার মৌসুম, ঝড়ের স্থায়ীত্বও বেশি ছিল; তাই ঘের করা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ মৌসুমে এখন পর্যন্ত একবারও মাছ ধরা হয়নি৷ সব ভেসে গেল। নতুন কিছুর জন্য এখন আরও ৫ মাস অপেক্ষা করতে হবে৷
“ঘের নতুন করে তৈরি করতে হবে৷ রেণু ছাড়তে হবে, পরিচর্যা করতে হবে, সব ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে তারপর পাব মাছ৷”
রেমালে জীবিকার উৎস ধ্বংস হওয়ায় এখন তাকে ঋণের বোঝা সঙ্গী করে কেমন করে দিন পাড়ি দিতে হবে, শঙ্কাভরা সেই গল্পও শোনালেন সাকিনাথ।
তার ভাষায়- ভেসে যাওয়া ঘেরটি প্রস্তুত করতে গিয়ে তাকে ৮০ হাজার টাকার ঋণের বোঝা টানতে হচ্ছে। সপ্তাহ দুয়েক পর মাছ তুলে সে ঋণ পরিশোধ করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে সুন্দর দিন কাটানোর স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি।
“মাছ ভালো হইছিল কিন্তু সব বের হয়ে গেছে৷ ঘরে খাবার কেনার টাকা নাই। এনজিও, জনপ্রতিনিধি এখন শুকনা খাবার, কিছু চাল দিচ্ছে। সেটা ঝড়ের প্রভাব আর ভোটের গরম চলা পর্যন্তই থাকবে৷
“তারপর তো আমাদের চিন্তা কেউ করবে না। বাকিতে জিনিসপত্র কিনতে হবে৷ চাল-ডাল, বাজার সদয় এসব।”
এখন আবার ঋণ করে ঘের প্রস্তুত করার চিন্তা সাকিনাথকে হতাশা করে তুলছে। তিনি বলেন, “রাতেও ঘুম হচ্ছে না, লোন নিয়ে শোধ করতে পারব কি না সে চিন্তায় আছি। আর কোনো উপায়ও নাই৷ আবার দুর্যোগ হতে পারে, যে মাছ ছাড়ব; সেটাও ডুবতে পারে৷ তখন ঋণ শোধ করতে গিয়ে হয়ত জমিটা ছাড়তে হবে (বিক্রি)।”
সোনাইতলা ইউনিয়নের জয়খাঁ গ্রামে গিয়ে কথা হয় সেখানকার বাসিন্দা শিমুল মৃধার সঙ্গে।
এই ঘের শ্রমিক বলেন, “স্বাভাবিকের চেয়ে ঘেরের পাড়ের বেশ ওপর দিয়ে পানি বয়ে যাচ্ছে। স্রোতের সঙ্গে চলে যাচ্ছে মাছ। সেই পানি কবে নামবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।”
চিলাবাজারের সাকিনাথের মত জয়খা গ্রামের শিমুল মৃধাও বললেন, পানি চলে যাওয়ার পর আবার নতুন করে ঘের তৈরি করতে হবে, রেণু-পোনা ছাড়তে হবে৷
একই গ্রামের পুষ্পা মৃধার সংসার সাত সদস্য নিয়ে। নিজেদের কোনো জমি নেই, জমি ইজারা নিয়ে ঘের করেন তারা৷
এবার যে ঘের করেছেন, সেই জমির ইজারায় গেছে ৫০ হাজার টাকা। তাতে রেণু-পোনা ছাড়তে খরচ করত হয়েছে আরও ৫০ হাজার টাকা।
পুষ্পা বলেন, “আমরা ঘের করে খেয়েদেয়ে বেঁচে থাকি। রেমালে সব ভেসে গেল, সামনের দিন কীভাবে চলব জানি না।”
যা-ই হোক, বেঁচে থাকতে ফের ধারদেনা করে হলেও মাছের ঘেরই করার পরিকল্পনা করছেন তিনি।
“যাদের আয়-রোজগার আছে, তাদের কাছ থেকে টাকা নিব৷ আর কই পাব, আর তো কোনো কিছু নাই। ঘের না করলেও তো চলতে পারব না।”
রেমালের ধাক্কা কাটিয়ে জয়খাঁ গ্রামে কবে সত্যিকারের ‘জয়’ আসবে, তা জানা নেই এ প্রান্তিক জনপদের কারও।
ভেসে যাওয়া ঘেরের সামনে বসে ছিলেন চাঁদপাই ইউনিয়নের লিয়াকত শেখ। তিন নাতি, দুই ছেলে ও ছেলেবউ এবং স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। ৩০ বছর ধরে ঘের করছেন, যা তার সংসার চালানোর প্রধান উৎস। তার এক ছেলেও ঘেরের কাজ করেন।
লিয়াকত শেখ বলেন, “ডুবে গেল সব, ভেসে গেল, কোনো মাছ নেই ঘেরে। আর তো আয়ের কোনো উৎস নাই, সামনের দিন কেমনে চলবে জানি না।”
মোংলা উপজেলা চেয়ারম্যান আবু তাহের হাওলাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঘরবাড়ির কথা বাদ দিলে বলতে গেলে উপজেলার আর সব জায়গায় ঘের আর ঘের।
“সব ঘের তলিয়ে গেছে। কোনোটা আলাদা নেই, পানিতে সব সমান হয়ে গেছে। ঘেরের মাছ নদীতে চলে গেছে, চাষিদের মাথায় হাত৷ পুকুর-ঘেরে এত পরিমাণ লবণ-পানি ঢুকেছে যে, সব মাছ মরে ভেসে উঠেছে।
“আমার জীবনে কোনো ঝড় এতটা স্থায়ী হতে দেখিনি। ক্ষতিটা এ কারণেই বেশি হয়েছে এবার।”
ক্ষতির পরিমাণ টাকার অঙ্কে কতটা, ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের কাছ থেকে সব হিসাব পেতে কয়েকটা দিন লাগবে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় কর্মকর্তারা।
আরও পড়ুন
ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত সুন্দরবনে ৩৯ হরিণের মৃতদেহ, বন্যপ্রাণী নিয়ে শঙ্কা
বাগেরহাটে এখনও অন্ধকারে ২ লাখ বিদ্যুতের গ্রাহক
ঘূর্ণিঝড় রেমাল: বাগেরহাটে ভেসে গেছে ২০ হাজারের বেশি মাছের ঘের